‘রানা প্লাজার শ্রমিক শুনলে কাজে নিতে চায় না কেউ’

চার বছর ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য ধর্না দিচ্ছেন সাভারের যুবক বাকী বিল্লাহ। যেখানে চাকরি পেতে সবচেয়ে বড় নিয়ামক অভিজ্ঞতা, সেই অভিজ্ঞতাই এখন তার চাকরি না পাওয়ার বড় কারণ। আট বছর আগে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত বাকী বিল্লাহর চাকরি পেতে বড় বাধা ‘রানা প্লাজার শ্রমিক’ পরিচয়।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৮ম বর্ষপূর্ত আজ (২৪ এপ্রিল)।
মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া প্রায় হাজারো শ্রমিকের পরিণতি বাকী বিল্লাহর মতোই। জীবন-জীবিকার সন্ধানে কেউ সাভার ছেড়েছেন। কেউ মুছে ফেলেছেন রানা প্লাজার পরিচয়, আবার চাকরি না পেয়ে তাদের অনেকেই পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছেন। সহায়-সম্বলহীন, শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ এই শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
আহত শ্রমিকরা বলছেন, বিভিন্ন শ্রমিক-মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, পঙ্গুত্ব, অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহতদের কাজে নিতে চায় না অনেক প্রতিষ্ঠান। ‘অযথা ঝামেলা’ এড়াতেই শ্রমিকদের কাজে নিচ্ছে না তারা।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা। ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মানবসৃষ্ট এই দুর্যোগে প্রাণ হারান প্রায় ১২০০ শ্রমিক। মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া হাজারো শ্রমিক নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করার পাশাপাশি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকেই।
রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ৫৭ শতাংশ বর্তমানে বেকার বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাকশন এইড। গত বৃহস্পতিবার এক জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপন করে সংস্থাটি আরও জানায়, বাকি ৪৩ শতাংশ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানে রয়েছেন। সেখানে কম আয়ে জীবন চলা শ্রমিকরা মহামারি করোনার মতো দুর্যোগ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
ভাগ্য পরিবর্তনে কিশোর মোহাম্মাদ বাকী বিল্লাহ ২০০৮ সালে লালমনিরহাট থেকে ঢাকা আসেন। পরের বছরই রানা প্লাজার একটি গার্মেন্টসে মার্কেটিংয়ে কাজ নেন। ২০১৩ সালের দুর্ঘটনায় তার ডান পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় দেড় বছর পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে ইপিজেডের একটি কোম্পানিতে ফেব্রিক ইন্সপেকশন অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু দুই বছর পরে সেখান থেকেও ছাঁটাই হন। ২০১৭ সালের পর থেকে বেকার এই শ্রমিককে প্রত্যেক মাসেই কয়েক হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। এমন দুর্দশায় ছেড়ে গেছে স্ত্রী। তিনি এখন ভাইয়ের কাছে থাকেন। জীবনের কঠিনতম সময়ে পার করেছেন। কিশোর থেকে হয়েছেন যুবক। এখন তার আকুতি কেবল একটি চাকরির।
বাকী বিল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকার তো চাইলে অন্য প্রতিষ্ঠানে এই শ্রমিকদের চাকরি দিতে পারে। অন্য কোনো গার্মেন্টসেও চাকরি দিতে পারে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এই ধরনের কোনো উদ্যোগ নেই। আমার চাকরি দরকার, আমার মতো অনেকের চাকরি দরকার। কিন্তু রানা প্লাজার শ্রমিক শুনলে আর কেউ কাজে নেয় না। তারা বলে রানা প্লাজার লোক ঠিকমতো কাজ করতে পারবে না। একজন সুস্থ লোক যেভাবে কাজ করে, রানা প্লাজার এরা তো সেই সার্ভিসটা দিতে পারবে না। এরা ভেজাল করবে এই বলে চাকরিতে নিতে চায় না কেউ। ইচ্ছা করেই রানা প্লাজার শ্রমিকদের চাকরি দেয় না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার একটা কাজ দরকার, আমাকে এখন কেউ কাজে নিলে যেকোনো কাজ করব।’
শ্রমিকরা বলছেন, রানা প্লাজা ভবনটির ৩য় থেকে ৯ম তলা পর্যন্ত ছিল পাঁচটি পোশাক কারখানা। এতে প্রায় ৪ হাজার পোশাক শ্রমিক কাজ করতেন। ভবন ধসের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংসস্তূপের ভেতরে চাপা পড়েন চার হাজার পোশাক শ্রমিক।
রানা প্লাজার একটি গার্মেন্টসে হেলপার হিসেবে কাজ করতের মধ্যবয়সী শ্রমিক মোহাম্মদ আজিরন। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত এই শ্রমিক এখন আরেক পরিবারের বোঝা।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘কেউ কাজে নেয় না। কাজ না করতে পারলে আর কেমন থাকা যায়? মেয়ের পরিবারে আছি। জামাই ভ্যান চালায়।’
এ প্রসঙ্গে গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি আহসান হাবিব বুলবুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘রানা প্লাজায় চাকরি করেছে এ কারণে কোনো শ্রমিককে চাকরি নিতে চায় না কিংবা চাকরিচ্যুত করে, এর একটা বড় কারণ হলো ধসের পরে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন কিংবা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ বা পরিচয় আছে। আমাদের মালিকরা আসলে চায় যে, শ্রমিকরা যাতে কোনোভাবেই অধিকার সচেতন না হয়। আর রানা প্লাজার এই শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা আছে বা এসব সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে। এজন্য তারা চাকরিতে রাখতে চায় না কিংবা নিতে চায় না।’
বিষয়টির সত্যতা পাওয়া গেছে মালিকদের সঙ্গে কথা বলেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাভারের এক গার্মেন্টস মালিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘অসুস্থ শ্রমিককে কে কাজে নিতে চায়? আপনি নেবেন আপনার প্রতিষ্ঠানে? তারপরেও রানা প্লাজার অনেক শ্রমিক তো কাজ করছে। সবাই কাজ পায় না এটা ভুল কথা।’
চাকরি নেই তাই এলাকা ছেড়েছেন সিংহভাগ শ্রমিক
সেই দুর্ঘটনায় প্রায় দুই হাজার শ্রমিক আহত হন। তাদের মধ্যে অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে। তবে শ্রমিকরা বলছেন, চাকরি না থাকায় অনেকেই ছেড়েছেন সাভার এলাকা।
বাকী বিল্লাহ বলেন, ‘এখন রানা প্লাজায় আহত খুব বেশি শ্রমিক আর সাভারে নেই। তাদের দোকান করে কিংবা গরু কিনে নিজ নিজ এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ঢাকায় থাকলে তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করবে, এই আশঙ্কায় গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তারপরেও প্রায় ৪০০ পরিবার আছে। এই পরিবারগুলো কেউ দোকান করেছে, কেউ চাষাবাদ করছে, কেউবা অন্যের ওপর বোঝা হয়ে আছে।’
মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শ্রমিকরা, চান চিকিৎসা সেবা
আট বছর পরেও দুর্ঘটনার ভয়াবহতা প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায় শ্রমিকদের।
বাকী বলেন, ‘এখন মানসিক ও শারীরিক অনেক সমস্যার মধ্যে আছি। এখনও কোনো বিল্ডিংয়ে উঠতে পারি না। বড় কোনো বিল্ডিংয়ে বা লিফটে উঠতে খুব ভয় লাগে। পায়ের যন্ত্রণা তো আছেই, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে ভুগছি। প্রত্যেক মাসেই দেড় থেক দুই হাজার টাকার ওষুধ লাগে। সরকারের কাছে আমাদের পুনর্বাসনের দাবি তো আছেই। আমরা আজীবন চিকিৎসাসেবাও চাই।’
গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি আহসান হাবিব বুলবুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৪০০ শ্রমিক তো স্থায়ীভাবে পঙ্গু। যাদের হাত, পা, স্পাইনাল কর্ড কেটে ফেলা হয়েছে। আর আহত শ্রমিকদের পাশাপাশি তাদের পরিবার ও মানসিক বিকলাঙ্গতা বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তারা এখনও ট্রমার মধ্যে আছে।’
‘পরিকল্পিত’ হত্যাকাণ্ড, বিচার হবে কবে?
জানা গেছে, রানা প্লাজা ধসের পর আট বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও দায়ীদের বিচারে কোনো অগ্রগতি নেই। এ ঘটনায় করা মূল মামলায় পাঁচ বছর আগে বিচার শুরু হলেও এখনও কোনো সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। ঘটনাকে পূর্বপরিকল্পিত উল্লেখ করে শ্রমিকরা চাইছেন দ্রুত বিচার ও দোষীদের শাস্তি।
এ বিষয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক ফন্টের সভাপতি আহসান হাবিব বুলবুল বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যতম এই শিল্প দুর্যোগের আট বছর হয়ে গেলো। ৫টি কারখানা ও ভবনের মালিক তারা কিন্তু বিল্ডিংয়ে ফাটলের কথা আগেই জানত। আগের দিন ফাটল ধরার কথা জানার পরেও জোরপূর্বক শ্রমিকদের ঢোকানোর কারণে ১১৩৬ জন শ্রমিকের মৃত্যু হলো। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় এটা একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কিন্তু এর কোনো বিচার হয়নি। ভবনের মালিক সোহেল রানা ব্যতীত কেউ গ্রেফতার নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘৫ জন গার্মেন্টস মালিকের কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। তাদের বিচার হয়নি। তাহলে ১১৩৬ মানুষ হারিয়ে গেলো, আরও তিন শতাধিক মানুষ কিন্তু নিখোঁজ। আর ১৪০০ শ্রমিক স্থায়ী পঙ্গু। প্রায় নিহত আহত মিলিয়ে ৩ হাজার মানুষের সব শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু আমরা দেখলাম দায়ী মালিকরা কোন শাস্তি পায়নি। অর্থনৈতিক কোন শাস্তি তাদের হয়নি, তাদের কোনো কারাদণ্ড হয়নি।’
শাস্তি না হওয়াতে এখনো শ্রমিকদের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা দেশের প্রচলিত আইনে দোষীদের বিচার চাই, শ্রমিকরাও তা চায়।’
আহত শ্রমিক বাকী বিল্লাহ বলেন, ‘কোনো কোম্পানি তো ক্ষতিপূরণ দেয় নাই। আর এটার কোনো বিচারও হয় নাই। এটা তো একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ছিল। সরকার মালিকদের থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেবে, সেটাই আমাদের দাবি।’
এসএম/এসএস/জিকেএস