মায়াবী কুহেলিকায় পরিপূর্ণ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ!

সাইদুর রহমান শামীম
সাইদুর রহমান শামীম সাইদুর রহমান শামীম
প্রকাশিত: ০৭:৪৩ পিএম, ১২ অক্টোবর ২০২১

ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা, এমন তত্বে বিশ্বাসীর পাশপাশি অবিশ্বাসীদের সংখ্যাও কম নয়। ক্রিকেটে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় অংকের যোগ-বিয়োগে। প্রতিপক্ষের তুলনায় বেশি রান, উইকেট শিকার বা ক্যাচ ধরেও হেরেছে কোন দল, এমনটি একমাত্র বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে ডি/এল ফর্মুলাতেই সম্ভব।

সোজাসাপ্টা অংকের হিসাব। তুলনায় ফুটবলে অনিশ্চয়তা অনেক বেশি। বল পজেশন, শট অন টার্গেট, অ্যাটাক টু অপনেন্ট, সবকিছুতে যোজন যোজন এগিয়ে থাকা দলও হেরেছে, ফুটবলে এমন নজির অসংখ্য।

পঞ্চাশ দশকে টেস্ট ক্রিকেটে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, কিথ মিলারের অস্ট্রেলিয়া, সত্তর-আশি দশকের ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবা এই শতাব্দীর প্রথম দশকে স্টিভ ওয়াহ’র অস্ট্রেলিয়া দল সর্বজয়ীর স্বীকৃতি আর সাফল্য পেয়েছিলো মাঠের পারফরম্যান্সে।

সেক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা বা দৈবের পক্ষপাতিত্ব ছিলো না বললেই চলে। তাই বলে ক্রিকেটে একেবারেই কী চমক নেই, তা বলা যাবে না। ১৯৮৩’র ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের ইতিহাস গড়া জয়, ১৯৯২’এ পাকিস্তানের অবিস্মরণীয় সাফল্য কিংবা ৯৬’র আসরে লংকানদের বিশ্বজয়ের নেপথ্যে দৈবের প্রশ্রয়, ভাগ্যবিধাতার পক্ষপাতিত্বের অস্তিত্ব অনেকেই দেখেন।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসরটির কথাই ধরা যাক। দক্ষিণ আফ্রিকায় সে আসরে ভারত স্কোয়াড সাজিয়েছিলো সে সময়ের সেরা তিন ব্যাটসম্যান শচিন, দ্রাবিড়, সৌরভকে বাইরে রেখে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাত্র দুই বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মহেন্দ্র সিং ধোনি’কে অধিনায়ক করে সেবাগ, হরভাজন আর যুবরাজ সিং-এর সঙ্গে একঝাঁক তরুণ নিয়ে দল সাজিয়ে যে বাজি ধরেছিলো ভারত, তাতেই বাজিমাত।

তারকাখচিত অস্ট্রেলিয়া, নিজভূমে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড কিংবা পাকিস্তান- কেউই ভারতীয়দের বিশ্বজয়ের অভিযান রুখতে পারেনি। ফাইনালে ভারতের জয়ের নায়ক যোগিন্দর শর্মা কিংবা দলের কোচ লালচাঁদ রাজপুত এক চমকেই ঠাঁই নিয়েছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে।

ক্রিকেট এমনই রহস্যময়ী! মুদ্রার উল্টোপিঠের চমক কম হেঁয়ালির নয়। ২০০৭ সালে শুরুর পর এ পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বসেছে ছয়বার। আফ্রিকা, ইউরোপ, ক্যারিবিয়ান্স, ঢাকা, কলকাতা, কলম্বো সব শহরেই জমেছে বিশ্বকাপের ফাইনাল। বিশ্ব ক্রিকেটের অভিজাত শক্তি অস্ট্রেলিয়া ছয় ফাইনালের একবারও হাসতে পারেনি বিজয়ীর হাসি।

একবার ফাইনাল, তাও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংরেজদের কাছে নাকাল হওয়া। আধুনিক ক্রিকেটের ১৪৪ বছরের ইতিহাসে টেস্ট এবং ওডিআই’তে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দুনিয়া শাসন করেছে বারবার। ওয়ানডে বিশ্বকাপ ট্রফি যাদের শো-কেসে হামেশাই গড়াগড়ি খায় (সর্বাধিক পাঁচবার বিশ্বকাপ জয়, ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ টানা তিনবার কাপ জেতা একমাত্র দেশ)। সেই একই দেশের প্রায় কাছাকাছি ফরম্যাটের টি-টোয়েন্টির বিশ্বকাপে আনাড়িপনা কী প্রমাণ করেনা, ক্রিকেট কখোনো-সখোনো খুবই হৃদয়হীনা!

ক্রিকেটের বিবর্তন, আধুনিকায়ন, প্রযুক্তির সাথে সখ্য, সবকিছুতেই অগ্রপথিক তাসমান পাড়ের অস্ট্রেলিয়া। ভারতের আইপিএলের চাকচিক্য আছে, আছে অর্থ-গ্ল্যামারের অবাধ হাতছানি। স্বীকার না করে উপায় নেই অস্ট্রেলিয়ার বিগ-ব্যাশে প্রতিদ্বন্দ্বীতা, পেশাদারিত্বের আমেজ, ব্যবস্থাপনা, দর্শকদের সমঝদারিত্ব ও সার্বিক পরিবেশ অনেক বেশি ক্রিকেটীয়।

আইপিএল যেমন, তেমনি বিগব্যাশে খেলার সুযোগকে অনেক বিশ্বসেরা ক্রিকেটার মর্যাদার বলে বিশ্বাস করেন। সবকিছু থেকেও যেন অনাথ অস্ট্রেলিয়ার টি-টোয়েন্টি দল। হেইডেন, গিলক্রিস্ট, পন্টিং,অ্যান্ড্রু সায়মন্ডস, ব্রেট লি, ম্যাক্সওয়েল, ম্যাকগ্রা, মাইকেল ক্লার্ক, ওয়ার্নারের মতো দুনিয়া কাঁপানো টি-টোয়েন্টি পারফরমাররা বিশ্বকাপ ছুঁতে পারেনি, ব্যাপারটি বিস্মিত হওয়ার মতোই।

মুদ্রার উল্টোপিঠে ক্যারিবীয়দের সাফল্য সহজাত, সাবলীল। একদার পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘ক্রিকেট-সূর্য’ অস্তমিত হচ্ছে বলে মত অনেকের। জ্যামাইকা, বার্বাডোজ, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো, সেন্ট লুসিয়া দ্বীপে জন্ম নেয়া অমিত প্রতিভাবান ক্রিকেটাররা ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামে রাষ্ট্র কাঠামো-বিহীন দলের হয়ে খেলতে অনুপ্রাণিত হন না, এটা পুরোনা খবর।

ক্রিস গেইল, পোলার্ড, নারাইন, রাসেল, ব্র্যাভোদের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলার চেয়ে বছর জুড়ে দেশে বিদেশে ঘুরে ফ্রাঞ্চাইজি লিগ খেলা অনেক বেশি আকর্ষণের। এজন্য অনেকেই,‘চার-ছক্কার ফেরিওয়ালা’ কিংবা ‘মার্সেনারি’র মতো আদুরে নামে ক্যারিবীয় তারকাদের ডাকেন।

সেই ফেরিওয়ালারা দু’সপ্তাহের জন্য একাট্টা হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছে দু’দুবার। ক্যারিবীয় ক্রিকেটারদের সামর্থ্য এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতি ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা জানিয়েও বলা যায় টেস্ট কিংবা ওডিআই’তে উদ্দীপ্ত না হলেও, টি-টুয়েন্টি এমনই এক যাদু, যা আটলান্টিক পাড়ের সৈকতে বেড়ে ওঠা প্রকৃতির সন্তানদের সর্বস্ব উজাড় করে দিতে প্রেরণা যোগায়।

টি-টোয়েন্টির উদ্দামতা, রোমাঞ্চের সাথে ক্যারিবীয়দের জীবন দর্শন মিলেমিশে একাকার হয় বলেই এটা সম্ভব। টেস্ট বা ওডিআইয়ের তুলনায় বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টি ম্যাচের দৈর্ঘ্য কম, অনিশ্চয়তা, উত্তেজনা বেশি, রোমাঞ্চ অফুরান। সাসপেন্স-থ্রিলার আছে বলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বরাবরই তরুণ ক্রিকেটারদের দক্ষতা প্রমাণের মঞ্চ।

২০০৭ ’র প্রথম আসরে ইংলিশ পেসার স্টুয়ার্ট ব্রডের এক ওভারে ছয় ছক্কা মেরে সে সময়ের ২৫ বছর বয়সী ভারতীয় অলরাউন্ডার যুবরাজ সিং রাতারাতি পেয়েছিলেন বিশ্বখ্যাতি। ১২ বলে তার হাফ সেঞ্চুরির বিশ্বরেকর্ডটি এখানো অটুট। ২০১৬’র কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ইংল্যান্ডের সুপার থ্রিলিং ফাইনালের কথা মনে হলে চোখের সামনে ভেসে উঠে ক্যারিবীয় অলর্উান্ডার কার্লোস ব্র্যাথওয়েটের পরপর চার বলে চার বিশাল ছক্কার অবিস্মরণীয় সুখস্মৃতি।

শেষ ওভারে জয়ের জন্য ১৯ রান চাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের। ইংলিশ বোলার বেন স্টোকসের সামনে ব্যাট হাতে অখ্যাত ক্যারিবীয় তরুণ ব্র্যাথওয়েট। প্রথম চার বলের চার ছক্কায় কেল্লাফতে। কলকাতার আকাশে ক্যারিবীয়দের জন্য একাদশীর চাঁদ উঠেছিলো সে রাতে।

২০১২’র পর আবারো টি-টোয়েন্টির বিশ্বকাপ গেলো আটলান্টিকের পাড়ে। শুধু ব্যাটসম্যান নয়, টি-টুয়েন্টির বিশ্বকাপ আসরকে নিজেদের বোলিং দিয়ে স্মরণীয় করে রেখেছেন উপমহাদেশের দুই বোলার পাকিস্তানের উমর গুল ও শ্রীলংকার রঙ্গনা হেরাথ।

২০০৯-এর আসরে মাত্র তিন ওভারে ৬ রানে পাঁচ ব্ল্যাক ক্যাপস উইকেট নেন পাকিস্তানি পেসার উমর গুল। ৯৯ রানে অলআউট হওয়া নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৬ উইকেটের সহজ জয় পাকিস্তানকে শেষ পর্যন্ত ২০০৭’র আসরের ফাইনালে ভারতের কাছে হারের দু:খ ভূলিয়ে দেয় প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ে।

২০১৪’র বাংলাদেশে আয়োজিত বিশ্বকাপ আসর দেখেছিলো শ্রীলংকান স্পিনার রঙ্গনা হেরাথের ‘ঘূর্ণি-যাদু’। মাত্র ২১ বলের স্পেলে এই বাঁ-হাতি স্পিনার ৩ রানে নেন পাঁচ উইকেট। তাতেই ব্ল্যাক-ক্যাপস ধ্বসে পড়ে ৬০ রানে। ৫৯ রানের এই বিশাল জয় শেষপর্যন্ত শ্রীলংকার কাপ জেতায় রাখে অবদান।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম জয় আসরে বাজিমাত করেছে পাঁচ দেশ। এরমধ্যে আছে উপমহাদেশের তিন ক্রিকেট পাগল জাতি ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা। প্রতিবেশীর সাফল্যে অনুপ্রেরণা খুঁজে পেলে লাল-সবুজের পক্ষেও বিশ্বজয়ের খেতাব জেতা অসম্ভব নয়।

২০০৭-এর ভারত যদি বিশ্বকাপ জিততে পারে তাহলে ২০২১’র বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন দেখা দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চার কিংবা আকাশকুসুম কল্পনা নয়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাস ও পরিসংখ্যান বরাবরই তারুণ্যকে স্বাগত জানিয়েছে, অনুপ্রাণিত করেছে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো অভিজাত পরাশক্তির বিপক্ষে সিরিজ জয় ‘টিম-টাইগার্স’কে’ নতুন ইতিহাস গড়া অনুপ্রেরণা যোগাবে, এমন স্বপ্ন দেখছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ।

আইএইচএস/

তাই বলে ক্রিকেটে একেবারেই কী চমক নেই, তা বলা যাবে না। ১৯৮৩’র ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের ইতিহাস গড়া জয়, ১৯৯২’এ পাকিস্তানের অবিস্মরণীয় সাফল্য কিংবা ৯৬’র আসরে লংকানদের বিশ্বজয়ের নেপথ্যে দৈবের প্রশ্রয়, ভাগ্যবিধাতার পক্ষপাতিত্বের অস্তিত্ব অনেকেই দেখেন

উপমহাদেশের তিন ক্রিকেট পাগল জাতি ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা। প্রতিবেশীর সাফল্যে অনুপ্রেরণা খুঁজে পেলে লাল-সবুজের পক্ষেও বিশ্বজয়ের খেতাব জেতা অসম্ভব নয়

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।