মেট্রোরেল

ভাঙতে হবে মিরপুর অংশের আরও ভবন-দোকান, ক্ষতিপূরণ ১৫০ কোটি

মফিজুল সাদিক
মফিজুল সাদিক মফিজুল সাদিক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০১:০০ পিএম, ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

মিরপুর পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ৮১৭ নম্বর বাসাটি ছিল ফুটপাতের ঠিক পাশেই। এর ঠিক গা ঘেঁষে নির্মিত হয়েছে মেট্রোরেলের স্টেশন। বাসা ও স্টেশনের চিপায় ফুটপাত ধরে যাত্রীদের হাঁটাচলার অবস্থা নেই। বাড়িটির মালিক সফুর উদ্দিন, হাবিবুর রহমান ও এবাদুল হোসেন। চলাচলের সুবিধার্থে বাড়িটি ভেঙে জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। এরই মধ্যে বাড়ি ভাঙার নোটিশও পেয়েছেন মালিক।

অপরপাশে পূর্ব শেওড়াপাড়ার পারিবারিক কবরস্থান। কবরস্থানের গা ঘেঁষে নির্মিত হয়েছে মেট্রোরেলের স্টেশন। এমনভাবে নির্মিত হয়েছে যে সেখানেও ফুটপাতের অস্তিত্ব নেই। মেট্রোরেল স্টেশনের লিফট এবং সিঁড়িও নির্মাণ করা যাচ্ছে না। তাই ভাঙতে হবে কবরস্থান ও এর গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা ভবন-দোকানপাট।

jagonews24

আরও পড়ুন>> ২৯ দিনে মেট্রোরেলের আয় ২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শেওড়াপাড়া স্টেশনের পাশে ১২ ফুট প্রশস্ত ফুটপাত নির্মাণে ১৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণের অনুমতি মেলে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। ২১ মার্চ রাজউকের অনাপত্তিপত্র মেলে। একইভাবে কাজীপাড়া স্টেশন এলাকায় ১৬ শতাংশ, মিরপুর-১০ স্টেশনে আড়াই শতাংশ, মিরপুর-১১ স্টেশনে সোয়া চার শতাংশ, পল্লবী স্টেশনে পৌনে চার শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করা হবে যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যে ওঠা-নামা ও ফুটপাত প্রশস্ত করতে।

উত্তরা উত্তর স্টেশনে ৩৫ শতাংশ জমি অধিগ্রহণে ১৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা এরই মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে। অন্য এলাকার জমির দাম আরও বেশি। উদ্যোগ নেওয়ার পর দুই বছর হতে চললেও শেষ হয়নি অধিগ্রহণ।

আরও পড়ুন>> ঢাকায় পাতালরেল/নির্মাণকাজের উদ্বোধন বৃহস্পতিবার, ব্যয় ৫২ হাজার কোটি টাকা

ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, মোট ৪০ শতক জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এর মধ্যে শেওড়াপাড়ায় সাড়ে ১৮ শতক, কাজীপাড়ায় ১৬, পল্লবীতে দুই এবং মিরপুর-১০ এ আড়াই শতকের মতো। এজন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে ১৫০ কোটি টাকা। উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের দূরত্ব ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এই পথে মোট স্টেশন ৯টি। ২৬ মার্চ ৯টি স্টেশনই চালু করা হবে। সুতরাং, এর আগেই জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করবে ডিএমটিসিএল।

সরেজমিনে দেখা যায়, পূর্ব শেওড়াপাড়ার পারিবারিক কবরস্থানের ঠিক উল্টো পাশে একটি ফার্মেসি বন্ধ। ফার্মেসির প্রবেশদ্বারজুড়ে তৈরি করা হয়েছে মেট্রো স্টেশনের লিফটের অবকাঠামো। ফলে ভাড়া দোকানটি ছেড়ে দিয়েছেন মালিক ইরাব হোসেন। ৫০ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে লোকসান গুনছিলেন তিনি।

jagonews24

আরও পড়ুন>> মেট্রোরেলে যে কারণে যাত্রী কম, শুক্র-শনিবার বাড়ে ভিড়

ইরাব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, প্রায় সাত বছর কষ্ট সহ্য করেছি। এখন মেট্রোরেলের স্টেশনের লিফট আমার দোকানের ঠিক সামনে পড়েছে। ক্রেতা আমার দোকান দেখতেই পায় না। দোকান ভাড়া মাসে ৫০ হাজার টাকা। তাই দোকান ছেড়ে দিয়েছি।

এই ফার্মেসির মতো শুধু শেওড়াপাড়ায় ৫০টির বেশি স্থাপনা রয়েছে। সব ভেঙে ফেলা হবে। এ বিষয়ে নোটিশও দেওয়া হয়েছে। তবে কেউ কেউ ছাড়তে চান না দীর্ঘদিন ধরে যত্নে গড়ে তোলা দোকান। তাদের মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদ রুবেল হোসেন। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে শেওড়াপাড়ায় দোকান দিয়ে সংসার চালান তিনি।

মোহাম্মদ রুবেল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সাত বছর মেট্রোরেল নির্মাণের সময় ধুলা খাইলাম, বালি খাইলাম। এখন মেট্রোরেল চলাচল শুরু করেছে। ধুলাবালি নেই। বেচাকেনাও ভালো। এখন নাকি আবার দোকান ভাঙতে হবে। এটা মালিকানা দোকান। এটা আমরা বেচবো না। ক্ষতিপূরণ না হলে ভাঙতে দেবো না। এত বড় ফুটপাত দিয়ে কী হবে। আমার হিসাবে ভবন-দোকান না ভাঙলেই ভালো।

jagonews24

আরও পড়ুন>> ২৪ বছর অন্ধকারে রাজউকের ৮২৯৫ প্লট, মেট্রোরেল ঘিরে বাড়ছে প্রত্যাশা

সরেজমিনে দেখা যায়, ফুটপাত না রেখেই নির্মিত হয়েছে মেট্রোরেলের স্টেশন। তাই নতুন করে মেট্রোরেল রুটের বেশকিছু ভবন, দোকানপাট ভাঙা ছাড়া উপায় নেই। মিরপুর-১০, পল্লবী, শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়া স্টেশনের মূল কাঠামো ফুটপাতের ওপর। হাঁটার জায়গাও নেই। জায়গার অভাবে শেওড়াপাড়ার এক অংশে সিঁড়ি এখনো বসানো যায়নি।

মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশন ঘেঁষে গড়ে ওঠা দোকানের মালিক সাইমুম হোসেন বলেন, সাতটি বছর কষ্ট করেছি। মেট্রোরেলের খোঁড়াখুঁড়ির কারণে অনেক ক্রেতা হারিয়েছি। নতুন করে সেই সব ক্রেতা ফিরে আসছে কারণ এখন সেই চিরচেনা ধুলোবালি নেই। এখন নোটিশ দিয়েছে দোকান নাকি সরিয়ে নিতে হবে। দোকান কোথায় সরিয়ে নেবো। মেট্রোরেল স্টেশনের ওপর দোকান দেওয়া যাচ্ছে, তাহলে আমাদের সেখানে শিফট করুক। সেই আবেদন করে রেখেছি দেখা যাক কী হয়। আমরা চাইলেই জোর করে এখানে থাকতে পারবো না।

jagonews24

আরও পড়ুন>> মেট্রোরেলে দৈনিক ৩ কোটি টাকা আয় করতে হবে: ডিএমটিসিএল এমডি

ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি লাগবে শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়ার স্টেশনগুলোতে। শেওড়াপাড়া স্টেশনের আশপাশে সরকারি জমি নেই। পশ্চিমপাশে শেওড়াপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও বাটার শোরুমের সামনে সিঁড়ি নির্মাণে পাইলিংয়ের কাজ শেষের পথে। পাইল ক্যাপ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সাত ফুট সিঁড়ি নির্মিত হলে বড় জোর দুই থেকে তিন ফুট জায়গা অবশিষ্ট থাকবে ফুটপাতের জন্য। স্টেশনের পূর্বপাশে যেখানে সিঁড়ি হবে, সেখানে এখনো কাজ শুরু হয়নি। তবে শেওড়াপাড়া কবরস্থানের সামনে সিঁড়ি হলে কোনো জায়গা থাকবে না ফুটপাতে চলাচলের জন্য।

ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা নোটিশ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি। বলেছি আপনারা বাড়ি ও দোকানপাট সরিয়ে নিয়ে যান। সরিয়ে নিলে আমাদের হয়তো ১৫ দিনের একটা কাজ থাকবে। তবে তারা সরিয়ে না নিলে আমাদের অপারেশনে যেতে হবে। দীর্ঘদিন আমরা অপেক্ষা করবো না। মার্চের মধ্যে প্রশস্ত ফুটপাত হবে মিরপুরের রাস্তায়। ২৬ মার্চ সব স্টেশন চালু করবো। তখন আমরা পুরোপুরি অ্যাকশনে যাবো। স্টেশনের পাশে কমপেক্ষ ১২ ফুট জমি অধিগ্রহণ করা হবে। আগামী মার্চের মধ্যেই এ কাজ সম্পূর্ণ হবে।’

ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ বলছে, ব্যক্তিগত গাড়ি নিরুৎসাহিত করতে মেট্রোরেল হচ্ছে। এ যুক্তিতে পার্কিং রাখার প্রয়োজন নেই। স্টেশনগুলো ঘিরে ভবিষ্যতে ট্রান্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) হাব হবে। ভবিষ্যতে স্টেশনমুখী হবে ফিডার সড়কগুলোও। কিন্তু পর্যাপ্ত জমি নেই। স্বল্পসময়ে অর্থাৎ, প্রতি তিন মিনিট পর পর বিপুলসংখ্যক যাত্রী কীভাবে স্টেশনে জড়ো হবেন। আশপাশের এলাকা থেকে স্টেশনে আসার পথ নির্বিঘ্ন না হওয়ায় এত যাত্রী হবে কি না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।

jagonews24

২০১২ সালে অনুমোদিত এমআরটি-৬ প্রকল্পের (উত্তরা-মতিঝিল) নির্মাণকাজ ২০১৬ সালে শুরু হয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে। এরই মধ্যে প্রকল্প ব্যয় ১১ হাজার ৪৮৭ কোটি বাড়িয়ে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবে মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত।

গত ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রুট উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার সাপ্তাহিক ছুটি বাদে ২৯ দিনে টিকিট বিক্রি করে আয় হয়েছে ২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

এমওএস/এএসএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।