পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু কাঁচা ইটের মসজিদ
মওলবি আশরাফ
আফ্রিকার প্রাচীন দেশ মালি। তার মধ্যাঞ্চলের মোপতি এলাকায় বানি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর এক আশ্চর্য—‘জেনে জামে মসজিদ’। এই মসজিদ কেবল একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে জেনে শহরের পরিচয়, সংস্কৃতি ও সামাজিক বন্ধন। শহরটি নিজেই মহাদেশের সর্বপ্রাচীন নগরীগুলোর একটি—ইতিহাস বলছে, খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০ সাল থেকেই এখানে মানুষের বসতি ছিল। পরবর্তীকালে ১৬শ শতকে জেনে ইসলামি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে; হাজার হাজার ছাত্র এই শহরে এসে কোরআন ও ফিকহের জ্ঞান অর্জন করত। বর্তমানেও এই শহরটি নানা কারণে বিশেষ গুরুত্ব রাখে।
নির্মাণের ইতিহাস
জেনে জামে মসজিদ প্রথম নির্মিত হয়েছিল ১৩শ শতকে, যখন শহরটি মালি সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত হচ্ছিল। ঐতিহাসিক বর্ণনা বলে, ১২৪০ সালের দিকে মালি রাজা ‘কোই কোনবোরো’ তার পুরনো প্রাসাদের স্থানে মসজিদটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে ১৮৩৪ সালে মুসলিম শাসক আমাদু লোবো মসজিদটি ভেঙে ফেলেন, যুক্তি হিসেবে এটিকে অতিরিক্ত বর্ণাঢ্য ও রাজকীয় বলে উল্লেখ করেন, তার মতে মসজিদ হবে খুবই সাদামাটা, তাতে চাকচিক্য থাকবে না। পরে ১৮৯৬ সালে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনামলে স্থানীয় নির্মাতা ইসমাইল ত্রাওরে পুরনো পরিকল্পনার ধাঁচ বজায় রেখে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ শুরু করেন। ১৯০৬ সালে সেটি আবার ভেঙে পুননির্মাণ করা হয় এবং ১৯০৭-১৯০৯ সালের মধ্যে মসজিদটি আজকের দৃশ্যমান রূপ পায়। যদিও মসজিদের মূল কবরস্থান অংশে এখনও ১৩শ শতকের প্রাচীন স্থাপনা অক্ষত রয়েছে।
আয়তন
মসজিদটি নির্মিত হয়েছে একটি উঁচু বাঁধের মতো প্ল্যাটফর্মের ওপর, যার আয়তন প্রায় ৭৫ মিটার × ৭৫ মিটার। এই উঁচু প্ল্যাটফর্মটি মূলত বন্যার হাত থেকে মসজিদকে রক্ষা করে—কারণ ব্যানি নদী বর্ষায় প্রায়ই প্লাবিত হয়। মসজিদের নামাজঘর পূর্ব দিকে অবস্থিত এবং পশ্চিম দিকে রয়েছে একটি খোলা বিস্তৃত আঙিনা। নামাজঘরের আয়তন আনুমানিক ২৬ মিটার × ৫০ মিটার, আর আঙিনার আয়তন প্রায় ২০ মিটার × ৪৬ মিটার। অভ্যন্তরে রয়েছে বিশালাকৃতির ৯০টি স্তম্ভ, যা ছাদের ভার বহন করে এবং একটি বনের মত স্থাপত্য অনুভূতি সৃষ্টি করে।
স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
জেনে জামে মসজিদকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কাঁচামাটির নির্মাণ স্থাপনা বলা হয়। এখানকার ইট তৈরি করা হয় স্থানীয় ভাষায় পরিচিত ‘ফেরি’ মাটি থেকে—যা খড়, পানি ও নদীর পলি মিশিয়ে সূর্যালোকে শুকানো হয়। সেই মাটিই আবার মর্টার, প্লাস্টার এবং দেয়ালের বাইরের আবরণ—সব জায়গায় ব্যবহৃত হয়। দেয়ালের ওপর থেকে যে কাঠের গুচ্ছগুলো বাইরে বেরিয়ে থাকে—সেগুলোকে বলা হয় ‘তোরণ’। এগুলো শুধু অলংকার নয়, বর্ষিক সংস্কারের সময় এই কাঠগুলোই হয় মাচা। অর্থাৎ মসজিদটি এমনভাবে বানানো হয়েছে, যেখানে সৌন্দর্য ও ব্যবহারিক প্রয়োজন—একটি আরেকটির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে যুক্ত। এ ছাড়াও মসজিদের পূর্বদিকে রয়েছে চোখে পড়ার মতো তিনটি বড় মিনার—যার মাঝেরটি প্রায় ১৬ মিটার উঁচু।
ছবি: সংগৃহীত
শৈল্পিক সৌন্দর্য
জেনে জামে মসজিদের সৌন্দর্য কোনো একক দৃষ্টিকোণ থেকে ধরা যায় না।
প্রথমত, এর গঠন প্রকৃতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। মাটি, পানি, খড়—এ তিন উপকরণ মিলে স্থির, নরম ও ছন্দময় এক পৃষ্ঠ তৈরি করেছে, যা সূর্যের আলোয় দিনে রঙ বদলায়—মাঝে মাঝে সোনালি, কখনও ধূসর, আবার ভোরে হালকা মলিন মাটির মতো ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়। এই পরিবর্তনশীলতা স্থাপনাটিকে জীবন্ত করে তোলে।
দ্বিতীয়ত, মসজিদের ভেতরের আলো-আঁধারির খেলা। নামাজঘরে আলো প্রবেশ করার সুযোগ কম রাখা হয়েছে—ফলে ভেতরে প্রবেশ করলে মনে হয় শান্ত এক ধ্যানঘর, যেখানে দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই মেহরাবের দিকে স্থির হয়। বড় বড় স্তম্ভের পরপর বিন্যাস যেন মানুষের মনকে স্থির করে, চিন্তাকে সুশৃঙ্খল করে।
তৃতীয়ত, মিনারের শীর্ষে থাকা উটপাখির ডিম—যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর শিল্প-অস্তিত্বের প্রতীক। আফ্রিকার সংস্কৃতিতে ডিম হলো জীবনের কেন্দ্র, আকাঙ্ক্ষার শুরু, আবার সুরক্ষার ছায়া। তাই এই ক্ষুদ্র প্রতীকটিও মসজিদের নান্দনিক বোধকে আরও গভীর করে।
স্থানীয় সংস্কৃতিতে ভূমিকা
জেনে জামে মসজিদ শুধু নামাজের স্থান নয়—এটি শহরের সামাজিক বন্ধনের কেন্দ্র। প্রতি বছর যে ‘ফেতে দ্য লা ক্রেপিসাজ’ উৎসব হয়—এতে নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবক, শিশু সবাই অংশ নেয়। একসাথে মাটি মাখা, পানি আনা, দেয়াল মেরামত করা—এসব মিলিত শ্রম মানুষকে একসাথে বেঁধে রাখে। জেনে মসজিদ হয়ে ওঠে সম্পর্ক, স্মৃতি, ঐক্য ও বিশ্বাসের জীবন্ত প্রতীক।
এই মসজিদের স্থাপত্যশৈলী ও সামাজিক ভূমিকার জন্য ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব-ঐতিহ্য ঘোষণা করেছে।
ওএফএফ/জিকেএস