নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাবে কি এনসিপি?
নতুন দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ ১৪৪টি রাজনৈতিক দল আবেদন করেছিল। কিন্তু প্রাথমিকভাবে এসব দলের কোনোটিই ইসির শর্ত পূরণ করতে পারেনি। যে কারণে এসব দলগুলোকে শর্ত পূরণে সময় বেঁধে দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, প্রতিটি দলের আবেদনেই কোনো না কোন ঘাটতি থাকায় যেসব দল নিবন্ধনের আবেদন করেছে সেসব নতুন রাজনৈতিক দলকে চিঠি পাঠানো শুরু করেছে ইসি।
এর আগে মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রাথমিক শর্ত পূরণ করতে না পারার বিষয়টি সামনে আসার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককেই প্রচার করতে দেখা যায় যে, এনসিপির নিবন্ধন আবেদন বাতিল হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম সচিব আব্দুল হালিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখি প্রথম ধাপে অনেকে শতভাগ শর্ত পূরণ করতে পারে না। সে কারণে প্রাথমিক যাচাই বাছাই শেষে দলগুলোকে ঘাটতির শর্তগুলো পূরণে চিঠি দেওয়া হয়।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, শর্ত পূরণে ১৫ দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। এরপরই শুরু হবে মাঠ পর্যায়ের যাচাই বাছাই কাজ।
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম মুসা বলেন, আমরা আইন অনুযায়ী নিবন্ধনের সব শর্ত পূরণ করেই আবেদন করেছি। ইসি কড়াকড়িভাবে শর্তগুলো দেখলেও আমরা নিবন্ধন পাবো।
নিবন্ধন পেতে গত মাসে যখন এনসিপি আবেদন করেছিল, তখন দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলাও চেয়েছিল। তবে নির্বাচন কমিশন তাদের প্রতীক তালিকায় শাপলা রাখেনি।
এনসিপির অভিযোগ, কোনও একটি রাজনৈতিক দল দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রতীক তালিকায় শাপলাকে রাখেনি।
গত ২০শে এপ্রিল নতুন দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন আহ্বান করে একটি নোটিশ দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। এরপর ৪৬টি দলের অনুরোধে সময়সীমা ২২ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
কেন শর্ত পূরণ করতে পারেনি কোনো দল?
বাংলাদেশের যে কেউ চাইলেই নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেই সবাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এজন্য প্রয়োজন হয় নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন।
নিয়ম অনুযায়ী, নিবন্ধনের আবেদনের পর প্রাথমিক তথ্য যাচাই বাছাই শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর যেসব কাগজপত্রে ঘাটতি থাকে সেগুলো পূরণে দলগুলোকে সময় দেয় নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশনের বেধে দেওয়া সময় ছিল গত ২২ জুন পর্যন্ত। নির্বাচন কমিশনে এই সময়ের মধ্যে যে ১৪৪টি দল নিবন্ধনের আবেদন করে তার মধ্যে কোনো দলই প্রাথমিক শর্ত পূরণ করতে পারেনি।
নিয়ম অনুযায়ী নতুন দলের নিবন্ধনের ক্ষেত্রে দলটির একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয় থাকতে হবে, কার্যকর কমিটি থাকতে হবে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায়, সদস্য হিসেবে অন্তত ১০০টি উপজেলা কিংবা মেট্রোপলিটন থানার কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থনের নথি দেখাতে হবে।
এছাড়াও দলীয় প্যাডে দরখাস্তের সঙ্গে দলের গঠনতন্ত্র, নির্বাচনি ইশতেহার (যদি থাকে), দলের বিধিমালা (যদি থাকে), দলের লোগো ও দলীয় পতাকার ছবি, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সব সদস্যের নামের তালিকা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সর্বশেষ স্থিতি জমা দিতে হবে। আবেদন পাওয়ার পর ইসি তা যাচাই-বাছাই শুরু করে।
গত ২২ জুন নিবন্ধনের সময় সীমা শেষ হওয়ার আগে থেকেই আবেদনকারী দলগুলোর তথ্য যাচাই বাছাই শুরু করে নির্বাচন কমিশন।
গত সপ্তাহে বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন জানিয়েছিলেন, যেসব দলের ডকুমেন্টস এ ঘাটতি রয়েছে তাদেরকে নিয়ম মেনে ১৫ দিন সময় দেবে ইসি। এই সময়ের মধ্যে যারা শর্ত পূরণ করবে না তাদেরকে ইসির আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন দেয়া সম্ভব হবে না"।
এরই মধ্যে প্রথম দফায় মঙ্গলবার ৬২টি রাজনৈতিক দলকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় চিঠি দেওয়া হয়েছে এনসিপিসহ বাকি ৮২টি রাজনৈতিক দলকে।
ইসির যুগ্ম সদস্য সচিব বলেন, তাদের যে কোনো ত্রুটি সংশোধনের জন্যই এই সময়টা দেওয়া হচ্ছে। পর্যাক্রমে সবগুলো দলকে এই চিঠি দেওয়া হবে।
তিনি জানান, বেঁধে দেওয়া এই সময়ের মধ্যেই কেবল যেসব দল ইসির চাহিদা অনুযায়ী শর্তগুলো পূরণ করবে তাদের মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়সহ যাবতীয় তথ্য দ্বিতীয় দফায় যাচাই বাছাই করেই চূড়ান্তভাবে নিবন্ধন দেওয়া হবে।
যেসব শর্ত পূরণ করতে পারেনি এনসিপি
গত জুন মাসে নির্বাচন কমিশনে দল নিবন্ধনের আবেদন জমা দেয় জাতীয় নাগরিক পার্টি। এ সময় তারা জেলা উপজেলায় কমিটির তালিকা, দলীয় সদস্যদের বিভিন্ন তথ্যসহ ৪৩ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্টসও জমা দিয়েছিল।
প্রাথমিক যাচাই বাছাই শেষ মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ জানিয়েছে, প্রাথমিক বাছাইয়ে দলটি উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
এত ডকুমেন্টস ও কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরও কেন এনসিপি প্রাথমিক বাছাই শর্ত পূরণ করতে পারলো না সেই প্রশ্নও সামনে আছে। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নানা খবরও প্রচারিত হয়েছে।
এনসিপি বলেছে, দল নিবন্ধনের সব শর্তই তারা পূরণ করেছে। তবে কিছু কিছু কাগজ একাধিকবার জমা ও কিছু দলীয় সদস্যের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যে ঘাটতি থাকায় সেগুলো পুনরায় চাওয়া হচ্ছে।
এনসিপির নিবন্ধন কমিটির দায়িত্বে রয়েছেন দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম মুসা।
মুসা জানিয়েছেন, এনসিপি যে কাগজপত্র জমা দিয়েছে সে সবের কিছু কাগজে রিপিটেশন হয়েছে, কয়েকজনের এনআইডি নম্বর লেখা নাই, বিভিন্ন জায়গায় ২০০ ভোটারের যে তালিকা তাতে কয়েকজনের এনআইডি নম্বর লেখা নাই।
তিনি বলেন, কিছু জায়গায় ওনারা (ইসি) ক্যালকুলেট করে দেখছে যে এখানে ২০০ ভোটারের তথ্য দিয়েছি তার ৫টি ঠিক হয় নি। এই পাঁচটা বাদ দিয়ে ওনারা বলেছে নতুন করে দিতে বলেছে। এই চিঠিটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। এটা খুব ছোট ছোট অবজারভেশন। আমরা সে সব দ্রুতই ফুলফিল (পূরণ) করে দিবো।
আইনের সকল বাধ্যবাধকতা আমরা পূরণ করেছি। আমাদের বাদ দিতে হলে আইনগতভাবে বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নির্বাচন কমিশনের নাই, যোগ করেন মুসা।
শাপলা নিয়ে রাজনীতি করছে ইসি
গত মাসে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন করে দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা চেয়েছিল এনসিপি। পাশাপাশি কলম ও মোবাইল প্রতীককেও রেখেছিল পছন্দের তালিকায়।
দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা পাওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের সাথে দুই দফায় বৈঠকও করেছে এনসিপির শীর্ষ নেতারা।
কিন্তু গত ১০ই জুলাই নির্বাচন কমিশন তাদের বৈঠকে জানায়, শাপলাকে নির্বাচনি প্রতীক হিসেবে তালিকাভুক্ত করেনি ইসি।
ঐদিনই সাক্ষাৎকারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম নাসিরউদ্দিন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন, শাপলা নিয়েও অনেক যাচাই বাছাই করার পর তারা প্রতীকের তালিকা থেকে শাপলাকে বাদ দিয়েছেন।
তিনি এটিও জানিয়েছিলেন, এনসিপির আগে নাগরিক ঐক্যও একই প্রতীক চেয়েছিল। সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে কোনও দলকেই তারা শাপলা প্রতীক দিচ্ছে না।
ইসি এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে একটি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম মুসা বলেন, সিইসির সাথে সাক্ষাৎ করে আমরা আইনগত নানা দিক তুলে ধরে কমিশনকে বলেছি। ওনারা বলেছেন বিষয়টি তারা পূর্ণবিবেচেনা করবেন।
প্রতীকের তালিকা থেকে শাপলা বাদ দেয়ার বিষয়টিকে রাজনৈতিক হিসেবে দেখছে এনসিপি। তারা মনে করছে কোনও রাজনৈতিক দল থেকে প্রভাবিত হয়েই এনসিপিকে শাপলা প্রতীক দিতে গড়িমসি করছে ইসি।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, নির্বাচন কমিশনের আচরণ নিয়ে শুরু থেকেই নানা প্রশ্ন ছিল। শুরু থেকেই শাপলা নিয়ে রাজনীতি করছে ইসি।
এমআরএম/জেআইএম