চ্যালেঞ্জিং পেশায় তিন জেলায় নারী পুলিশ সুপার

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:০৪ এএম, ০৮ মার্চ ২০২৪

বাংলাদেশ পুলিশে মাঠ পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ পুলিশ সুপার (এসপি)। একজন এসপি জেলা পুলিশের সর্বেসর্বা। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে তিনটি জেলায় তিনজন নারী পুলিশ সুপার রয়েছেন। তারা হলেন- গোপালগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার আল-বেলী আফিফা, শেরপুর জেলা পুলিশ সুপার মোনালিসা বেগম এবং খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার মুক্তা ধর।

পুলিশ বাহিনীতে পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে চলছেন নারীরা। তারা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করছেন বিভিন্ন দায়িত্ব। প্রয়োজনীয় যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে অতিরিক্ত আইজিপি পদেও পদোন্নতি পাচ্ছেন।

কনস্টেবল ও উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদে মাত্র ১৪ জনকে নিয়ে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ পুলিশে নারীর যাত্রা শুরু। সময়ের পরিবর্তনে ২০২৪ সালে এসে সেই সংখ্যা এখন ১৬ হাজার ৮৫৮ জনে। নারী পুলিশ সদস্যরা এখন দায়িত্ব পালন করছেন উচ্চ পর্যায়েও। এ মুহূর্তে উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হিসেবে কর্মরত আছেন বেশ কয়েকজন নারী। অতীতে অলংকৃত করেছেন অতিরিক্ত আইজিপির পদও।

নারীর এ অগ্রযাত্রার পথ একেবারে সহজ ছিল না। মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পারিবারিক নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের। নারী পুলিশ সদস্যদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে এক শ্রেণির পুরুষ কর্মকর্তার অসংবেদনশীলতা এই সমস্যা আরও প্রকট করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ সমস্যা নেই বললেই চলে। পুলিশের নারী সদস্যরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কাজ করছেন বাহিনীতে। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান পরিচালনা থেকে শুরু করে চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উদঘাটনও করছেন তারা।

আরও পড়ুন

মেধা, যোগ্যতা, সাহসিকতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছেন পুলিশের নারী সদস্যরা। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ, দুর্ধর্ষ আসামিদের গ্রেফতার, জলদস্যুদের দমন ও মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নিচ্ছেন তারা। দায়িত্ব পালনকালে জীবনও বিলিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। অগ্রিম গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মোকাবিলায়ও রাখছেন অবদান। কাজ করছেন নারী নির‍্যাতন, পাচার ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, একতরফা তালাকের ক্ষেত্রে দেনমোহর ও খোরপোষ আদায় এবং যৌতুকসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার বিরুদ্ধে। সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখতেও নারী পুলিশ সদস্যদের এখন দেখা যায় সরব ভূমিকায়।

 

পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে গেলে পরিবার থেকে নারীদের দূরে থেকে সেটা করতে হয়। কর্মক্ষেত্রে আমাদের দেশের নারীরা অনেক এগিয়েছেন। আকাশ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে নারীরা কাজ করছেন। সাধারণ মানুষ বর্তমানে নারীদের নেতৃত্বের জায়গায় দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। নারী পুলিশ সুপার হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা ও সংবেদনশীল আচরণ পেয়ে থাকি

 

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করছেন নারী পুলিশ সদস্যরা। সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে। ২০১০ সাল থেকে কঙ্গোতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন পরিচালনা করছেন বাংলাদেশের নারী পুলিশ। সেখানে এ পর্যন্ত এক হাজার ৮০৬ জন নারী পুলিশ কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেছেন।

বাংলাদেশ পুলিশে নারী সদস্যের সংখ্যা
ডিআইজি পাঁচজন, অতিরিক্ত ডিআইজি ৩৯, পুলিশ সুপার ৭৪, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ১১৩, সহকারী পুলিশ সুপার ৭০, ইন্সপেক্টর ১২৭, এসআই ৯৩৩, সার্জেন্ট ৯৪, এএসআই ১১৭৮, এটিএসআই ৩, এএসআই (সশস্ত্র) ৫৬, নায়েক ৪১৬ ও কনস্টেবল রয়েছেন ১৩ হাজার ৭৫০ জন নারী।

পুলিশ সদরদপ্তর জানিয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশে মোট জনবল সংখ্যা এক লাখ ৯৪ হাজার ১৬৯ জন। তাদের মধ্যে নারী পুলিশ সদস্যের সংখ্যা ১৬ হাজার ৮৫৮ জন। এক্ষেত্রে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ নারী।

জানা গেছে, জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এর কলা সেবা সেন্টারের ৮০ ভাগ সদস্যই নারী পুলিশ। সারাদেশের ৯টি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার এবং ৫৫৯টি থানার বেশিরভাগ নারী ও শিশু ডেস্ক পরিচালনা করছেন পুলিশের নারী সদস্যরা। এপিবিএন-১১-তে কর্মরত পুলিশের সব সদস্যই নারী।

গোপালগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার আল-বেলী আফিফা
২০২৩ সালের ৬ জুলাই গোপালগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে আল-বেলী আফিফা যোগদান করেন। তিনি ২০০৬ সালে ২৫তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশে যোগদান করেন। আফিফার জন্ম বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাট উপজেলায় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

আফিফা এর আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও পুলিশ সদরদপ্তর এবং শান্তিরক্ষা মিশনে সাউথ সুদান ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।

২০১৩ সালে ইনভেস্টিগেশন ক্যাটাগরিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘এক্সিলেন্স ইন পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেন আল-বেলী আফিফা। তিনি প্রথম বাংলাদেশি নারী পুলিশ অফিসার যিনি ইনভেস্টিগেশন ক্যাটাগরিতে এ সম্মানজনক পুরস্কার পান।

পুলিশ সুপার আল-বেলী আফিফা জাগো নিউজকে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্মৃতিধন্য গোপালগঞ্জ জেলার অপরাধ প্রতিরোধ, দমন ও সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আমি বদ্ধপরিকর। এ বিষয়ে তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেছেন।

শেরপুর জেলা পুলিশ সুপার মোনালিসা বেগম
২০২৩ সালের ২৬ জুলাই শেরপুর জেলায় প্রথম নারী পুলিশ সুপার হিসেবে মোনালিসা বেগম যোগদান করেন। তিনি ২৫তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশে যোগদান করেন। কিশোরগঞ্জ জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের কৃতি সন্তান তিনি। বর্ণাঢ্য চাকরি জীবনে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদকে (পিপিএম-সেবা) ভূষিত হয়েছেন। শেরপুর জেলায় যোগদানের আগে তিনি পুলিশ সুপার হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) কর্মরত ছিলেন।

সোনালিসা বেগম যদিও হাওরাঞ্চলের সন্তান, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা আর কর্মজীবনে প্রবেশ করায় বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন রাজধানী ঢাকায়। জরুরি মুহূর্তেও নিজের জীবনের পরোয়া না করে মানুষের পাশে থেকে জানমালের নিরাপত্তা দিয়ে অর্জন করেছেন ভূয়সী প্রশংসা।

আরও পড়ুন

২৫তম বিসিএসের টার্গেট নিয়ে জীবনের প্রথম ধাপেই সফল হন মোনালিসা। বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করে প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগে যোগদান করেন। এরপর এক এক করে বিভিন্ন ইউনিটে কাজ করে ভারী করতে থাকেন পুলিশ বাহিনী ও নিজের সুনামের পাল্লা।

নির্ভীক এ পুলিশ সুপার রাজপথে নিজের গাড়ি থেকে নেমে ভোঁদৌড় দিয়েও দেশীয় অস্ত্র আর লাঠিসোঁটাধারী সন্ত্রাসীদের আটক করেছেন নিজ হাতে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে ছিলেন ঢাকার রমনা বিভাগে। জ্বালাও-পোড়াওয়ের ওই সময়গুলোতে নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বারবার পেট্রোল বোমাবাজদের মুখোমুখি হয়েছেন।

 

নারীর এ অগ্রযাত্রার পথ একেবারে সহজ ছিল না। মাঠ পর‍্যায়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পারিবারিক নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের। নারী পুলিশ সদস্যদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে এক শ্রেণির পুরুষ কর্মকর্তার অসংবেদনশীলতা এই সমস্যা আরও প্রকট করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ সমস্যা নেই বললেই চলে। পুলিশের নারী সদস্যরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কাজ করছেন বাহিনীতে

 

দায়িত্বের শুরুতেই ক্ল্যু-লেস হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও সমাধান দিয়েছেন একরাতে। এছাড়াও রেকর্ড রয়েছে একই পরিবারে একই সময়ে একাধিক হত্যার ঘটনার রহস্য উন্মোচন ও জড়িতদের গ্রেফতারের। সেই আসামিদের প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জেলা পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালনে মানুষের কল্যাণে কাজ করছেন মোনালিসা বেগম।

জানতে চাইলে শেরপুর জেলা পুলিশ সুপার মোনালিসা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, পুলিশ সুপার পদটির জন্য নারী কিংবা পুরুষ বিবেচ্য বিষয় নয়। একজন পুরুষ পুলিশ সুপারের যে দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা সেই একই দায়িত্ব একজন নারী পুলিশ সুপারকেও পালন করতে হয়। পুরুষের পাশাপাশি ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় নারীদেরও।

তিনি বলেন, পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে গেলে পরিবার থেকে নারীদের দূরে থেকে সেটা করতে হয়। কর্মক্ষেত্রে আমাদের দেশের নারীরা অনেক এগিয়েছেন। আকাশ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে নারীরা কাজ করছেন। সাধারণ মানুষ বর্তমানে নারীদের নেতৃত্বের জায়গায় দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। নারী পুলিশ সুপার হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা ও সংবেদনশীল আচরণ পেয়ে থাকি।

জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে মাত্র তিনটি জেলায় নারী এসপি রয়েছেন। এটি অনেক কম উল্লেখ করে পুলিশ সুপার মোনালিসা বলেন, ৬৪ জেলায় তিনজন নারী অনেক কম। আরও বেশি জেলায় নারীদের পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব দিলে তারা আরও ভালো করবে। কারণ, এরই মধ্যে জেলা প্রসাশক হিসেবে নারীরা আরও বেশি জেলায় বেশি দায়িত্ব পালন করছেন।

খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার মুক্তা ধর
২০২৩ সালের ৭ আগস্ট খাগড়াছড়ি জেলায় প্রথম নারী পুলিশ সুপার হিসেবে মুক্তা ধর যোগদান করেন। তিনি ২৭তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশে যোগদান করেন। তিনি ২০০৮ সালে ২৭তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে যোগদানের পর থেকে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। পৈতৃক বাড়ি নেত্রকোনায় হলেও জন্মস্থান দিনাজপুরে।

সিআইডিতে বিশেষ পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন একাধিক ক্লু-লেস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনসহ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করেন মুক্তা ধর। সাহসী পুলিশিং কার্যক্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

মুক্তা ধর জাগো নিউজকে বলেন, আমি আমার অবস্থান থেকে পুলিশ বিভাগকে শতভাগ দেওয়ার চেষ্টা করছি। কর্মস্থলের মতো স্বামী-সংসার ও সন্তানের জন্যও দায়িত্ব পালন করি।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক নারী দিবস আমাদের নারীদের জন্য গর্বের। শুধু আন্তর্জাতিক নারী দিবস নয়, প্রতিটি দিনই নারীদের জন্য একটি দিবস। বিশেষ করে এ দিনটি আমি বলবো প্রত্যেক নারীর জন্য গর্ব এবং অহংকারের। এ দিনটিকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করি।

টিটি/এমকেআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।