চট্টগ্রামে রাব্বানী হত্যা মামলায় খালাস সাইফুলের যাবজ্জীবন
বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান কমোডর (অব.) গোলাম রাব্বানী হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া আসামি মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে বিলাই সাইফুলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. রবিউল আলম বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রায় এ রায় দেন। রায়ে আসামি সাইফুলকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
২০০৫ সালের ৫ এপ্রিল একই আদালত চাঞ্চল্যকর এ মামলায় সাত আসামির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছিল। ওই রায়ে আসামি সাইফুল ইসলামকে খালাস দিয়েছিলেন আদালত। রায়ের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ ২০০৫ সালে হাইকোর্টে আপিল করেন। পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষ দুই আসামি আবু নাসের ও হুমায়ুন কবিরের সাজা বাড়িয়ে এবং আসামি সাইফুলের খালাসের বিরুদ্ধে পুনর্বিবেচনার আবেদন করে। শুনানির পর ২০০৫ সালের ২ আগস্ট হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ রুল জারি করেন।
দণ্ডপ্রাপ্ত সাইফুল চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। বর্তমানে নগরীর ৭ নম্বর পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডের ‘এ’ ইউনিট আওয়ামী লীগের সদস্য পদে আছেন।
মামলার রায়ের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাডভোকেট অশোক কুমার দাশ বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম রাব্বানী ২০০৪ সালে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ওই ঘটনা দায়ের হওয়া মামলায় ২০০৫ সালে দেওয়া রায়ে চার্জশিটভুক্ত আসামি সাইফুল ইসলামকে আদালত খালাস দিয়েছিলেন। সেই রায়ের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ হাইকোর্টে আপিল করে।
রাষ্ট্রপক্ষের পুনর্বিবেচনার আবেদন শুনানি শেষে ২০১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি শুনানি শেষে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ আসামি সাইফুলের বিরুদ্ধে নতুন করে রায় দিতে বিচারিক আদালতে নথি ফেরত পাঠিয়ে দেন। ওই রায়ে আসামি আবু নাসের চৌধুরী ও হুমায়ুন কবির চৌধুরীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন। একই রায়ে অপর আসামি মো. সেলিমের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল এবং অপর আসামি সোহেল ওরফে আবদুল মালেককে খালাস দেন হাইকোর্ট।
বৃহস্পতিবার ওই মামলায় সাইফুলকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত রায় দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় তাকে যাবজ্জীবন সাজা ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পরে তাকে সাজা পরোয়ানামূলে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪ সালের ১১ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রাব্বানী মাইক্রোবাসে করে কর্মস্থলে যাওয়ার সময় নগরীর পাঁচলাইশ এলাকায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন। এসময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ব্যাংককে নেওয়া হয়। ১৩ দিন পর ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তখন তিনি কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনে (কেইপিজেড) ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন।
এ ঘটনায় কেইপিজেডের সাবেক পরিচালক আবু নাসের চৌধুরী ও কর্মচারী হুমায়ুন কবির চৌধুরীর নাম উল্লেখ করে নগরের পাঁচলাইশ থানায় ২০০৪ সালের ১১ এপ্রিল কেইপিজেডের সাইট ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম এমতাজুল ইসলাম এজাহার দায়ের করেন।
ওই বছরের ২৮ আগস্ট সাত আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। অভিযোগপত্রের আসামিরা হলো- আবু নাসের চৌধুরী, হুমায়ুন কবির চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম ওরফে বিলাই সাইফুল, মনছুর আলম, মো. সেলিম, আবদুল মালেক ওরফে সোহেল ও মো. হাশেম।
২০০৫ সালে ওই হত্যা মামলার রায় দেন চট্টগ্রামের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। রায়ে মামলার তিন আসামি মোহাম্মদ সেলিম, মোহাম্মদ হাশেম ও আব্দুল মালেক ওরফে সোহেলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। অন্য দুই আসামি কেইপিজেডের সাবেক মহাব্যবস্থাপক আবু নাসের চৌধুরী ও সাবেক প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির চৌধুরীকে ৫ বছর কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জারিমানা, অনাদায়ে আরও ২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মামলায় অভিযোগপত্রের দুই আসামি মানসুর আলম ও সাইফুল ইসলাম ওরফে বিলাই সাইফুলকে খালাস দেওয়া হয়।
পরে এ রায়ের বাদী ও আসামিপক্ষের আপিল শুনানি শেষে ২০১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরীর হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ রায় দেন। ২০১৬ সালের ৫ অক্টোবর রায়ের আদেশের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়।
হাইকোর্টের ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এ হত্যা মামলায় দুই আসামি আবু নাসের চৌধুরী ও হুমায়ুন কবিরকে ‘কম সাজা’ দেওয়া হলেও বিচারিক আদালত এ বিষয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করেননি। হাইকোর্ট আবু নাসের চৌধুরী ও হুমায়ুন কবিরের সাজা বাড়িয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। এছাড়া নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া তিন আসামির মধ্যে মো. হাশেম ও সোহেলকে খালাস দেওয়া হয়। মো. সেলিমের যাবজ্জীবন আদেশ বহাল রাখে হাইকোর্ট। আর খালাস পাওয়া আসামি সাইফুলের নতুন রায় দিতে নিম্ন আদালতকে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
উচ্চ আদালতের ওই আদেশের পর চট্টগ্রামের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পন করে দুই আসামি কেইপিজেডের সাবেক মহাব্যবস্থাপক আবু নাসের চৌধুরী ও আসামি মো. সেলিম। খালাস পাওয়া আসামিদের মধ্যে সাইফুলের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ হাইকোর্টে আপিল করলেও মানসুর আলমের বিরুদ্ধে করেনি। হাইকোর্টের আদেশের পর সাইফুল ইসলাম বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন।
গোলাম রাব্বানী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নৌবাহিনীর সাবেক এ কর্মকর্তা পরে নৌ পরিবহন বিভাগের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেল হত্যা মামলায় তিনি রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী ছিলেন। মামলা দুটিতে তিনি আদালতে সাক্ষ্যও দেন।
ইকবাল হোসেন/এমকেআর/এমএস