মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি

শিশুর মানসিক ট্রমা সামলাবেন যেভাবে

লাইফস্টাইল ডেস্ক
লাইফস্টাইল ডেস্ক লাইফস্টাইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৫৭ পিএম, ২৪ জুলাই ২০২৫
আহত শিশুদের মানসিক অবস্থা ও ট্রমা নিয়ে জানিয়েছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মাহমুদা। ছবি/জাগো নিউজ

শরীরের ক্ষত সেরে গেলেই একজন মানুষের ওপর সেই আঘাতের প্রভাব কেটে যায় – এই চিন্তা যদি কেউ করেন, তাহলে তিনি মারাত্মক ভুল ভাবছেন।

কোনো মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় যারা প্রাণে বেঁচে যান এবং যারা দূর থেকে সেই ট্র্যাজেডিতে গভীরভাবে প্রভাবিত হন, তারা আর কখনো আগের মানসিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারেন না। এমনকি সেই তারিখটি ভুলে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি প্রতি বছর নিজের শরীরে এর প্রভাব খেয়াল করতে পারেন। তবে সঠিক চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি সুস্থ্য জীবন পাওয়া সম্ভব।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আহত শিশুদের মানসিক অবস্থা ও ট্রমা নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন লিভিং উইথ ওয়েলনেসের প্রতিষ্ঠাতা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মাহমুদা।

‘এখনই আহত শিশুদের সঠিক মানসিক সহায়তার ব্যবস্থা না করলে পরবর্তীতে জটিল মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।’

মাইলস্টোন স্কুলের যে শিশুদের প্রাণ বেঁচে গেছে, তারা চোখের সামনে বন্ধুদের ভয়াবহ মৃত্যু দেখেছে। সেই সঙ্গে নিজেও মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। এসবের প্রভাবে এখন তারা এক গভীর মানসিক আঘাত বা ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

ছোট শিশুদের মন ও মানসিকতা গঠনের এই সময়ে এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও ব্যক্তিত্বের বিকাশে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এখনই এই শিশুদের সঠিক মানসিক সহায়তার ব্যবস্থা না করলে পরবর্তীতে জটিল মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।

ট্রমা কী? শিশুদের জন্য কেন এটি গুরুতর?

ট্রমা হলো কোনো ভয়াবহ, বিপজ্জনক বা আতঙ্কজনক ঘটনার থেকে পাওয়া মানসিক ক্ষত বা আঘাত। শিশুদের ক্ষেত্রে এই মানসিক আঘাতের প্রভাব প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় অনেক বেশি গভীর ও জটিল হতে পারে। কারণ তারা এখনো তাদের আবেগ এবং অভিজ্ঞতা সামাল দিতে শেখেনি, এগুলোর ভারসাম্য রক্ষা করার কৌশলগুলো তারা কেবল শিখছে।

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির মতো একটি ঘটনা শিশুদের মনে নিরাপত্তাহীনতা, ভয়, আতঙ্ক এবং অপরাধবোধ তৈরি করতে পারে। এমনকি অনেক সময় তারা নিজেদের দোষীও ভাবতে পারে। যেমন - ‘আমার বন্ধু মারা গেল, আমি কেন বেঁচে গেলাম?’ এই ধরনের চিন্তা তাদের ভেতরে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক যন্ত্রণা সৃষ্টি করতে পারে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

কীভাবে বুঝবেন শিশু ট্রমার মধ্যে আছে কিনা?

প্রত্যেকটি শিশুর ট্রমার বহিঃপ্রকাশ আলাদা। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখে বোঝা যায় শিশুটি কোনো মানসিক আঘাতে ভুগছে-

১. ঘুমের সমস্যা: দুঃস্বপ্ন দেখা, রাতে ঘুম থেকে চমকে ওঠা, একা ঘুমাতে না চাওয়া।

শিশুর মানসিক ট্রমা সামলাবেন যেভাবে
ছবি/প্রতীকী

বিজ্ঞাপন

২. আচরণগত পরিবর্তন: একদম চুপচাপ হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত বিরক্ত হওয়া বা রেগে যাওয়া।

৩. আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া: আগে যেসব কাজে আগ্রহ ছিল সেসব কাজে হঠাৎ অনীহা চলে আসা।

৪. আচরণের পুনরাবৃত্তি: একই ঘটনার কথা বারবার বলা, ঘটনার দৃশ্য আঁকা বা খেলায় সেই দুর্ঘটনার অভিনয় করা।

বিজ্ঞাপন

শিশুর মানসিক ট্রমা সামলাবেন যেভাবে
ছবি/প্রতীকী

৫. শারীরিক উপসর্গ: কোনো শারীরিক কারণ ছাড়াই পেটব্যথা, মাথাব্যথা, খাওয়া-দাওয়ায় অনীহা ইত্যাদি।

৬. বিচ্ছিন্নতা: বন্ধুদের থেকে দূরে থাকা, পরিবারের সঙ্গেও কম কথা বলা।

বিজ্ঞাপন

এমন লক্ষণ দেখলে পরিবার কী করবে?

শিশুর ট্রমা কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিশুকে স্বাভাবিক বোধ করাতে পরিবার যা করতে পারে-

১. শিশুর মধ্যে নিরাপত্তার অনুভূতি সৃষ্টি করুন

শিশুকে বারবার বলুন যে সে এখন নিরাপদ। তার আশেপাশের পরিবেশ শান্ত এবং পরিচিত রাখার চেষ্টা করুন। টেলিভিশন, সোশ্যাল মিডিয়া বা সংবাদে দুর্ঘটনার ছবি বা আলোচনা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।

২. মনোযোগী শ্রোতা হয়ে উঠুন

শিশু যদি ঘটনার কথা বলতে চায়, তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তার অনুভূতির অবমূল্যায়ন করবেন না। শিশুকে বলবেন না- ‘তোমার কিছু হয়নি’ বা ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ বরং বলুন, ‘তুমি খুব ভয় পেয়েছিলে, এটা স্বাভাবিক’।

বিজ্ঞাপন

৩. শিশুকে নিয়মিত রুটিনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করুন

যত দ্রুত সম্ভব তাকে আগের স্বাভাবিক দৈনন্দিন রুটিনে ফিরিয়ে আনুন। খাওয়া, ঘুম, খেলা ইত্যাদি। পরিচিত ও পূর্বের নিয়ম শিশুদের মধ্যে স্থিতি ফিরিয়ে আনে।

৪. নিজের আবেগ সামলান

আপনার নিজস্ব আতঙ্ক বা দুঃখ শিশুর সামনে বেশি প্রকাশ করলে শিশু আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তে পারে। তাই নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রেখে, আশার আলো দেখিয়ে শিশুকে সান্ত্বনা দিন।

৫. খেলাধুলা ও সৃজনশীল কাজ উৎসাহিত করুন

ড্রইং, গল্প লেখা, গান গাওয়া, নাটক করা – এই সব সৃজনশীল কাজ ট্রমার ভার কমাতে সাহায্য করে। শিশুকে তার অনুভূতি প্রকাশের নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য উপায় দিন।

শিশুর মানসিক ট্রমা সামলাবেন যেভাবে
ছবি/প্রতীকী

৬. প্রয়োজনে মনোবিজ্ঞানীর সহায়তা নিন

যদি দেখেন কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরও শিশুর আচরণগত সমস্যা, দুঃস্বপ্ন, চুপচাপ হয়ে থাকা বা স্কুলে যেতে অনীহা রয়ে গেছে, তাহলে একজন শিশু মনোবিজ্ঞানী বা কাউন্সেলরের সহায়তা নেওয়া জরুরি।

স্কুল ও সমাজের ভূমিকা

পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সমাজেরও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের উচিত, ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের মানসিক পুনর্বাসনের জন্য সাইকো-সোশ্যাল সাপোর্ট কার্যক্রম শুরু করা।

শিক্ষকরা যেন শিশুদের আচরণে পরিবর্তন বুঝে সহানুভূতির সঙ্গে আচরণ করেন। এছাড়া একটি কমিউনিটি হেল্প ডেস্ক বা কাউন্সেলিং সাপোর্ট চালু করা যেতে পারে, যেখানে শিশু ও অভিভাবক উভয়েই সাহায্য পেতে পারেন।

শিশুর মানসিক ট্রমা সামলাবেন যেভাবে
ছবি/প্রতীকী

উত্তরার দুর্ঘটনা আমাদের সামনে আবারও মনে করিয়ে দিল, শিশুরা কতটা সংবেদনশীল। তাই শোকগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে যেমন আমাদের দাঁড়ানো দরকার, তেমনি শারীরিক ও মানসিকভাবে আহত শিশুদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করাও প্রয়োজন। এটা শুধু একজন শিশুর ভবিষ্যত রক্ষার কথা নয়, এটা একটি জাতি হিসেবে আমাদের মানবিক দায়িত্ব।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

লেখক: মাহমুদা
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
প্রতিষ্ঠাতা, লিভিং উইথ ওয়েলনেস

জেপিআই/এএমপি/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।