মানসিক স্বাস্থ্য
সমব্যথী হন নিজের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখুন
গত ১০ অক্টোবর ছিল বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস! বিশ্বজুড়ে দিনটি নানান কর্মসূচিতে পালিত হয়েছে! কিন্তু দিবসকেন্দ্রিক আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না থেকে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় সারাবছর ধরেই কথা বলা উচিত। ১৯৯২ সালে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ "শরীর" এর সাথে "মন"যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেই সত্যটি কঠিন সিদ্ধান্তে বিশ্বময় প্রচারে প্রসারে উদ্যোগী হয়। আর সেই প্রচারণা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে বিশ্বব্যাপী মন ও মননের সুস্থতার সচেতনতায় নানান কর্মসূচির ফলাফল- বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য চিল "পরিষেবা প্রাপ্তি-দুর্যোগ এবং জরুরি পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্য।"। সত্যি সময়ের সাথে উপযুক্ত প্রতিপাদ্য বটে। তবে বাঙালির চিরায়ত বিদ্বেষমূলক আচরণের কারণে এদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কেও যে বিরূপ
প্রভাব পরে সেটা উপেক্ষা করলে চলবে কেন। হালের আমলে সেই হিংসা-ক্ষোভ ব্যক্তি বিদ্বেষের নগ্নতা এতটা বেড়েছে! এসব মানুষের মননে মন হয়ে শরীরে বিরূপ প্রভাব ফেলছে সেই হিসেবটি কাউন্ট হচ্ছে না। বরং নীরবে হিংসার চর্চার সিনিয়র তার জুনিয়র, হীনমন্যতায় আক্রান্ত জুনিয়র ভাবছে সিনিয়র তার যোগ্যতা কাজের দক্ষতায় তাদের পথের কাঁটা হবে এভাবে সময় ও যোগ্যতার মাপকাঠিতে পিছিয়ে থেকেও সকল সুযোগ ও আগে সময়ের আগেই পাবার জন্য সবাইকে পথের কাটা ভেবে হিংসা বিদ্বেষের অসুস্থ চর্চায় কাজে কর্মে, সামাজিক আয়োজনে অনুষ্ঠানে বিরূপ আচরণ করে নিজের মনোদৈহিক অসুস্থতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। পরিস্থিতি এমন প্রিয় বন্ধু হয়েও হিংসার বিসাতিতে বন্ধুত্বের অবমাননা করছে। বন্ধুকে প্রতিপক্ষ ভেবে সুন্দর সাবলীল একটি সম্পর্ক ধরে রাখছে না। এমন ধারার শুধু নিজেকে পেতে হবে আমিত্ব জাহির করতে হবে এমন মানুষেরা সংখ্যা আজকাল চারপাশে। এই তারাই সময় সুযোগ আর সিন্ডিকেট নির্ভর হয়ে নিজের অবস্থার কেবলই মজবুত করার লক্ষ্যে শুধুই ছুটছে!
মনোবিজ্ঞান হিংসার করার পেছনের কারণ দারুণ করে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মনোবিজ্ঞান বলছে হিংসা হল অন্যের গুণাবলি, দক্ষতা, বা সাফল্যের প্রতি নেতিবাচক অনুভূতি। যা নিজের মধ্যে সেগুলোর অভাব অনুভব করলে বা অন্যের কাছে সেগুলোর অভাব দেখতে পেলে সৃষ্টি হয়। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এটি একটি স্বাভাবিক আবেগ হলেও এর নেতিবাচক দিকগুলো ব্যক্তির মানসিক ও সামাজিক জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, যা বিদ্বেষ, লোভ, ও অন্যের ক্ষতি কামনার জন্ম দেয়। মোটা দাগে হিংসাকে কয়েকটি ধাপে ব্যাখ্যা করাই যেতে পারে।
প্রথমত : আবেগপ্রবণতা- হিংসা একটি শক্তিশালী আবেগ, যা মানুষের মনে নেতিবাচক অনুভূতি সৃষ্টি করে, যেমন - অসন্তোষ, হতাশা, এবং অন্যের প্রতি বিরূপ মনোভাব।
দ্বিতীয়ত: সামাজিক তুলনা-মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, হিংসা প্রায়শই সামাজিক তুলনার ফলাফল। যখন আমরা নিজেদের অন্যের সঙ্গে তুলনা করি এবং নিজেদেরকে তাদের চেয়ে পিছিয়ে থাকা মনে করি, তখন এই অনুভূতি জন্মায়।
তৃতীয়ত : নেতিবাচক আচরণের জন্ম: হিংসা মানুষকে অন্যের ক্ষতি করার বা তাদের ধ্বংস কামনা করার দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা সমাজে সংঘাত ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে।
চতুর্থত : আধ্যাত্মিক ক্ষতি: অনেক ধর্মীয় ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে হিংসা একটি আত্মিক ব্যাধি, যা মানুষের ভালো কাজ ও আধ্যাত্মিক উন্নতিকে বাধা দেয়।
গুরুজনেরা বলতেন হিংসা এমন একটি আগুন যে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কারো দেয়া আগুনে নয় নিজের আগুনে নিজেই দগ্ধ হয়।
নিজের প্রতি বিশ্বাসই ব্যক্তিকে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী এবং সময় মত প্রাপ্তির প্রতি বিশ্বাসী ও আত্মনির্ভর করে তুলবে। ফলে আরেকজনের দিকে তাকিয়ে নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে বেশিরভাগ মানুষ যেভাবে অসময় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে মানোবৈকল্যে ভোগেন তার অবসান হবে। নিজে নিজের হিংসা বিদ্বেষমূলক আচরণের কারণে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকিতে ফেলেন এবং সমস্যায়র সাথে লড়াই করে থাকেন এর অবসান হবে।
প্রায় প্রতিটি ধর্মে হিংসা-বিদ্বেষ সম্পর্কে কঠিন ও কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। সনাতন, কিংবা বুদ্ধ ধর্ম সর্বোপরি শান্তির ধর্ম ইসলাসও হিংসাকারীদের সতর্ক করে। বলা হচ্ছে মানুষের চরিত্রে যে-সব খারাপ দিক আছে, তার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ অন্যতম। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষ, ঈর্ষাকাতরতা, কলহ-বিবাদ প্রভৃতি মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনকে বিষময় করে তোলে। যে হিংসা করে, তার অন্তরের শান্তি নষ্ট হয়। আত্মা পূর্ণ হয়ে যায় অশান্তিতে। কলুষিত আত্মা একসময় নিজের প্রতি নিজেকে ঘৃণার উদ্রেক করে।
মানুষের মধ্যে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষের স্থলে সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সতর্ক করে বলেছেন, ‘আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন, সে জন্য কি তারা তাদের ঈর্ষা করে?’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৪)
হিংসা-বিদ্বেষ এক ভয়ানক সংক্রামক ব্যাধি। সম্পদের মোহ ও পদমর্যাদার লোভ-লালসা থেকে হিংসা-বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়। হিংসা-বিদ্বেষ মুমিনের ভালো কাজকে নষ্ট করে ফেলে। তাই নবি করিম (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে নিবৃত্ত থাকবে। কেননা, হিংসা মানুষের নেক আমল বা পুণ্যগুলো এমনভাবে খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়।’ (আবু দাউদ)
হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তিন ব্যক্তির গুনাহ মাফ হয় না, তার মধ্যে একজন হচ্ছে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ–পোষণকারী ব্যক্তি।’ হিংসা-বিদ্বেষের কঠিন পরিণতি সম্বন্ধে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার মানুষের আমলগুলো পেশ করা হয় এবং সব মুমিন বান্দার গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়; কিন্তু যাদের পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ ও দুশমনি আছে, তাদের ক্ষমা করা হয় না।’ (মুসলিম শরিফ)
মনোবিদ সিগমন্ড ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মধ্যে শুধু বেঁচে থাকার প্রবৃত্তিই নয়, ধ্বংসের দিকে যাওয়ার একটি প্রবৃত্তিও কাজ করে। যা "থ্যানাটোস" বা মৃত্যু প্রবৃত্তি হিসেবে কাজ করে। যা ব্যক্তির হিংসা, ঘৃণা, আগ্রাসন এবং আত্মঘাতী আচরণের জন্ম দেয়।
মনোবিদরা এটাও মনে করেন যে, ব্যক্তি তার জীবনের অতীতের সম্পর্ক থেকে মানসিক নির্যাতন বা বিশ্বাসঘাতকতার সম্মুখীন হয়ে থাকেন, তাহলে যদি সেই আঘাত নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতের সম্পর্ক সম্পর্কে সেই ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি নষ্ট হতে পারে। এখানেই ঈর্ষা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। সেই অনুভূতিগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। একারণে ব্যক্তি উদ্বিগ্নও বোধ করতে পারেন। ব্যক্তি নিজের প্রতি একধরণের অমূলক ধারণা তৈরি করে বিদ্বেষ ও ভীতির শিকার হন৷ যা ওই ব্যক্তির নিজের প্রতি অবিশ্বাস আত্মবিশ্বাসহীনতা জন্ম দিয়ে নিজের চারপাশ ও প্রিয়জনকে হারানোর ভয়ও পেতে বসতে পারে। তাই মনোবিদদের মতে হিংসা একটি মানসিক রোগ এই রোগ থেকে মুক্তির জন্য কয়েকটি বিষয়ে ব্যক্তিকে মনোনিবেশ করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
মনোবিদদের বিভিন্ন পরামর্শ ও নানান ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে মানসিক স্বাস্থ্যের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে সচেতন হতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। প্রথমত: ব্যক্তির দক্ষতা, দ্বিতীয়ত: আত্মবিশ্বাস, তৃতীয়ত : চরিত্র, চতুর্থত : সংযোগ এবং পঞ্চমত: নিজের প্রতি যত্নশীলতা।
মনোবিদদের ভাষায় নয় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সংবেদনশীলতা থেকে হিংসা বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকতে নিজের প্রতি যত্নশীলতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায়। ব্যক্তি তার নিজের সম্পর্কে তার দক্ষতা কাজের প্রতি আগ্রহ এবং নিজস্ব বিশ্বাসে যত দৃঢ় হবেন তার ভেতরের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। নিজের সম্পর্কে পজিটিভ মাইন্ডসেট তৈরি হবে। ব্যক্তির নিজের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি খুবই জরুরি। এর জন্য সময়ের সাথে সাথে নিজের কাজে মনোনিবেশ করার পাশাপাশি বাড়তি নানান দক্ষতায় নিজের গুরুত্ব বাড়াতে পারেন। যা ব্যক্তিকে আত্মবিশ্বাসী করবে। ফলে নিজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হবে সেই বোধই ব্যক্তিকে পজিটিভ মাইন্ডসেট আপে চালিত করবেন। আর এই কারণেই ব্যক্তি সময়ের আগে অসময়ে নিজের যোগ্যতার অতিরিক্ত কিছু আশা করবে না। বরং ধৈর্যশীল হয়ে নিজের যোগ্যতাবলেই নিজের প্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা করবেন। আর তখনই সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন।
নিজের প্রতি বিশ্বাসই ব্যক্তিকে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী এবং সময় মত প্রাপ্তির প্রতি বিশ্বাসী ও আত্মনির্ভর করে তুলবে। ফলে আরেকজনের দিকে তাকিয়ে নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে বেশিরভাগ মানুষ যেভাবে অসময় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে মানোবৈকল্যে ভোগেন তার অবসান হবে। নিজে নিজের হিংসা বিদ্বেষমূলক আচরণের কারণে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুঁকিতে ফেলেন এবং সমস্যায়র সাথে লড়াই করে থাকেন এর অবসান হবে।
আর যদি শুধু নিজের আত্মাকে কলুষিত করে অন্যের সাথে নিজের তুলনা করে হীনমন্যতায় ভোগেন তখন কিন্তু ব্যক্তির নিজের কাছেই (হিংসা বিদ্বেষে আক্রান্ত হয়ে) নিজের মনের অজান্তে নিজেকে নানান চ্যালেঞ্জে ফেলবেন। একটা সময় মনে হবে ব্যক্তির নিজের কিছুই কাজ করছে না তখন এই যে নিজের কিছুই হচ্ছে না কাজ করছে না এই চ্যালেঞ্জিং অবস্থা ব্যক্তিকে দারুণভাবে হতাশাগ্রস্ত করবে। ব্যক্তির মনে হতে পারে- ব্যক্তি নিজে এক পরাজিত প্রার্থী। অন্যের সাথে না নিজের অজান্তে নিজের সাথে খেলেই হেরে যাবেন হিংসাকারী ব্যক্তি- আর এই হেরে যাওয়া বোধ থেকেই ব্যক্তির মনে চেপে বসবে হতাশ। সেখান থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হবে বিষণ্ণ বা উদ্বিগ্ন বোধ।
সুতরাং হিংসা নয় আসুন অন্যের সুখে কিংবা দুঃখে সমব্যথী হই। না পারলে অন্যের হিংসা বিদ্বেষ করে করে নিজের আত্মাকে কলুষিত না করি। এরচেয়ে বরং যাকে হিংসা করবেন তা না করে তার ভালো দিকগুলো মনে নিন। অজান্তে ভালো গুণগুলো অনুসরণ করতে পারেন তারপরও যদি হিংসা আসে তখন নিজের সাথে সেই আরেক জন যাকে হিংসা হয় সেই তার সাথে নিজের রূপ, গুণ, সৌন্দর্য, মেধা মনন বা আর বাড়তি কি কি আছে সেই তালিকা করুণ দেখবেন তার-আপনার মধ্যেকার পার্থক্য কতটা এবং কি কি তোন পর্যায়ে। তখন আরেকটি হিসেবে করবেন তার মত হতে পারবেন? যদি না পারেন তবে তো আর কথাই নেই! হাল ছাড়ুন বাস্তবতা মেনে নিজের মনের ওপর অযাচিত চাপ কমান। হিংসা না করে সেই ব্যক্তির পজিটিভ গুণগুলোর প্রশংসা করুন মন খুলে হাঁসুক কথা বলুন দেখবেন নিজের মনের অজান্তের সেই মনের হিংসার বাঘ কাবু হবে। আত্মার শান্তিতে উদার মানবিক ও সংবেদনশীলতার চর্চা করুন দেখবেন বনের বাঘের দেখা পেলেও আক্রান্ত হবেন কি হবেন না সেটা অনিশ্চিত। তবে এটা নিশ্চিত যে "মনের বাঘের" কবলে পরে হিংসার বাঘের আক্রমণে আপনি অন্যের দেওয়া হয় নিজের লাগুনে নিজেই পুড়বেন। আর এই আগুন আপনাকে পুড়িয়ে খাঁটি সোনা নয় পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। সুতরাং সাবধান সমব্যথী হন নিজের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখুন আত্মশুদ্ধির অপার আনন্দে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক।
এইচআর/এমএস