শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস
এক সাংবাদিকের শেষ প্রস্থান ও শহীদ সাংবাদিকদের আত্মত্যাগ
১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর দুপুরবেলা বিজয় যখন দুয়ারে কড়া নাড়ছে তখন ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীর ১১৫ নম্বর নিউ সার্কুলার রোডের (বর্তমান শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক) বাসায় তখন এক ভিন্ন চিত্র। সাপ্তাহিক ‘শিলালিপি’ পত্রিকার নির্ভীক সম্পাদক সেলিনা পারভীন তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত। উপরে ছাদে খেলা করছে তার ছোট ছেলে সুমন জাহিদ। হঠাৎ একটি গাড়ির আওয়াজ, তারপর একদল মুখোশধারী আল-বদর কর্মী দরজায় কড়া নাড়ে।
তারা নিশ্চিত হয়, এ-ই সেই ‘শিলালিপি’র সম্পাদক, যার পত্রিকায় দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের লেখা এবং স্বাধীনতার পক্ষের সাহসী বার্তা প্রকাশিত হতো। আল-বদর কর্মীদের হাতে বন্দি হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ছেলে সুমনের মাথায় হাত রেখে সেলিনা পারভীন বলেছিলেন, ‘সুমন তুমি মামার সঙ্গে খেয়ে নিও, আমি যাব আর আসব।’ সেটাই ছিল ছেলের সঙ্গে তার শেষ কথা। তবে তিনি আর ফেরেননি।
চার দিন পর ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তার গুলিতে ও বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত মরদেহ পাওয়া যায়। অত্যন্ত শীতকাতুরে সেলিনা পারভীনের পায়ে তখনও পরা ছিল সাদা মোজা। যা তার মরদেহ শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
এই মর্মান্তিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এবং শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে লিখিত স্মারকগ্রন্থ ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন স্মারকগ্রন্থ’ (সম্পাদনা: সুমন জাহিদ), ‘শহীদ কবি ও সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের জীবন ও মৃত্যু’ (লেখক: শেলী শাহাবুদ্দিন) এবং তার ছেলে সুমন জাহিদের স্মৃতিচারণায় ঘটনাটি বহুবার গণমাধ্যমে এসেছে।
শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের এই ঘটনাটি ছিল ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের করুণ এক প্রতীক।
কেবল তিনিই নন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ ভাগে, বিশেষ করে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে এমন হত্যাকাণ্ড তীব্র আকার ধারণ করে। তালিকা ধরে ধরে দেশের বিশিষ্ট কলমযোদ্ধাদের তাদের নিজ নিজ বাসস্থান থেকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এই নির্ভীক মানুষগুলোকে রায়েরবাজার ও মিরপুরের মতো বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যা ছিল স্বাধীনতার সূর্যোদয়কে ম্লান করে দেওয়ার এক অশুভ পাঁয়তারা।
তাদের আত্মত্যাগ প্রমাণ করে, সাংবাদিকরা কেবল তথ্য পরিবেশক ছিলেন না। তারা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রধান যোদ্ধা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। শুধু হত্যা নয় অনেক সাংবাদিক কারাবরণ ও চরম নির্যাতনের শিকার হন।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, যিনি ১০ ডিসেম্বর অপহৃত হন। একই ভাগ্য বরণ করেন দৈনিক সংবাদের সহযোগী সম্পাদক প্রখ্যাত সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার এবং দৈনিক পূর্বদেশের বার্তা সম্পাদক নিজাম উদ্দিন আহমদ। রয়েছে নারী সাংবাদিকতার জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন সাপ্তাহিক শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদক সেলিনা পারভীন। ২৫ মার্চ রাতে দৈনিক সংবাদ অফিসে অগ্নিসংযোগে নির্মমভাবে নিহত হন সহকারী সম্পাদক শহীদ সাবের।
এছাড়া তালিকায় রয়েছেন দৈনিক পূর্বদেশের সহকারী সম্পাদক আ ন ম গোলাম মোস্তফা, দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব, ক্রীড়া সাংবাদিক এস এ মান্নান (লাডু ভাই), দৈনিক মর্নিং নিউজের সহকারী সম্পাদক আবুল বাশার চৌধুরী, এবং দৈনিক পাকিস্তান পরে বাংলাদেশ অবজারভারের সাব-এডিটর চিশতী শাহ আহমদ হোসেন। ঢাকা ছাড়াও টাঙ্গাইল প্রতিনিধি শিবসদন চক্রবর্তী এবং ঝিনাইদহ প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক শেখ আব্দুল মান্নান সহ আরও অনেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শহীদ হন।
বাংলাপিডিয়া অনুযায়ী মোট ১৩ সাংবাদিকের তালিকা দেখা যায়। যদিও সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে। যারা তাদের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, কলমও হতে পারে স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রতীক। সাংবাদিকরা তাদের কলমকে শোষণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র বানিয়েছিলেন।
তারা জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক খবর বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিয়ে স্বাধীনতার ভিত্তিকে মজবুত করেছিলেন। তাই পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তাদের দোসররা পরাজয় নিশ্চিত জেনে এই কলমযোদ্ধাদের হত্যা করে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে দিতে চেয়েছিল।
১৪ ডিসেম্বর, বাঙালির ইতিহাসে এক গভীর ক্ষতচিহ্ন। যা বিজয়ের প্রাক্কালে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর বেদনাবহ স্মৃতি বহন করে। ১৯৭১ সালের এই দিনটিকে স্মরণে আনলে মনে পড়ে যায় সেই কালো রাতের কথা, যখন কেবল শিক্ষকের হাতে খড়িই নয়। সাংবাদিকের হাতে ধরা কলমটিও স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা।
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের মাধ্যমে আমরা কেবল সেলিনা পারভীন বা সিরাজুদ্দীন হোসেনের মতো কলমযোদ্ধাদের হারানোর শোকই বহন করি না। আমরা তাদের মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সুসাংবাদিকতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার উত্তরাধিকারকে বাঁচিয়ে রাখার অঙ্গীকার করি। তাদের আত্মত্যাগের ঋণ শোধ করার শ্রেষ্ঠ পথ হচ্ছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের মূলস্তম্ভগুলোকে সুরক্ষিত রেখে তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া।
এমডিএএ/এনএইচআর