৩ করোনা চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা, নিয়ম মানলে সম্ভব করোনা জয়
ঝালকাঠিতে মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) রাত পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৫ জন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১১ জন, রাজাপুরে তিনজন এবং নলছিটিতে একজন। ঝালকাঠির সদর উপজেলার ১১ জন করোনা রোগীর মধ্যে গাবখান ধানসিড়ি ইউনিয়নেই আক্রান্ত পাঁচজন। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসক ডা. ওমর ফারুক আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে চারজনকেই সুস্থ করে করে তুলেছেন। এসব করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া তিনজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের।
এ সময় ডাক্তররা জানান, জনসাধারনকে চিকিৎসা সেবা দিতেই তারা ডাক্তার হয়েছেন। মহামারি দুর্যোগের সময় নিজেদের সব ভয় এবং আতঙ্কের ঊর্ধে উঠে চিকিৎসাসেবা দেয়াই তাদের দায়িত্ব। আতঙ্কিত না হয়ে নিয়ম মেনে চিকিৎসা নিলেই করোনা জয় সম্ভব বলে জানান তারা। তাদের করোনা চিকিৎসার অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন জাগো নিউজের ঝালকাঠি প্রতিনিধি মো. আতিকুর রহমান।
ধানসিড়ি ইউনিয়নের সহকারী সার্জন ডা. ওমর ফারুক জানান, ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাবখান ধানসিড়ি ইউনিয়নের পুর্ব বিন্নাপাড়া গ্রামে একই পরিবারের ছয়মাসের শিশুসহ তিনজনের দেহে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। ওই পরিবারে খাদ্য সহায়তা নিয়ে বারবার যাতায়াতকারী ইউপি সদস্যের নমুনা পরীক্ষা করলে তারও করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। হোম আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিয়ে তারা সুস্থ হয়েছেন। পরপর দুইবার পরীক্ষায় তাদের রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। সুস্থ হওয়া ব্যাক্তিরা হলেন, ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাবখান ধানসিড়ি ইউনিয়নের পূর্ব বিন্নাপাড়া গ্রামের নাছির হাওলাদার ( ২৮), তার স্ত্রী সুমা আক্তার ( ২৩), তাদের ছয় মাসের শিশুপুত্র মো. সাজিদ ও স্থানীয় ইউপি সদস্য আবু আক্তারুজ্জামান।
তিনি আরও জানান, পুরো পরিবার নারায়ণগঞ্জে বসবাস করতেন। সেখানে নাছির উদ্দিন দোকানে দোকানে বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ করতেন। ৮ এপ্রিল তারা নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়িতে আসেন। এর পর তাদের সর্দি-জ্বর দেখা দিলে করোনা পরীক্ষা করা হলে রিপোর্ট পজেটিভ আসে। শুরুতে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ওই পরিবার ও এর আশপাশের লোকজন। এ সময় ঝালকাঠির সিভিল সার্জন ডা. শ্যামল কৃষ্ণ হালদারের নির্দেশনা অনুযায়ী সার্বিক তত্ত্বাবধানে হোম আইসোলেশনে রেখেই তাদের চিকিৎসা শুরু হয়।
ওমর ফারুক বলেন, স্বাস্থ্য সহকারী মো. জুবায়ের হোসেন নিয়মিত এদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাদেরকে নিয়মিত জ্বর-কাশির ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এছাড়া লেবু, আদা, এলাচি, দারুচিনি গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে ভালোভাবে ফুটিয়ে পান করতেন এবং সেঁক দিতেন। এর বাইরে নিয়মিত ব্যায়াম করাসহ অন্যান্যা নিয়ন কানুন মেনে চলারও নির্দেশনা দেয়া হয় ওই পরিবারকে। এক মাসের মধ্যেই করোনাকে জয় করতে স্বক্ষম হয়েছে পুরো পরিবার। সেই সঙ্গে একইভাবে নিয়ম মেনে চলায় ইউপি সদস্য আবু আক্তারুজ্জামানের দুইবারের টেস্টে রিপোর্ট করোনা নেগেটিভ আসায় তিনিও সুস্থ আছেন। অসুস্থকালীন তারা সবাই জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় জন প্রতিনিধিদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেয়েছেন।
ডা. ওমর ফারুক আরও বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে সব সময় চেষ্টা ছিল কীভাবে তাদের সুস্থ করা যায়। যখন যে ওষুধ দরকার হত আমরা তা দিয়ে দিতাম। আর তাদের মনোবল সব সময় চাঙা রাখতাম। নিয়ম মেনে চিকিৎসা নেয়ায় এরা করোনাকে জয় করতে স্বক্ষম হয়েছে। ঝালকাঠি সিভিল সার্জন ডা. শ্যামল কৃষ্ণ হাওলাদার ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রিফাত আহম্মেদের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা কাজ করেছি।
তিনি বলেন, আমার স্ত্রীও চিকিৎসক (নলছিটিতে কর্মরত) হওয়ার কারণে পারিবারিকভাবে কোনো বেগ পেতে হয়নি। তবে বাবা-মা আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করেছে। আমরা তাদের নির্ভয় দিয়ে মনোবল চাঙা রেখে কাজ করেছি। আল্লাহর অসীম রহমতে আমরা সফল হয়েছি।
করোনা জয়ী নাছির উদ্দিন হাওলাদার বলেন, ‘প্রথম যেদিন শুনেছি আমার পুরো পরিবার করোনায় আক্রান্ত তখন একদম ভেঙে পরেছিলাম। গরিবের সংসারে কীভাবে চিকিৎসা নেব, কী খাব। কিন্তু জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ ও জনপ্রতিনিধিরা সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। তারা আমাদের চিকিৎসা ও খাদ্য সাহায্যসহ সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। যার জন্য আমরা দ্রুত সুস্থ হতে পেরেছি। আমাদের সহযোগিতায় যারা এগিয়ে এসেছেন আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. আবুয়াল হাসান জানান, ঝালকাঠি পৌর এলাকায় চারজনের করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ রিপোর্ট আসে। একজন বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসোলেশনে প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসায় আছেন। তিনি সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ইপিআই কর্মকর্তা। বাকি তিনজনকে হোম আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তারা এখন অনেকটাই সুস্থ আছেন। আশা করি তারা দ্রুত আরোগ্য লাভ করবেন।
তিনি আরও বলেন, চিকিৎসা সেবা প্রদানকালে যথেষ্ট নিরাপত্তা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। স্ত্রী ও বাচ্চাদের জীবাণুমুক্ত রাখতে সার্বিক ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে। যাতে এ দুর্যোগের সময় মহামারিতে আমরা বিপদে না পড়ি।
রাজাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. আবুল খায়ের মাহমুদ রাসেল জানান, রাজাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স, একজন স্বাস্থ্য সহকারি ও ঢাকা থেকে আগত এক যুবকের করোনা পজিটিভ রয়েছে। যুবক বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসোলেশনে প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসায় আছেন। নার্স ও স্বাস্থ্য সহকারী নিজ নিজ বাসায় আইসোলেশনে আছেন। তারা বর্তমানে সুস্থ আছেন। সবার দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি।
একই সঙ্গে আক্রান্ত নার্স ও স্বাস্থ্য সহকারীর সংস্পর্শে আসা সব ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য সেবা দানকারী সবাইকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। ওই মুহূর্তে ডিউটির বাইরে থাকা ডাক্তার, নার্স অন্যান্য সেবা দানকারীরা হাসপাতালের চিকিৎসা চালু রাখছেন। মাঠ পর্যায়ে ঝুঁকি নিয়ে কর্মরত সব স্বাস্থ্য সহকারী, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক, স্বাস্থ্য পরিদর্শক ও সিএইচসিপিদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, সবাই ঘরে ফিরে যান। সুস্থ থাকুন, নিজে বাচুন ও পরিবার বাঁচান।
ঝালকাঠির সিভিল সার্জন ডা. শ্যামল কৃষ্ণ হালদার বলেন, ‘করোনা শনাক্ত রোগীদের সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থা জোরালোভাবেই চলছে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। করোনার হাত থেকে বাঁচতে হলে এই মুহূর্তে সবার ঘরে থাকতে হবে। আর জরুরি প্রযোজনে বের হলে মাক্স ও গ্লাভস পরতে হবে। এছাড়া অন্যান্য স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে।
এমএফ/জেআইএম