জলবায়ু বিপর্যয়ে কখনো পুড়ছে কখনো ডুবছে সিলেট
একদিন বৃষ্টি হলে পরদিন তীব্র গরম। আবার কখনো টানা ১৫ দিন বৃষ্টি, পরের পনেরো দিন আবার গরম। গত কয়েক বছর ধরেই সিলেটের প্রকৃতিতে এই খেয়ালিপনা চলছে। প্রকৃতির নিয়মে হচ্ছে না বৃষ্টিপাত। স্বাভাবিক থাকছে না দিনের তাপমাত্রাও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর অতিপরিবর্তনের কারণে প্রকৃতিতে বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। যার জন্য দায়ী মানুষের অতিমাত্রার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। গত ৩০ বছরে ভূমি ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যার কারণে প্রকৃতি বিরূপ আচরণ করছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে মানুষকেই।
প্রকৃতির এমন ছন্দপতনে বদলে যাচ্ছে বৃষ্টিপাতের মৌসুমও। ঋতু পরিক্রমায় জুন, জুলাই ও আগস্ট বর্ষাকাল। এই সময়ই বৃষ্টিপাতের ভরা মৌসুম। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে প্রকৃতি এই নিয়ম না মেনে মৌসুমের আগেই অধিক বৃষ্টি ঝরছে। অর্থাৎ প্রাক মৌসুমেই স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে সিলেটে।
জলবায়ুর অতিপরিবর্তনের কারণে সিলেটের প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসলেও বদলাচ্ছে না নীতিনির্ধারকদের নীতি। পরিবেশ রক্ষা না করে নদী ও হাওরগুলোকে অতিশাসনের কারণে বিপর্যয় ডেকে আনা হচ্ছে। ২০২২ ও ২০২৪ সালের বন্যা যার অন্যতম দৃষ্টান্ত।
আগাম বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, উজানের ঢলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় নজিরবিহীন ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে সিলেটকে। ২০২২ সালে বন্যার তীব্রতা বেশি হলেও তার দিগুণের চেয়েও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২০২৪ সালের বন্যায়। দুই বছরে বন্যায় প্রায় ২ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার ক্ষত এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি সিলেট।
অবাক হওয়ার মতো তথ্য, দফায় দফায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সরকারের উল্লেখযোগ্য কোনো বরাদ্দ নেই। উল্টো বন্যা থেকে বাঁচতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কোটি কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিলেও বাস্তবে এসবের কোনো সুফল মিলছে না। বন্যার ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে সর্বশেষ সিলেট সিটি করপোরেশনের ৪৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঝুলে আছে মন্ত্রণালয়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক তদারকি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে মেগা প্রকল্পগুলো দীর্ঘমেয়াদি সুফল বয়ে আনছে না। এজন্য বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ার চেয়ে প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে।
বৃষ্টিপাতের মৌসুম পাল্টাচ্ছে
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. মো. আনেয়ারুল ইসলাম বলেন, উত্তরপূর্বাঞ্চলের জেলা সিলেটে বৃষ্টিপাতের কারণ হলো উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ু। এই বায়ু বঙ্গপসাগর থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প বহন করে নিয়ে আসে। মেঘালয় পাদদেশে ঘনীভবন ঘটিয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়।
তিনি বলেন, মৌসুমি বায়ু কত আগে আসবে সেটা নির্ভর করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতার ওপর। সমুদ্রপৃষ্ঠ মার্চ-এপ্রিল মাসে প্রচুর সূর্যালোক গ্রহণ করে বিপুল পরিমাণ জলীয় বাষ্প দেয়। সেই জলীয় বাষ্প বাতাসে নিয়ে এসে আমাদের এখানে বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে। মৌসুমি বায়ু আগে ভাগে চলে আসায় সিলেটে আগাম বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
বিগত ৫ বছরের সিলেটের বৃষ্টিপাতের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বষ্টিপাতের মৌসুমে বেশ পরিবর্তন ঘটেছে। ঋতু পরিক্রমায় মূলত জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে বৃষ্টিপাতের ভরা মৌসুম থাকলেও এর আগের দুই মাসে মৌসুমের ৩০ শতাংশ বৃষ্টি ঝরে। এপ্রিল-মে মাসে সিলেটে গড় বৃষ্টিপাত ৩৭৫ ও ৫৬৯ মিলিমিটার। কিন্তু কোনো বছর ঝরছে তার অর্ধেক। আবার কোনোবার স্বাভাবিকের দিগুণ বৃষ্টিপাতও হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০২০ সালে সারাবছর সিলেটে ৩২৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তার মধ্যে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে ৯০৭ মিলিমিটার রেকর্ড করা হয়েছে। এই দুই মাসের বৃষ্টিপাতকে আগাম বৃষ্টিপাত বলা হয়। পরের ৪ মাসে অর্থাৎ জুন-সেপ্টেম্বর মাসে বৃষ্টির মৌসুমে বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৬০৪ মিলিমিটার। এই হিসেবে মৌসুমের বৃষ্টিপাতের ৩৪ শতাংশ বৃষ্টি আগের তিন মাসে ঝরেছে।
এর পরের বছর ২০২১ সালে সিলেটে ৩৩০৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। তার মধ্যে আগাম বৃষ্টি হয়েছে ৫৬০ মিলিমিটার। ওই বছর বর্ষা মৌসুমে ২৪৯৫ মিলিমিটার।
- আরও পড়ুন
- জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য সংকটে হুমকিতে সুন্দরবনের বাঘ
- স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড সিস্টেম চালু হলে উপকূলীয় কৃষির ক্ষতি কমবে
- জলবায়ু পরিবর্তনের দায়ে অন্য দেশের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে
২০২২ সালে সিলেটে ৫১১৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তারমধ্যে আগাম বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে ১২৬৮ মিলিমিটার। আর ভরা মৌসুমে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৩৪৬৮ মিলিমিটার।
২০২৩ সালে ৮১৭ মিলিমিটার আগাম বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৩৭০৮ মিলিমিটার। ওই বছর ৫৩১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
২০২৪ সালে সিলেটে আগাম বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১৩৭৮ মিলিমিটার। একই বছরে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৪৩১৫ মিলিমিটার। ওই বছর সবমিলিয়ে ৬১৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে আবহাওয়া অফিস।
শাবিপ্রবির অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, মাটিতে যে সূর্যের আলো পড়ে তা জলাভূমি ও গাছপালা কিছুটা শোষণ করে নেয়। কিন্তু জলাভূমি ধ্বংস ও গাছপালা কেটে ফেলায় সেই তাপমাত্রা সরাসরি ফিরে যাচ্ছে। এতে বায়ু গরম হয়ে যাচ্ছে। যখন প্রচুর মেঘের ভেতরে গরম বায়ুর সংঘর্ষ হচ্ছে, তখন বজ্রপাত হচ্ছে। প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে। হাওরে বজ্রপাতের অন্যতম কারণ হলো স্থানীয় পরিবেশের সূর্যের আলো ধারণ করার মতো ক্ষমতা নেই। যার কারণে ১৫ দিন তাপমাত্রা খুব বেশি থাকে আবার ১৫ দিন বৃষ্টি হয়।
তিনি আরও বলেন, শহরগুলো ‘হিট আইল্যান্ড’ হয়ে গেছে। তাপমাত্রা বসার জায়গা নেই। নগরে গড়ে ওঠা উঁচু উঁচু দালান ও এসিগুলোর আউটলেট বাইরে থাকায় সবসময় তাপমাত্রা গরম থাকছে।
দুই বছরে বন্যায় ২৮৩৬ কোটি টাকার ক্ষতি, নেই বরাদ্দ
২০২২ ও ২০২৪ সালে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সিলেট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, দুই বছরে দফায় দফায় বন্যায় ২ হাজার ৮৩৬ কোটি ৯৭ লাখ ২৪ হাজার ৯০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এরমধ্যে ২০২২ সালের বন্যায় ১ হাজার ২৩৮ কোটি ৬৬ লাখ ২৫ হাজার ৮৮৪ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তারমধ্যে ১৩টি উপজেলা ও তিনটি পৌরসভায় ১ হাজার ৩৯ কোটি ৭৬ লাখ ২৫ হাজার ৮৮৪ টাকা ও সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৯৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার।
২০২৪ সালের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায় দিগুণ। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তথ্যমতে ২০২৪ সালের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ৫৯৮ কোটি ৩০ লাখ ৯৮ হাজার ২০৬ টাকা। এ বছর তিন দফা বন্যায় আক্রান্ত হয় সিলেট।
ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় জানায়, প্রথম দফা বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩৪১ কোটি ৪৯ লাখ ১২ লাখ ৩০১ টাকা, দ্বিতীয় দফায় ১২৩৬ কোটি ৩০ লাখ ৫২ হাজার ৩৬৫ টাকা ও ৩য় দফায় ২০ কোটি ৫১ লাখ ৩৩ হাজার ৫৪০ টাকা।
তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কৃষি ও মৎস্য খাতে। কৃষি খাতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকার, ৫০ হাজার ৪৫৩টি গভীর ও অগভীর নলকূপ সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়াও কয়েক লাখ শৌচাগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সীমা রানী বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি পোষাতে আলাদা কোনো বরাদ্দ আসেনি। বন্যার সময় চার উপজেলায় ১ হাজার ৭৯৭ কেজি পোনা বিতরণ কর্মসূচির জন্য ৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। পরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ২১৬ জন চাষির মধ্যে এই টাকা বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের বন্যার পর কোনো বরাদ্দ আসেনি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম বলেন, ২০২২ ও ২৪ সালে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার পুনর্নির্মাণে জরুরি সহায়তা প্রকল্পের (জিওবি-এডিবি) আওতায় ২৮০০টি পানির উৎস (টিউবওয়েল ও পাম্প) এবং ২৬টি পাবলিক টয়লেট বরাদ্দ। তাছাড়া আর কোনো বরাদ্দ নেই।

সিলেট জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল কুদ্দুস বুলবুল জাগো নিউজকে বলেন, আমরা শুধু বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। এর প্রেক্ষিতে বরাদ্দ আমাদের কাছে আসে না। সংশ্লিষ্ট বিভাগে বরাদ্দ পাঠানো হয়।
পাউবোর শত শত কোটি টাকার প্রকল্প, সুফল নেই
সিলেটে বন্যার জন্য বরাবরই দায়ী করা হয় ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারাকে। প্রতিবছরই সুরমা-কুশিয়ারার ডাইক ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়। এছাড়াও হাওর, নদী ও খালগুলোকেও দোষারোপ করা হয়। কিন্তু এসব নদী ও হাওরের উন্নয়নে বিগত ১৫ বছরে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১০ বছরে নদী, খাল ও জলাশয় খনন এবং হাওর এলাকায় আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশনে ৫টি প্রকল্পে ৪৯৩ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো সুফল ভোগ করছে না মানুষ।
সর্বশেষ সুরমা নদীর উৎসমুখ আমলশীদ থেকে ৮০ কিলোমিটার এলাকায় ডাইক (প্রতিরক্ষা বাঁধ) নির্মাণসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণে ১৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮টি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। তার মধ্যে সুরমার ৮০ কিলোমিটার এলাকায় ডাইক নির্মাণ কাজ আগামী বছরের ২৬ জুন কাজ শেষ হওয়ার কথা। এক বছর শেষ হলেও এই প্রকল্পের ৫টি প্যাকেজের মধ্যে তিনটি প্যাকেজের কাজ হয়েছে ৩২ থেকে ৪৮ শতাংশ। আর দুটির কাজ হয়েছে গড়ে ৯০ শতাংশ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, মেঘালয় ও আসাম বেসিনের বৃষ্টির সকল পানি সিলেট দিয়ে নামে। সেখানে কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টিপাত হলে সিলেট ডুবে যায়।
উজানের পানি ধারণ করার মতো নদী খাল কিছুই নেই এখন। সব খাল-নদী ভরাট হয়ে গেছে। প্লাবনভূমি জলাশয় ভরাট করে স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে পানি ধারণ করার মতো কোনো পরিবেশ সিলেটে নেই। এগুলো সমাধানের জন্য মাস্টার প্ল্যান করা দরকার।
তিনি বলেন, নদী খনন বন্যা মোকাবিলার ৮-১০ পদক্ষেপের মধ্যে একটা। শুধু নদী খনন করলেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। নদী খনন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটা সব সময় করতে হয়। কিন্তু আমাদের সেই সক্ষমতা নেই।
সিসিকের ৪৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবনা ঝুলে আছে
নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকার কাজ করে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। তবুও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মেলে না নগরবাসীর। ২০২১ সালে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে ১২৯ কোটি টাকা খরচ করার পরও ২০২২ সালে দুই দফা বন্যায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে হয় নগরবাসীকে।
এবার জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, স্লুইসগেট নির্মাণ ও পাম্প স্টেশন বসানোসহ বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজের জন্য সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে সিসিক। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন না পাওয়ায় প্রস্তাবনাটি ঝুলে আছে।
সিসিক জানায়, ২০২২ সালের বন্যার পর সিলেট নগরকে বন্যা ও জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা করতে বিশেষজ্ঞ দল দিয়ে সমীক্ষা করা হয়। সমীক্ষা অনুযায়ী প্রথমে ৩১২৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরে সেটি নতুন করে পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে ফিরে আসে। এর পর দ্বিতীয় দফায় আরও সংযোজন করে ৪৬৩৫ কোটি টাকার প্রস্তাবনা পাঠানো হয়। মাস চারেক আগে প্রস্তাবনাটি পাঠানো হলেও তা এখনও মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৯টি ছড়া ও আরও কয়েকটি উপ-ছড়া বা খাল পানিপ্রবাহের জন্য প্রশস্তকরণ, নগরের নিচু এলাকায় পানি সংরক্ষণাগার নির্মাণ, নগর এলাকায় সুরমা নদীর দুই তীরে বেড়িবাঁধ ও পানি প্রটেকশন দেওয়াল নির্মাণ ও সব ক’টি ছড়া বা খালের সম্মুখে স্লুইচগেট নির্মাণ, পানি অপসারণের জন্য পাম্প ও রেগুলেটর স্থাপন। এর বাইরে আরও কয়েকটি কাজও এই প্রস্তাবনায় রয়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, বন্যা ও জলাবদ্ধতা থেকে সিলেট নগরকে রক্ষায় বিশেষজ্ঞ দলের মতামত ও পাউবো কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ৪৬৩৫ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবনাটির অগ্রগতি এখনো নেই। অনুমোদন পেলে কাজটি শুরু করা।
বন্যা মোকাবিলায় যা করতে হবে
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সিলেটে বন্যার জন্য এই অঞ্চলের বৃষ্টিপাত দায়ী না। সিলেটের ওপারে ভারতে ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ সিলেট ডোবার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর পেছনেও নদীর ভরাট, যত্রতত্র ফসল প্রতিরক্ষা বাঁধ ও হাওরগুলোকে বাধ দিয়ে ছোট ছোট পুকুর বানিয়ে ফেলাও দায়ী।
তিনি বলেন, গত ৩০ বছরে হাওরে ভূমি ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। হাওর রক্ষা বাঁধের নামে হাওরগুলোকে ছোট ছোট পুকুর করে ফেলা হয়েছে। যত্রতত্র ব্রিজ, সড়ক নির্মাণ ও হাওররক্ষা বাঁধ প্রকল্পের কারণে ভূমি ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তাছাড়া নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। হাওরে হাউজবোট ব্যবহারের কারণে হাওরের পরিবেশ-প্রতিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করা হয়েছে।
ড. আনোয়ারুল ইসলাম আরও বলেন, জলবায়ুর অতিপরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের মৌসুম পাল্টে যাচ্ছে। আগে পুরো বর্ষাকালজুড়ে বৃষ্টিপাত হতো। এখন ১৫ দিন বৃষ্টি, ১৫ দিন তীব্র গরম। এই অতি তাপমাত্রা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি হুমকি।
ড. আনোয়ারুল বলেন, সিলেটের ওপারে কী পরিমাণ বৃষ্টিপাত হচ্ছে, তা আগে গবেষণা করতে হবে। একটি পরিসংখ্যান দাঁড় করাতে হবে ওপরে যে পরিমাণ বৃষ্টি হবে, সেই আলোকে নিচে কী পরিমাণ আঘাত হানবে। এই আঘাত আমাদের নদনদী কতটুকু নিতে পারবে এটা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। সর্বোপরি মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি ব্যাপকহারে গাছ লাগাতে হবে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কমিউনিটি লেভেলে আরও সচেতনতা বাড়াতে হবে।
আগাম সতর্কতা সংকেত ও ফরকাস্টিং রিসার্চের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তা না হলে বন্যা থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই। যারা পলিসি মেকার তাদেরকে এই বিষয় নিয়েই কাজ করতে হবে।
সেভ দ্য অ্যানভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হেরিটেজের প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, বন্যার জন্য শুধু নদ-নদীকে দোষারোপ করা হয়। কিন্তু এর পেছেনের কারণ কী এটা না খুঁজে শুধু নদী শাসনে ব্যস্ত সবাই।
তিনি বলেন, কোনোভাবেই নদীকে শাসন করা যাবে না। নদীর গতিপথে বাধা দিলে সে আগ্রাসী হবে। তখন ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়বে।
বন্যা মোকাবিলায় প্রকৃতিকে রক্ষা করে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, খনন খুবই ব্যয় বহুল। তাই খনন কাজ কমানোর জন্য যেসব কারণে নদী ভরাট হচ্ছে সেসব বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্যা মোকাবিলায় যেসব প্রকল্প হাতে নেওয়ায় সেগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
এফএ/জিকেএস