অর্থাভাবে পান্তা খাওয়া সুরেশ এখন দেশসেরা কৃষক

আরিফুর রহমান আরিফুর রহমান , জেলা প্রতিনিধি, খুলনা
প্রকাশিত: ০৫:২৭ পিএম, ২২ এপ্রিল ২০২৫
একজন সফল কৃষক সুরেশ্বর মল্লিক/ছবি-জাগো নিউজ

অর্থাভাবে একসময় নিয়মিত খেতেন পান্তাভাত। তাই পড়াশোনা বেশি দূর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। নবম শ্রেণির পাঠ চুকিয়ে কৃষিকাজ শুরু করেন সুরেশ্বর মল্লিক। এরপর আর নেননি বিরতি। প্রায় ৩০ বছর ধরে করেছেন কৃষিকাজ। সেই সুরেশ এখন দেশসেরা কৃষক। পেয়েছেন কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এআইপি) সম্মাননা।

আধুনিক কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে সবজি উৎপাদনে খুলনার ডুমুরিয়া এলাকায় রয়েছে সুরেশের ব্যাপক পরিচিতি। একই জমিতে বিষমুক্ত সাথি ফসল উৎপাদন করে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার করেছেন। কৃষিকাজে অর্জন করেছেন জাতীয় পুরস্কার। তার কৃষিজমিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে বেকারদের।

অর্থাভাবে পান্তা খাওয়া সুরেশ এখন দেশসেরা কৃষক

সুরেশ্বর মল্লিক খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার কাঠালতলা এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। তার চার বোন। বোনদের বিয়ে হয়েছে। এখন বাপের রেখে যাওয়া ভিটেবাড়িতে মা, স্ত্রী ও দুই ছেলে সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন।

কৃষক সুরেশ্বর মল্লিক জানান, তার বাবা অধির মল্লিক কৃষিকাজ করতেন। ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। এরপর থেকে পরিবারের হাল ধরতে কৃষিকাজ শুরু করেন তার মা। মাকে সাহায্য করতে সুরেশ্বর মল্লিকও শুরু করেন কৃষিকাজ। ১৯৮৪ সালে প্রায় এক বিঘা জমি বর্গা নিয়ে শাকসবজি চাষ শুরু করেন তিনি। তখন তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র। তারপর থেকে প্রায় ৩০ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন প্রায় ৯ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে শাকসবজি চাষ করছেন সুরেশ্বর মল্লিক। লালশাক, বেগুন, করলা, শিম, কুমড়া, মিষ্টি আলু, হলুদ, আদাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করেন তিনি।

অর্থাভাবে পান্তা খাওয়া সুরেশ এখন দেশসেরা কৃষক

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সুরেশ্বর মল্লিককে। এখন বারো মাস শাকসবজি উৎপাদন করেন। কৃষিকাজে তিনবার পেয়েছেন পুরস্কার। ২০১৭ সালে নিরাপদ বীজ উৎপাদনে, ২০১৯ সালে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে এবং ২০২৪ সালে ‘কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ বা অ্যাগ্রিকালচারালি ইম্পর্ট্যান্ট পারসন (এআইপি) কৃষি পুরস্কার পান তিনি। তার কৃষিজমিতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৮-১০ জনের।

আলাপকালে সুরেশ্বর মল্লিক বলেন, ‌‘একটা সময়ে অর্থাভাবে দিন কাটাতে হয়েছে। রাতে লবণ আর পানি দিয়ে ভাত ভিজিয়ে রেখে সকালে তা খেয়েছি। অনেক কষ্টে দিন কেটেছে আমাদের। নিজের জমি না থাকায় অন্যের জমি বর্গা নিয়ে কৃষিকাজ করেছি। এখন স্বাবলম্বী হয়েছি। বড় ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। ইচ্ছা আছে ছেলেরা কৃষি অফিসার হবে।’

অর্থাভাবে পান্তা খাওয়া সুরেশ এখন দেশসেরা কৃষক

তিনি বলেন, বাবা হারানোর পর আমার মা অনেক কষ্ট করেছেন। আমার ইচ্ছা হতো কৃষিকাজে বিধবা নারী আর বেকার যুবকদের সঙ্গে নেবো। এখন এরকম প্রায় ৮-১০ জনকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করছি। কৃষিকাজে আধুনিক কৌশল প্রয়োগের বিষয়ে অনেক প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আধুনিক কৌশলগুলো অবলম্বন করে আরও উন্নতভাবে কৃষিকাজ করতে চাই। এখন ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি বীজ উৎপাদনের জন্য কাজ করছি।

কৃষিকাজে সম্পৃক্ত অন্যদের উদ্দেশে সুরেশ্বর মল্লিক বলেন, কীটনাশক প্রয়োগ মানুষসহ সব প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। প্রাকৃতিক উপায়ে খাদ্য উৎপাদন করা গেলে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর প্রাণ বাঁচবে। পরিবেশের ক্ষতি কম হবে। এজন্য কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে তা ফসল উৎপাদনে প্রয়োগ করলে সবার জন্যই লাভজনক হবে।

কথা হয় এনামুল শেখ নামের স্থানীয় একজন কৃষকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি সুরেশ্বর দাদার সঙ্গে প্রায় ১০ বছর কাজ করছি। তার কাছ থেকে কৃষিকাজে আধুনিক কলাকৌশল বিষয়ে অনেক কিছু জেনেছি। তিনি অনেক পরিশ্রমী মানুষ। সারাদিন কৃষিকাজ নিয়েই পড়ে থাকেন।’

অর্থাভাবে পান্তা খাওয়া সুরেশ এখন দেশসেরা কৃষক

স্থানীয় পরিমল গোলদার বলেন, ‘সুরেশ্বর অনেক পরিশ্রমী। তার কৃষিকাজের সফলতা দেখে অনেক মানুষ তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আসেন। এটা আমাদের এলাকার জন্য গর্বের বিষয়।’

ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার ইনসাদ ইবনে আমিন বলেন, সুরেশ্বর মল্লিক একজন প্রগতিশীল মানুষ। মনপ্রাণ দিয়ে তিনি কৃষিকাজ করেন। যথেষ্ট পরিশ্রমী। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার বিষয়ক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে তিনি ফসল উৎপাদনে তা প্রয়োগ করছেন। সফলও হয়েছেন।

এসআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।