সিবগাতুর রহমানের গল্প: একজন পুটির বাবা

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:০৪ পিএম, ০৪ এপ্রিল ২০২৫

আমাদের বাড়ি থেকে বাজারটা খুব বেশি দূরে নয়। একসময় আমরা বাজারের ব্যাগ হাতে দোলাতে দোলাতে হেঁটে হেঁটেই সংসারের প্রয়োজনীয় কাজ করে আসতাম। তবে বর্তমানে রাস্তাঘাট ভালো হওয়ায় লোকজন এখন হাঁটার পরিবর্তে সিএনজি বা অটোরিকশায় আসা-যাওয়া করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। খরচটাও নেহায়েত কম, মাত্র দশ টাকায় যাতায়াত সম্পন্ন হয়ে যায়। যদিও আমাদের শৈশবে এই দশ টাকায় এক হালি ডিম অথবা এক কেজি দুধ বা পাঁচ কেজি লবণ কেনা যেত।

সবাই বাজারটাকে বউবাজার বলে ডাকে। কিভাবে এর নাম বউবাজার হলো এটা জানা হয়নি। তবে বিশাল কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় অবস্থিত বাজারটাকে পাখির চোখে দেখলে মনে হবে টকটকে লাল বেনারসি শাড়ি পরে ঘোমটা দেওয়া কোনো এক গাঁয়ের বধূ বসে আছে। হয়তোবা এই সৌন্দর্যের আকর্ষণ থেকেই কোনো এক রোমান্টিক পুরুষের রোমান্টিক উচ্চারণ মুখ ফুটে বেরিয়ে যাওয়া বউবাজার শব্দটিই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। এ থেকেই পরবর্তীতে এর নাম হয়ে যায় বউবাজার।

আমাদের গ্রামের সৌন্দর্যের একটা অংশ পাঠকদের কাছে প্রকাশ করার লোভ থেকেই অতীতের কিছু স্মৃতি রোমন্থন করলাম। যা হোক, যে জন্য হঠাৎ করেই আজ লিখতে বসলাম; সেই কথায় আসা যাক।

সকালবেলা ঘুম থেকে জাগার জন্য আমার একটা জীবন্ত অ্যালার্ম ঘড়ি আছে। সেই ঘড়ির বকবকানির জ্বালায় খুব সকালবেলায় বিছানা ছাড়তেই বাজারের একখান ব্যাগ হাতে ধরিয়ে দিয়ে এটা নেই, ওটা নেই বাজনা বাজাতে বাজাতে পাকের ঘরে চলে গেলেন।

অগত্যা সুবোধ বালকের মতো আমিও একটু ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ দোলাতে দোলাতে বেরিয়ে গেলাম বাজারের উদ্দেশ্যে। বাড়ি থেকে বের হতেই দেখি রাস্তার মোড়ে পুটির দাদি বসে ভিক্ষা করছে। আমাকে দেখেই যেন লজ্জায় মুখের ওপর ঘোমটাটা টেনে দিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছিল। কোথায় যেন একটা খটকা লাগল। মনে মনে ভাবছি পুটির দাদি তো ভিক্ষা করার কথা নয়, হঠাৎ কেন এই অবস্থা! কাছে গিয়ে তার পাশে বসতেই আমার দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। ওনার একটিমাত্র ছেলে প্রাইমারির পর পারিবারিক দরিদ্রতার কারণে আর লেখাপড়া করেনি। দিনমজুরের কাজ করতো। সারাদিন এটা-সেটা করে যা উপার্জন হতো; তা দিয়েই তাদের সংসার চলতো।

রাজনৈতিক কোনো জ্ঞান তার নেই। এমনকি দেশের রাষ্ট্রপতির নাম জিজ্ঞেস করলেও সে বলতে পারবে না। সে-ই কি না হঠাৎ এক আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেয়। মিছিলকারীরা কিছু স্থাপনাসহ আশেপাশে ভাঙচুর করতে থাকে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ বাঁধে। অবুঝ পুটির বাবা মাঝখানে পড়ে পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। একসময় অপরিচিত কিছু লোক সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে রেখে আসে। তাকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালের বেডেই থাকতে হয়।

প্রথম প্রথম কয়েকদিন আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে তাকে কয়েকজন দেখতে গিয়েছিল কিন্তু এখন আর কেউ যায় না। কিভাবে তার সংসার চলে সেটা দূরে থাক; চিকিৎসার কোনো খোঁজ-খবরও কেউ নেয় না। অপরদিকে পুটির দাদির নামে একটা বয়স্ক ভাতার কার্ড করা ছিল; সেটাও বিগত কয়েক মাস যাবত বন্ধ করে রাখা হয়েছে। উপায়ন্ত না দেখে বাধ্য হয়েই পেটের দায়ে পুটির দাদিকে নামতে হলো ভিক্ষাবৃত্তিতে।

আমায় দেখে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘এখন আমাদের কে দেখবে? আমাদের দুঃখ কে বুঝবে?’ বুড়ির শেষ কথাগুলো আমার বুকে যেন তীরের মতো বিঁধতে ছিল। একসময় দেখি আমারও চোখ ভিজে আসছে। কৌশলে বুড়ির কাছে চোখের জল লুকিয়ে বাজারের টাকাগুলো তার হাতে গুঁজে দিয়ে বাসায় ফেরত আসি।

আমার আর বাজারে যাওয়া হলো না। পুটির দাদির শেষ কথাগুলো কান থেকে কোনোভাবেই সরাতে পারছি না। তার মতো আরও কতজন ভিক্ষায় বসেছে আমার জানা নেই। পুটির বাবার মতো আরও কতজন সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেছে, তার সঠিক পরিসংখ্যানও আমার কাছে নেই। সমাজের একজন সচেতন মানুষ হিসেবে একটাই আহ্বান, রাষ্ট্রই যেন হয়ে ওঠে দেশের ধনী-গরিব, ছোট-বড় প্রতিটি নাগরিকের প্রকৃত অভিভাবক।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।