শিক্ষককে নিয়ে স্মৃতিগদ্য

শৈশবে যাকে বাঘের মতো ভয় পেতাম

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:০৬ পিএম, ০৫ অক্টোবর ২০২৫

আইয়ুব আল আমিন

তখন আমি ক্লাস সেভেনে উঠলাম। বন্ধুরা সব আতঙ্কিত। কারণ সেভেনে গণিত ক্লাস নেবেন সামাদ স্যার। সে এক ভয়ংকর ব্যাপার। আমি তো অঙ্কে বরাবর গোল্লা। সংগত কারণেই সবার চেয়ে আমার ভয়ের পারদ সর্বোচ্চ।

যা-ই হোক, শুরু হলো ক্লাস। সৌম্য চেহারার এই মানুষটা এত সুন্দর করে পড়া বোঝান, এত সুন্দর গল্প করেন, এত মিষ্টি করে হাসেন। তাঁকে এত ভয় পাবার কী!

পড়া না পারলে, ক্লাস ফাঁকি দিলে, পরীক্ষার খাতায় ফেল করলে তিনি যে কী ভয়ংকর; তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম। যেদিন তিনি প্রথম সাময়িক পরীক্ষার খাতা দিলেন।

খাতা নিয়ে তিনি ঢুকলেন জোহরের নামাজ পড়ে। আমরা সবাই অবাক! খাতার সাথে বেত নাই। তার বেলায় এমন ঘটনা তো বিরল! ঘটনা কী!

ঢুকেই বললেন, ‘আজকে কি তোমরা রেডি আছো খাতা নেওয়ার জন্য? আজকে নিবা? কারো জ্বর বা অসুখ-বিসুখ আছে নাকি?’
আমাদের কারো মুখে রা নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ। সামনে থেকে দুজনকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তোরা দুজন অফিস রুম থেকে তিনটা তিনটা করে বেত নিয়ে আয় বেছে। ইচ্ছামতো বাছবি, চিকন-মোটা যেটা ভালো লাগে।’ আমাদের কারো আর বোঝার বাকি থাকলো না যে, আজ রোজ কেয়ামত!

যা-ই হোক, অনেক চিল্লাচিল্লি কান্নাকাটি হলো ক্লাসে। সবার খাতা দেওয়া শেষ। আমার নাম নেই, খাতাও নেই।
শেষে তিনি আমাকে ডাকলেন। আমার পা অসাড়। আমি যেতে যেতে দেখলাম টেবিলের ওপর সবগুলো ভেঙে যাওয়া বেত থেকে একটা হাতে নিলেন। ওইসময় আমি ক্লাসে সবার চেয়ে ছোট আর নিরীহ প্রকৃতির ছিলাম। স্যার বললেন, ‘কী খেয়েছিস আজ? তোর মা কেমন আছে? তোর বাবা কেমন আছে? তোর দাদা কেমন আছে?’
আমাকে খাতা দেখালেন, আমি পেয়েছি চব্বিশ। তিনি বললেন, ‘তোর খাতা তোকে দিবো না আমি। তোর বাবা আজকে হাটে আসবে। আমার সাথে থাকবি। তোর বাপকে আমি খাতা খুলে দেখাবো। ছুটির পর তুই যাবি না আজকে খবরদার।’

আমি সেদিন ওই সময়ের পর থেকে আব্বার সাথে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত কী কী চিন্তা করেছিলাম, তা আজ আর মনে নেই। কারণ এই খাতা আমার বাবা দেখলে কী হবে আমি তো তা জানি।
স্যার আমার হাতের কব্জি ধরে নিয়ে গেলেন বাবার কাছে। স্যারের হাতে খাতা নেই। বোধহয় পাঞ্জাবির বড় পকেটে রেখেছেন বুঝলাম।
আব্বার সাথে দেখা হতেই আমি কেঁদে ফেলেছি। স্যার বাবাকে বললেন, ‘রুহুল, তোমগো পাগলা অঙ্কে মেলা নম্বর পাইছে এইবার। আরও পড়লে আরও ভালো করবে। তাই তোমাকে বলতে আইছি। ওরে রসমালাই কিনে দাও।’
আমি অবাক হয়ে স্যার আর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। ওইদিনের দুটো দুইরকম ভালোবাসার মুখ এখনো আমার চোখে জ্বলজ্বল করছে।

সেবার বার্ষিক পরীক্ষায় আমার ভালো রেজাল্ট হয়েছিল। আজীবন গণিতে ফেল করা ছাত্র গণিতে পেয়েছিলাম চুরানব্বই।
এর অনেকদিন পর তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্ভবত থার্ড ইয়ারে। কী কারণে লক্ষ্মীপুরে গেছি। দুপুরবেলা প্রচণ্ড রোদ আর ভিড়। এর মধ্যে আমার নাম ধরে ডাক দিলেন কে যেন। খুব পরিচিত লাগলো গলাটা। দেখলাম আমার সেই স্যার। রাজশাহীর এই হাজার অপরিচিতের মাঝে আমার শৈশবের সেই স্যারকে দেখে এত ভালো লাগলো। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি আপ্লুত হয়ে গেলাম। সব জিজ্ঞেস করলেন, শুনলেন। তারপর বললেন, তার এক আত্মীয়ের সার্টিফিকেটের ভুল সংশোধন করাতে এসেছেন। তার জন্য দুনিয়ার ঝামেলা, তারা বলেছে সময়ও লাগবে পনেরো দিন। স্যার বললেন, ‘একটা চাকরির জন্য সার্টিফিকেটটা তিনদিন পরই লাগবে। বিপদে পড়ে গেলাম বাবা।’
আমি বললাম দেখি।

আরও পড়ুন
এক আকাশের নিচে 
পঙ্কজ শীলের থ্রিলার: কালো নেকাব 

বোর্ডে আমার পরিচিত আনসার ভাই আছেন। আমাকে ভীষণ রকম ভালবাসেন কোনো কারণ ছাড়াই। তাকে গিয়ে বললাম, আমার স্যার এই কাজে এসেছেন। তিনি বললেন, ‘কাগজগুলো দেন। চায়ের কথা বুলেছি, চা খান। আমি আইসছি।’

চোখের পলকে চক্কর দিয়ে ঘুরে এসে বললেন, ‘চারটায় আসেন।’
আমরা বাইরে এসে ঘুরলাম। তিনি সেই স্কুলে পড়ার সময় যেমন হাতের কব্জি ধরে থাকতেন; ওই রকম আমার হাত ধরে থাকলেন সারাক্ষণ। আমরা ঘুরেফিরে চারটায় গেলাম। সার্টিফিকেট ওকে। আনসার ভাইকে চা খাবার জন্য কিছু দেবো। তিনি রাগ করলেন অনেক স্যারের সামনে। আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। ভালোবাসা যে মানুষকে মনে রাখায়, আজ এটা লিখতে গিয়ে বুঝলাম। আহ আনসার ভাই, জানি না কেমন আছেন!

সেদিন স্যারকে আর যেতে দিলাম না। সন্ধ্যাবেলায়ই তিনি রওয়ানা হবেন। আমি ছাড়লাম না। আমার মেসের ছোট্ট রুমে স্যারকে নিয়ে এলাম। আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম খুব। তিনি অনেক গল্প করলেন জীবনের। স্কুল পালিয়ে যাত্রার পাট করার গল্প, স্কাউট করার গল্প, গান লেখার গল্প, স্কুলে মেয়েদের পাহাড়ি নাচ শেখানোর গল্প, নাটকে অভিনয়ের গল্প; আরও কত কী!

তারপর রাতে খেয়ে তার বিছানা করে দিয়ে বললাম, ‘আপনি এখানে ঘুমান। আমি পাশে বন্ধুর রুমে ঘুমাবো।’ এ কথা শুনে তিনি রেগে গেলেন। আমাকে বললেন, ‘কোথাও যাবে না তুমি। এখানে থাকবো দুজনই।’ কোনোভাবেই তিনি আর আমাকে অন্য রুমে যেতে দিলেন না। স্যার ক্লান্ত ছিলেন সারাদিনের পরিশ্রমে। ঘুমিয়ে গেলেন তাড়াতাড়ি।

আমি দেখলাম, একটা ধবধবে সাদা কাগজের মতো ফর্সা লাল মুখ কত সুন্দর হয়। শৈশবে যাকে বাঘের মতো ভয় করতাম; তিনি কেমন শিশুর মতো ঘুমাচ্ছেন।

আজ তিনি নেই। আমি দেখতে পাচ্ছি, তিনি কত শান্তিতে, কত সুন্দর করে ঠিক ওইদিনের মতো করে ঘুমাচ্ছেন। ভালো থাকবেন স্যার। শিক্ষক দিবসে আপনার জন্য অসীম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।