যানজট নিরসনে বগুড়ায় ‘রং কোডে’ চলবে অটোরিকশা
যানজট কমাতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে বগুড়া পৌরসভা। শহরের সব ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা দুটি রঙে বিভক্ত হয়ে চলবে। একদিন লাল রঙের রিকশা চলবে, পরদিন চলবে সবুজ রঙের রিকশা ও অটোরিকশা।
জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের ব্যবসায়িক কেন্দ্র বগুড়া ছোট শহর হলেও প্রতিদিন আশপাশের ছয় জেলার হাজারো মানুষ এ শহরে যাতায়াত করেন। ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রিকশা, অটোরিকশা, আর অবৈধ পার্কিং। ট্রাফিক পুলিশের স্বল্পতা ও জনসচেতনতার অভাবে শহরের রাস্তায় প্রায় প্রতিদিনই তৈরি হয় তীব্র যানজট। এই ভোগান্তি কমাতেই পৌরসভা রিকশা ও অটোরিকশাগুলোকে রংভিত্তিক নিয়ন্ত্রণে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পৌরসভার তথ্যমতে, বর্তমানে শহরে ২০ হাজারের বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা চলছে। এসব যান শৃঙ্খলায় আনতে মালিকদের কাছ থেকে ভোটার আইডি সংগ্রহ করে বিনা খরচে রেজিস্ট্রেশন করা হচ্ছে। তবে এই সুবিধা পাবেন কেবল পৌর এলাকার মালিক ও চালকরা। বাইরের কোনো যান পৌর এলাকায় ঢুকতে পারবে না।
যানজট নিরসনের এই উদ্যোগে কিছুটা স্বস্তি এলেও, এর বাস্তবায়ন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা তৈরি হয়েছে অটোরিকশা ও রিকশাচালক ও মালিকদের মধ্যে। তাদের প্রধান উদ্বেগ জীবিকা ও কিস্তি পরিশোধ নিয়ে।
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলা থেকে আসা রিকশা চালক রফিকুল আক্ষেপ করে বলেন, পৌরসভার ভেতরে যারা, তারা কার্ড দিয়ে গাড়ি চালাবে। আমরা এখন সোনাতলা থেকে এসে গাড়ি চালাচ্ছি, আমাদের তো লাইসেন্স হবে না। বাহিরের লোকের কোনো লাইসেন্স হবে না। তাহলে আমরা কীভাবে চলবো?
একই সুর কাহালু উপজেলা থেকে আসা চালক আব্বাস আলীর কণ্ঠেও। তিনি বলেন, কাহালু থেকে এসে বগুড়ায় গাড়ি চালাতে যদি না দেয়, তাহলে আমরা কিভাবে চালাবো? পৌরসভার লোক গাড়ি চালাবে? আমাদের কিস্তি আছে। আমরা যদি রিকশা না চালাতে পারি, কিস্তি কীভাবে দেবো আর খাব কীভাবে? বগুড়া শহরে গাড়ি চালাতে না দিলে কোথায় চালাবো? পৌরসভার এই উদ্যোগ ঠিক না।
জয়পুরহাটের শমসের আলী জানান, আমরা অনেক আগে থেকেই দেখে আসছি, পৌরসভা নিয়ম করছে- লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাতে পারবে না। কিন্তু গাড়ি আমরা ঠিকই চালাই। আমরা প্রায় ২২ থেকে ২৩ বছর ধরে বগুড়া শহরে থাকি। মাইকিং করেছে পৌরসভা থেকে- যারা পৌরসভার ভেতরে আছে, শুধুমাত্র তাদের ভোটার আইডি ফটোকপি জমা নিয়েছে। এ কারণে আমরা বগুড়ায় গাড়ি চালাতে পারবো না? এটা কোনো কথা হলো? আমাদের সংসার চলবে কীভাবে?

এদিকে, পৌরসভার বাসিন্দা হয়েও স্বস্তিতে নেই কেউ কেউ। বগুড়া পৌরসভার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও অটোচালক আব্দুস সামাদ বলেন, এখন শুনছি, গাড়ি রং করে দেবে- একদিন পরপর রং অনুযায়ী চালকেরা অটোরিকশা চালাতে পারবে। সেটা কি কোনোদিনো সম্ভব? একদিন গাড়ি না চালালে আমরা খাব কী? আমাদের কিস্তি আছে, সে কিস্তির টাকা কোথা থেকে দেবো? সেক্ষেত্রে আমাদের সুবিধার তুলনায় অসুবিধাই বেশি হবে।
ভাড়ায় অটোরিকশা চালান ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সৈকত হাসান। তিনি বলেন, গাড়ি না চালাতে পারলে তো আমাদের সংসার চলবে না। যদি বলে আজকে চালিয়ে কালকে বন্ধ, তাহলে আমাদের সমস্যা হবে। পরের দিন কে খাবার দেবে? আমাদের রিকশার চালিয়েই সংসার চলে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, তার মহাজনের ৩০টি গাড়ি রয়েছে। এখন সবগুলো বন্ধ করে দিয়ে যদি এমন একটার রুট পারমিট দেওয়া হয়, তবে তাদের জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হবে।
জয়পুরপাড়া সরদারপাড়া এলাকার মিন্না গ্যারেজের স্বত্বাধিকারী রুহুল আমিন মিন্না বলেন, আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি, পৌরসভা কী করতে চাচ্ছে। তারা যানজট কমানোর জন্য গাড়ি গণনা করছে, নাকি পৌরসভার ভেতরে কতগুলো গাড়ি আছে সেগুলো যাচাই-বাছাই করছে। আমার পাঁচটা অটোরিকশা আছে। আমার আইডি দিয়ে যদি একটার লাইসেন্স বা রং করে দেওয়া হয় তাহলে বাকিগুলো কী করব? এটা ছাড়া আমার অন্য কোনো আয়ের উৎস নেই। আমাদের বিষয়ে পৌরসভার সুদৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। তারা চাইলে জেলার বাইরে থেকে আসা অটোরিকশাগুলো বন্ধ করে দিতে পারে, তবে আমরা তো বগুড়া শহরের ভেতরেই থাকি।
মাটিডালী এলাকার ওহাব গ্যারেজের স্বত্বাধিকারী ওহাব সরকার বলেন, একটা আইডি কার্ডের বিপরীতে একটি গাড়ি অনুমোদন বা রং করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমাদের জানা নেই। যদি এমন হয়, তাহলে যাদের একাধিক গাড়ি রয়েছে তাদের জন্য কষ্টকর বিষয় হয়ে যাবে। আবার অনেকে বাইরের কারো আইডি কার্ড দিয়ে জালিয়াতি করে নম্বর বা রং করে নিতে পারে। পৌর কর্তৃপক্ষের উচিত, পৌরসভার ভেতরে যারা অটোরিকশা ও ইজিবাইক মালিক রয়েছে তাদের একাধিক গাড়ি থাকলেও অবস্থা বিবেচনা করে নম্বর বা রং করে দেওয়া।
চালকদের মাঝে শঙ্কা থাকলেও কেউ কেউ এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। বগুড়া পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের রিকশাচালক আরিফ হাসান বলেন, এতে শহরের যানজট কমবে। আমাদেরও সুবিধা হবে। আজ আমি চালালাম, আগামীকাল আরেকজন চালাবে। সেক্ষেত্রে ভালোই হবে।
২১ নম্বর ওয়ার্ডের রিকশাচালক রফিকুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন জায়গা থেকে শুনতে পাচ্ছি, দুইটা প্রক্রিয়ায় যানজট নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে পৌরসভা- একদিন পরপর গাড়িগুলো চলবে। এতে যানজট কমলে সড়ক দুর্ঘটনাও কম হবে, জনগণের সুবিধা হবে। এ কারণে তারা এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এমন করলে আমাদেরই সুবিধা হবে। তবে এতে করে একদিন করে ঘাটতি থাকবে আমাদের। এই বিষয়টা আমাদের জন্য একটু কষ্টকর।
বগুড়া ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (প্রশাসন)সালেকুজ্জামানও পৌরসভার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
তিনি মনে করেন, একদিন অন্তর অন্তর রং অনুযায়ী গাড়ি চললে শহরে অর্ধেক গাড়ি কমে যাবে এবং এতে অবশ্যই সুফল আসবে। তবে তিনি ফুটপাত দখলকারী হকারদের উচ্ছেদ এবং পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে আসা অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণের ওপরও জোর দেন।
পৌরসভার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশ অটোমোবাইল প্রফেশনালস অ্যাসোসিয়েশনস (বাপা) বগুড়া শাখার সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফজলে রাব্বি ডলার বলেন, এই উদ্যোগটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হলে যানজট অনেকটা কমবে, তবে কাগজে-কলমে যেন সীমাবদ্ধ না থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
বগুড়া পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা শাহজাহান আলম রিপন বলেন, বগুড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা প্রধান শহর হলেও এর আয়তন অনেক কম। এখানে শুধু বগুড়ার নয় আশেপাশের অনেক জেলা থেকেও মানুষ আসে। এই শহরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে এবং জনগণকে স্বস্তি দিতেই পৌরসভা যানজট প্রশমনে গাড়িতে ‘রং কোড’ পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এরইমধ্যে প্রাথমিকভাবে পৌরসভার ভেতরে বসবাসকারী প্রায় সাড়ে আট হাজারেরও বেশি অটোচালকের আইডি কার্ড সংগ্রহ করা হয়েছে। এই গাড়িগুলোকে লাল ও সবুজ-এই দুই রঙে ভাগ করে দেওয়া হবে। একদিন লাল রঙের অটোরিকশা চলবে, পরের দিন চলবে সবুজ রঙের। এর ফলে শহরে চলাচলরত ২০ হাজারের অধিক অটোরিকশার সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে বলে মনে করছেন তিনি।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, প্রাথমিকভাবে একজন ব্যক্তির একটি আইডি কার্ডের বিপরীতে একটি অটোরিকশার অনুমোদন দেওয়া হবে, যাতে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে কেউ একাধিক গাড়ির মালিকানা নিতে না পারে। তবে পৌরসভার বাইরের চালকদের ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত আসবে বলেও জানান তিনি।
পৌর প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার উপপরিচালক মাসুম আলী বেগ বলেন, এখন শুধুমাত্র পৌরসভার বাসিন্দারাই এই সুবিধা পাবেন। বাইরের চালকদের বিষয়ে শিগগির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আপাতত একজন মালিক একটি আইডিতে একটি রিকশারই পারমিট পাবেন।
এলবি/এনএইচআর/জেআইএম