জীবনের রং

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০৫:৩৪ পিএম, ১১ জুন ২০২২
ম্যাকার্থার পার্কের হেমন্তের ঝরা পাতা

‘এ জীবন কেন এত রং বদলায় কখনো কালো মেঘ কখনো ঝড়ো বেগ কখনও প্রেমের আবেগ এসে নিজেকে জড়ায়’ সিডনির প্রকৃতির রং বদলানো দেখলে বারবার এই গানটার কথা মনে পড়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ার পঞ্জিকা অনুযায়ী চার ঋতু বিদ্যমান। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি গ্রীষ্মকাল, মার্চ থেকে মে শরৎকাল, জুন থেকে আগস্ট শীতকাল আর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর বসন্তকাল।

কিন্তু সিডনির আবহাওয়া এতই বৈচিত্রময় যে বাস্তবে একই দিনে চার ঋতুর দেখা পাওয়া যায়। সকালে বেশ ঠান্ডা, বেলা নটা দশটার পর আবার তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়, বিকেলে আবার হঠাৎ তাপমাত্রা কমে যায়। এর মধ্যেই হয়তোবা এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে যেতে পারে। আবার রাতের বেলায় দেখা যাচ্ছে প্রচন্ড শীত পড়ছে। এভাবেই প্রকৃতির খেলা চলে নিয়ত।

এ বছর অবশ্য সিডনিতে বর্ষার আধিক্য ছিলো। পঞ্জিকাতে বর্ষাকালের কোনো উল্লেখ না থাকলেও একেবারে বাংলাদেশের বর্ষাকালের মতো আকাশে ঘনকালো মেঘ করে দিনের পর দিন বৃষ্টি হয়েছিল। হয়তোবা সামনে আরও হবে। ছোটবেলায় বর্ষাকালে আমরা একটা ছড়া বলতাম, শনির সাত আর মঙ্গলের তিন।

বিজ্ঞাপন

jagonews24সপরিবারে অপু ভাই

এর মানে হচ্ছে শনিবারে বৃষ্টি শুরু হলে সেটা সাতদিন থাকবে আর মঙ্গলবারে বৃষ্টি শুরু হলে সেটা তিনদিন স্থায়ী হবে। কিন্তু সিডনির এবারের বৃষ্টি কখনও সপ্তাহব্যাপী আবার কখনও মাসব্যাপী বর্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশের আষাঢ় শ্রাবণ মাসের বর্ষণের শেষে ভাদ্র মাসের বন্যার মতো বন্যাও হয়েছে বেশকিছু এলাকায়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বর্ষণমুখর গ্রীষ্মের শেষে প্রকৃতিতে এসেছে শরৎ বা হেমন্ত। বাংলাদেশে যেমন শরতে আকাশে সাদা মেঘের ভেলা দেখা যায় এখানেও তাই। আবার হেমন্তের শেষে যেমন গাছের পাতা ঝরতে শুরু করে ঠিক তেমনি এখানেও গাছেদের পাতা ঝরতে শুরু করে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় এই পাতা ঝরে যাওয়ার সময়টায় প্রকৃতি এক বর্ণীল রূপ নেয়। তখন গাছগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় যেন প্রত্যেকটা গাছ যেন এক একটা ফুলের গাছ আর পাতাগুলো সব বাহারি রঙের ফুল।

এভাবে রঙ পরিবর্তনের পাশাপাশি পাতাগুলো ঝরে পড়তে থাকে। তখন গাছের তলায় একটা ফুলেল বিছানা তৈরি হয়ে যায়। কে বলেছে জীবন কুসুম শয্যা নয়। এই সময় আপনি চাইলেই পাতার এই ফুলেল শয্যায় গাঁ এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়তে পারেন।

প্রতি শনিবার সকালে আমাদের ছেলেটাকে একটা ক্লাসে নিয়ে যেতে হয় সিডনির দক্ষিণ পশ্চিমের একটা সাবার্ব ক্যামডেনে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

jagonews24ক্যামডেন ভ্যালি রাস্তার গাছের সারি

ক্যামডেন জায়গাটা এখানকার ভাষায় কন্ট্রিসাইড মানে গ্রাম। অবশ্য আসল কন্ট্রিসাইড আরো দূরে। কিন্তু এই জায়গাগুলোও একটা সময় কান্ট্রিসাইড ছিলো। এখন লোকবসতি বেড়ে যাওয়াতে বর্ধিষ্ণু শহর এইসব গ্রামগুলোকে গ্রাস করে নিচ্ছে কিন্তু এখনও অনেকটাই গ্রামের পরিবেশ বিদ্যমান। বড় বড় ফার্ম হাউস, গবাদি পশুর খামার, ফলের বাগান এখনও আছে। আর আছে জীবনের অন্যান্য সব উপকরণ যেমন পার্ক, গির্জা, গোরস্তান, হাসপাতাল।

ছেলেটাকে নামিয়েই হাটতে হাঁটতে একটু এগুলেই সেইন্ট জনস ক্যামডেন এংলিকান চার্চ। চার্চটা প্রায় দু’শ বছরের পুরোনো কিন্তু পুরোপুরি সচল আছে। এখনো চার্চের দেয়ালের ঘড়িটা ঠিকঠিক সময় দেয়। আর প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় চার্চের ঘণ্টাটাও বেজে উঠে। যত ঘণ্টা ঠিক ততবার চার্চের ঘণ্টাটা বেজে যায়। চার্চের সীমানার মধ্যেই চার্চের সমান বয়সী গোরস্তান। আমি গোরস্তানের কবরের মাঝের হাটার জায়গাগুলো ধরে হাঁটি আর কবরের গায়ে লাগানো নাম ফলকগুলো পড়ি।

বেশিরভাগ নাম ফলকই গৎবাঁধা শুধুমাত্র নাম এবং জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ লেখা। কিন্তু অনেকগুলোর গায়ে সেই ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা। এই গোরস্তান বারবার জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়। চার্চের রাস্তাটা ধরে আরও কয়েক পা এগিয়ে গেলেই রাস্তার উল্টোপাশে ম্যাকার্থার পার্ক। ছোট গোছানো সিমসাম একটা জায়গা।

বিজ্ঞাপন

এটার বিশেষত্ব হলো পার্কটা একটা ঢেউ খেলানো জায়গায় অবস্থিত। নিচু থেকে ধীরে ধীরে একেবারে ওপরে দিকে একটা টিলার ওপরে উঠে গেছে। পুরো পার্কটাজুড়ে বিভিন্ন রকমের গাছ লাগানো। আর কয়েকটা জায়গায় আলাদাভাবে গোলাপের বাগান করা। শীতের সময় গোলাপগুলো ফুটলে চমৎকার দৃশ্যের অবতারণা হয়। এক কোণায় একটু জায়গা আলাদা করে চির সবুজ কিছু গাছ লাগানো আর তার মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটার বাঁধানো পথ।

jagonews24গোরস্তানের উপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে সেইন্ট জনস এংলিকান চার্চের চূড়া

মূল রাস্তা বরাবর পার্কের মধ্যে একটা জায়গা আছে বিশেষ রকম সুন্দর। এখানে মোটামোটা গাছের গুড়ি খুঁটির ওপর আবার ভূমির সমান্তরালে গুড়ি দিয়ে মাচার মতো তৈরি করা। তার উপর জাপানি এস্টেরিয়া গাছ বিছানো। মাচার নিচে বাঁধানো হাঁটা পথ আর একটু পরপর বসার জন্য কাঠের চেয়ার রাখা। এই জায়গাটার মধ্যে দিয়ে হাঁটলে শরীরটা জুড়িয়ে যায়। একটা চমৎকার শীতল অনুভূতি শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনটাকেও শান্ত করে দেয়।

বিজ্ঞাপন

মনে হয় এই রাস্তা ধরে অনন্তকাল হাঁটছি। সেদিন একটা চেয়ারে শুয়ে পড়েছিলাম। মাচার গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্য কিরণ এসে চোখের পাতায় খেলা করছিলো। এরমধ্যে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেরই পাইনি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো চার্চের ঘণ্টা ধ্বনি শুনে। বারোটা বেজে গেছে তাই বারোবার ঘণ্টা বেজে উঠলো।

পার্কের খোলা জায়গার মধ্যে বাচ্চাদের কিছু খেলার সরঞ্জামও আছে। সেখানে মানুষ সপরিবারে এসে সময় কাটায়। বাচ্চারা আসে তাদের দাদা দাদির সঙ্গে। দাদা দাদি শেডের নিচে রাখা চেয়ার টেবিলে বসে পেপার পড়েন বা গল্প করেন আর বাচ্চারা খেলে বেড়ায়। পার্কের একেবারে মাঝ বরবার ইটের সলিংয়ের একটা রাস্তা।

সেই রাস্তার দুইপাশে নিম সদৃশ বৃক্ষের সারি। সেগুলোতে এখন হেমন্তের সময় বিভিন্ন রঙের পাতার বাহার দেখা যায়। এই পাতাগুলোর দিকে একটানা তাকিয়ে থাকলে নিজের মনেই অনেক সময় রাঙিয়ে দেয়। এই পার্কটা যেন জীবনের প্রতিচ্ছবি।

এই পার্কের দেয়ালের পাশেই ক্যামডেন হাসপাতাল। আমি একটা কথা সবসময় বলি আপনি যদি জীবনে অসুখী হন তাহলে একটু সময় করে হাসপাতাল আর রেলস্টেশন ঘুরে আসেন।

বিজ্ঞাপন

jagonews24নারেলান সিমেট্রি

দেখবেন মানুষ শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য কিভাবে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে যাচ্ছে। রেলস্টেশনে উদ্বাস্তু মানুষ জীবনের নূন্যতম প্রয়োজন মিটিয়ে বেঁচে আছে। আবার এই হাসপাতালই যেন জীবন এবং মৃত্যুর এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন রচনা করছে। একজন শিশু ভূমিষ্ঠ হবার মধ্যে দিয়ে জীবনের জয়গান গায় আবার জীবনের শেষ দিনগুলো অনেকেই হাসপাতালে পার করেন।

একদিনে যেমন বাজে নতুন জীবনের আগমনী গান অন্যদিকে বেজে চলে জীবনের বিদায়ের করুণ সুর। আমরা ক্যামডেন এ যায় একটা রাস্তা আর ফিরে আসি অন্য একটা রাস্তা দিয়ে। কারণ এতে করে অনেক নতুন জিনিস দেখা যায়। ফিরে আসার রাস্তাটার এক পাশে সারি করে লাগানো গাছগুলোরও পাতা বাহারি রং নিয়ে ঝরে পড়ছে।

বিজ্ঞাপন

অবস্থাদৃষ্ঠে মনে হয় আপনি যেন কোনো রাজদরবারে যাচ্ছেন আর আপনাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হচ্ছে। এই রাস্তায় একটা জায়গায় আমরা ইচ্ছা করে বাঁক নিই। বাক নিয়ে সামান্য কিছুদূর গেলেই নারেলান সিমেট্রি মানে নারেলান গোরস্তান। এই গোরস্তানে ঘুমিয়ে আছে না কি জেগেই আছেন আমার প্রিয় অপু ভাই।

অপু ভাইয়ের সাথে পরিচয় সিডনি আসার পর। সামান্য পরিচয়েই অনেক আপন করে নিয়েছিলেন। আসলে কিছু মানুষের এই ক্ষমতা থাকে সহজেই মানুষকে আপন করে নেওয়ার। অপু ভাই শরীরে ক্যান্সার নিয়েও অনেকদিন বেঁচে ছিলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে উনাকে দেখে কারোরই বুঝার উপায় ছিলো না যে তিনি শরীরে ক্যান্সারের মতো প্রাণ সংহারী জীবাণু বয়ে বেড়াচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

আমি তাকে দেখেই বুঝেছিলাম আসলে কিভাবে জীবনকে উপভোগ করতে হয়। তিনি এই অবস্থাতেও নিয়মিত বাগান করতেন। বাগানে নতুন কি কি উৎপাদন হলো ফেসবুকে ছবি দিয়ে আমাদের জানাতেন। রাত্রে ‘নাইট কুইন’ ফুল ফুটলে সেটার ভিডিও করে আমাদের দেখাতেন। আমরা আবার সেই ভিডিও দেখে তার বাড়িতে মাঝরাত্রিতে হানা দিতাম।

jagonews24ম্যাকার্থার পার্কের ছায়া শীতল লন

এরপর অপু ভাই মারা আমার এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিলো। যেটা না দুঃখের না সুখের। একটা বিষয়ই শুধু আমাকে প্রতিনিয়ত আঘাত করে যাচ্ছিলো সেটা হলো অপু ভাইয়ের সাথে আমার শেষ দেখাটা হলো না। এরপর যখন তাকে গোসলের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিলো তখন আমি ভেতরে গেলাম। আত্মীয়-স্বজন থেকে মোট তিনজন গোসলের সময় ভেতরে যেতে পারে।

অপু ভাই স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন। মুখে একটা স্মিত হাসি। দেখে মনে হচ্ছিলো তিনি আরাম করে ঘুমিয়ে আছেন। ডাক দিলেই উঠে বসে বলবেনঃ আরে ইয়াকুব কখন আসলে, অবশেষে তোমার সময় হলো। কিন্তু আমি জানি অপু ভাই আর কোনদিনই আমার ডাকে বা মেসেজে সাড়া দেবেন না।

অপু ভাইয়ের মতো একজন প্রাণচঞ্চল মানুষ গত একটা বছর নারেলান সিমেট্রির একটা কবরে স্থির হয়ে শুয়ে আছেন। এর মধ্যেই কত সময় পেরিয়ে গেলো, ঋতু বদল হলো, প্রকৃতি রং বদলালো। কিন্তু অপু ভাই সেই রং দেখতে পেলেন না যেই অপু ভাই প্রকৃতির এই পরিবর্তনগুলো নিবিষ্ঠভাবে লক্ষ্য রাখতেন এবং সেটা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সময়ে সময়ে আমাদের জানতেন।

আমরা তাই ঋতু অনুযায়ী তার জন্য বিভিন্ন রকমের উপহার নিয়ে যায়। জ্যাকারান্ডার মৌসুমে এক গুচ্ছ জ্যাকারান্ডা নিয়ে গিয়ে তার কবরের ওপর ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। বেগুনী রঙের জ্যাকারান্ডাতে পুরো কবরটা চেয়ে গিয়েছিলো। কি চমৎকার দেখাচ্ছিলো। আমার বারবার মনে হচ্ছিলো অপু ভাই হয়তোবা এই বলে উঠবেন, ইয়াকুব কি যে পাগলামো করো না। কিন্তু অপু ভাই আর উঠেন না।

jagonews24
ম্যাকার্থার পার্কের নিম গাছের সারি

প্রকৃতি যেমন রং বদলায় আমাদের জীবনও তেমনি রং বদলায়। জীবন কখনও আনন্দে কৃষ্ণচূড়ার রঙে রাঙিয়ে তোলে। আবার কখনও দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে জ্যাকারান্ডার বিষাদ বেগুনী রঙে নিমজ্জিত হয়। আবার কখনও হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকে ঠিক যেমন শীতের সময় গাছগুলো পাতা ঝড়িয়ে পুনর্জীবনের অপেক্ষায় থাকে কখন আসবে সেই কাংখিত বসন্ত।

যার বাতাসের স্পর্শে, সূর্যালোকের কোমল আদরে আবার সে জীবন ফিরে পাবে। পত্র পল্লবে শোভিত হবে। প্রকৃতির এই খেলা চলে নিয়মিত একেবারে সেই সৃষ্টির আদি থেকে। কিন্তু জীবনের আর রং বদলায় না যদি সে একবার মৃত্যুর কাছে পরাস্ত হয়।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে জীবনের এই রং বদল চলুক কিন্তু সে যেন মৃত্যুর কাছে পরাস্ত না হয় এটাই সবার চাওয়া। কিন্তু এই নশ্বর পৃথিবীতে আমরা মাত্র ক্ষনিকের অতিথি। নতুন কোন অতিথি আসলেই নিজের জায়গা ছেড়ে দিতে হয়।

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com