ব্র্যান্ড থেকে রাষ্ট্রনায়ক: ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যতিক্রমী যাত্রা
নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঝকঝকে সোনালি অক্ষরে লেখা ‘ট্রাম্প’ টাওয়ার, বিলাসবহুল হোটেলের লবি কিংবা ক্যামেরার সামনে আত্মবিশ্বাসী এক চেহারা-চোখেমুখে চ্যালেঞ্জের ভাষা। একজন ব্যবসায়ী হয়েও যিনি হয়ে উঠলেন রাষ্ট্রনায়ক, আর একজন রাজনীতিক হয়েও রয়ে গেলেন এক সেলিব্রেটি। ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন এক চরিত্র, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন নতুন দিকে, ছক ভেঙেছেন, নিয়ম ভেঙেছেন, কিন্তু আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ঠিকই থেকেছেন। এক সময় ‘ব্র্যান্ড ট্রাম্প’ ছিল সাফল্যের প্রতীক, পরে সেটাই হয়ে ওঠে এক রাজনৈতিক আদর্শের নাম -যা ঘৃণারও কারণ, আবার ভালোবাসারও। তার জীবন গল্প যেন একটি রিয়েলিটি শো-আশ্চর্য মোড় ঘোরানো, নাটকীয়তা ভরা, আর দর্শকেরা কখনো হাততালি দেয়, কখনো উসখুস করে। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া থেকে
-
১৯৪৬ সালের এই দিনে নিউ ইয়র্ক সিটির কুইন্সে জন্ম তার। জন্মদিন এলেই তার সম্পর্কে আলোচনা শুরু হয় নতুন করে সমর্থকরা বলেন ‘তিনি আমেরিকাকে জাগিয়েছেন’, আর সমালোচকেরা বলেন ‘তিনি বিভাজনের প্রতীক’।
-
ডোনাল্ড ট্রাম্পের শৈশব কেটেছে যুক্তরাষ্ট্রের ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হিসেবে। তার বাবা ফ্রেড ট্রাম্প ছিলেন রিয়েল এস্টেট ব্যবসার কিংবদন্তি। ছোটবেলায় ট্রাম্প ছিলেন কিছুটা চঞ্চল স্বভাবের, তাই পরিবারের সিদ্ধান্তে ভর্তি করা হয় নিউ ইয়র্ক মিলিটারি একাডেমিতে। এখানেই তৈরি হয় তার শৃঙ্খলা, নেতৃত্ব এবং আত্মবিশ্বাসের ভিত।
-
পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ারটন স্কুল থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রি নিয়েই ট্রাম্প প্রবেশ করেন বাবার ব্যবসায়। কিন্তু কেবল উত্তরাধিকার বয়ে বেড়ানো নয়, নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। ম্যানহাটনের উঁচু দালান, ঝাঁ-চকচকে ক্যাসিনো, বিলাসবহুল হোটেল, সবখানে ‘ট্রাম্প’ নামটা হয়ে উঠলো এক ব্র্যান্ড, এক শক্তিশালী পরিচয়।
-
২০০৪ সালে ‘দ্য অ্যাপ্রেনটিস’ নামক রিয়েলিটি শো’র মাধ্যমে ট্রাম্প আমেরিকার ঘরে ঘরে পৌঁছে যান। এই অনুষ্ঠান তাকে করে তোলে এক ‘পপ কালচার আইকন’। ব্যবসার কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া মানুষ হিসেবেই মানুষ তাকে চিনতে শুরু করে। ‘ইউ আর ফায়ার্ড’ এই বাক্যটি হয়ে ওঠে আমেরিকার করপোরেট জগতের এক জনপ্রিয় শব্দবন্ধ।
-
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের পেছনে ফেলে রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ান ট্রাম্প। প্রতিপক্ষ ছিলেন হিলারি ক্লিনটনের মতো হেভিওয়েট প্রার্থী। কিন্তু সব জরিপ ও বিশ্লেষকের হিসাব উল্টে দিয়ে বিজয়ী হন ট্রাম্প। তার নির্বাচনী স্লোগান ‘মেইক অ্যামেরিকা গ্রেট এগেইন’ শুধু একটি বাক্য নয়, ছিল একধরনের জনসংযোগ কৌশল।
-
তার শাসনামল ছিল উত্থান-পতনে ভরা; অভিবাসননীতি, মুসলিম নিষেধাজ্ঞা, চীনবিরোধী অবস্থান, জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা, কিংবা উত্তেজনাপূর্ণ টুইটার বার্তা-সব কিছুতেই তিনি ছিলেন অনন্য, সরব এবং দৃঢ়। অনেকের চোখে তিনি একজন ‘সত্য বলার সাহসী নেতা’, আবার অনেকের মতে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন ও স্বেচ্ছাচারী’।
-
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম উচ্চারণ করলেই আসে বিচিত্র সব বিতর্কের প্রসঙ্গ। নারীদের নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্য, প্রেসিডেন্সি চলাকালীন অভিশংসন প্রক্রিয়া, ক্যাপিটল হিলে সহিংস হামলার ঘটনার পরিণতি-এসবই তাকে করে তোলে ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত রাষ্ট্রপ্রধান।
-
তবে সমালোচনার মাঝেও তার এক অদ্ভুত জনপ্রিয়তা রয়েছে। তিনি যেন আমেরিকার সেই জনগোষ্ঠীর মুখপাত্র, যারা অভিজাত রাজনীতির বাইরে এক ‘নিজের মত’ নেতা চান।
-
ট্রাম্প কেবল একজন রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ীই নন, তিনি নিজেই এক সংস্কৃতি। তার জীবনযাত্রা, পোশাক, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, কথা বলার ধরন সবকিছুই তাকে করে তুলেছে নজরকাড়া। স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প একজন সাবেক মডেল এবং ট্রাম্প পরিবারের পরিচিত মুখ। সন্তানদের নিয়েও নানা সময় আলোচনায় থেকেছেন তিনি।
-
ডোনাল্ড ট্রাম্পের জীবনে নাটকীয়তা যেমন রয়েছে, তেমনই আছে সাফল্যের ছোঁয়া। তিনি দেখিয়েছেন, প্রচলিত ধারা ভেঙেও রাষ্ট্রনায়ক হওয়া যায়। তিনি প্রমাণ করেছেন, মিডিয়া, ব্যবসা ও রাজনীতি এই তিন জগতেই নিজেকে ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। জন্মদিনে তার জীবন যেন একদল মানুষের আশা, আর আরেকদলের আতঙ্ক-এই দ্বৈত বাস্তবতার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।