সিনেমার সুদিনের অপেক্ষায় রংপুরের আকাশ-শাপলা

জিতু কবীর জিতু কবীর , নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর
প্রকাশিত: ০৭:৪৯ পিএম, ০১ এপ্রিল ২০২১

সারাদেশের মতো রংপুরেও মুখ থুবড়ে পড়েছে সিনেমা হলগুলো। আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন, ভালো ছবি নির্মাণ না হওয়া, হলে সিনেমা দেখা থেকে নতুন প্রজন্মের মুখ ফিরিয়ে নেয়া ও হলের পরিবেশসহ নানা কারণে একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে রংপুরে সিনেমা হলগুলো।

গত দেড় যুগে অন্তত ২০টি হল পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে। এসব স্থানে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন ও বিপণি-বিতান। তবে সরকারি অনুদান, সহজ শর্তে ঋণ ও ভারতীয় সিনেমা আমদানিসহ ভালো মানের ছবি নির্মাণ হলে চলচ্চিত্রে সুদিন ফিরবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞাপন

সুদিনের আশায় পুরনো আমলের পর্দা, অকার্যকর সাউন্ড সিস্টেম আর বসার অনুপযোগী সিট নিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে শহরের আকাশ টকিজ (পুরনো নাম নূরমহল) ও শাপলা নামের দুটি হল। করোনায় সাত মাস বন্ধ থাকার পর পুনরায় চালু হলেও ধকল কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে হল দুটি। দর্শক খরার কারণে যেকোনো সময় বন্ধ হতে পারে হল দুটি।

অথচ দেড় যুগ আগেও রংপুর শহর এলাকায়ই ওরিয়েন্টাল, লক্ষ্মী টকিজ, সেনা অডিটোরিয়াম, বিডিআর হল, শাপলা টকিজ, দরদী হল, নূরমহল, চায়না টকিজ ও রুমা হল সচল ছিল।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এছাড়াও গঙ্গাচড়া উপজেলার মিলন টকিজ ও বনরূপা, মিঠাপুকুরের ঝিনুক, সোহাগ, নূপুর ও বলাকা, বদরগঞ্জের মিতা ও কথাকলি, কাউনিয়ার ঝংকার ও সানাই, পীরগাছার মিতা, সদরের পাগলাপীরের মেরি ও ভাই ভাই টকিজ, নজিরের হাটের বন্ধু টকিজ এখন পুরোপুরি বন্ধ।

চলচ্চিত্র ব্যবসা যখন জমজমাট ছিল তখন সিনেমা হল মালিকদের একটি সংগঠনও ছিল রংপুরে। তবে এখন তা অস্তিত্বহীন।

জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে বাংলার প্রথম সিনেমা হল ‘রংপুর ড্রামাটিক’ ছিল রংপুর শহরে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসনের অবসানের পর ‘রংপুর ড্রামাটিক’নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘মডার্ন হল’। পরে পাকিস্তানে প্রথম সামরিক শাসনকালে মডার্ন হলে ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। তখন থেকেই মূলত ওই হলে সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যায়।

jagonews24

এর বেশ কয়েক বছর পর মডার্ন হলকে সংস্কার করে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রসহ নাটক-থিয়েটারের জন্য উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। পরে এ হলটির নাম রাখা হয় টাউন হল। এখন সেখানে আর সিনেমা দেখানো হয় না। বর্তমানে এখানে নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশসহ নিয়মিত বিভিন্ন সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া ১৯৫৫-৬০ সালের দিকে শহরের প্রাণকেন্দ্র বর্তমান সিটি বাজারের বিপরীত দিকে পাকিস্তানি এক ওষুধ ব্যবসায়ী ওরিয়েন্টাল হল নির্মাণ করেন। প্রায় ওই সময়েই টাউন হলের বিপরীত দিকে রূপালি হলের (পরবর্তী নাম লক্ষ্মী) যাত্রা শুরু হয়।

তৎকালীন সময়ে মূলত এ দুটি হলই ছিল দর্শকদের চলচ্চিত্র বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্র। ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে বন্ধ হয় ওরিয়েন্টাল হল। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে না পেরে ২০০৫ সালে লক্ষ্মী হলও বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৭৮ সালে রংপুর শহরের তেঁতুলতলায় (বর্তমান শাপলা চত্বর) যাত্রা শুরু করে ‘শাপলা টকিজ’ নামের নতুন এক সিনেমা হল। সে সময় রংপুরে সেটাই ছিল সবচেয়ে ভালো সিনেমা হল।

বিজ্ঞাপন

হলের পরিবেশ আর সাজ সজ্জার কারণে দর্শক জনপ্রিয়তায় ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছিল শাপলা টকিজ। তখন রংপুরের পাশাপাশি আশপাশের জেলা থেকেও দর্শক হলটিতে আসত। বর্তমানে এটিও বন্ধের উপক্রম।

ওরিয়েন্টাল, লক্ষ্মী ছাড়াও ৮০ দশকের শুরুর দিকে রংপুরে গড়ে ওঠে সেনা অডিটোরিয়াম, বিডিআর অডিটোরিয়াম, আলমনগর এলাকায় (স্টেশন রোড) দরদী ও নুরমহল।

৯০ দশকের শুরুতে চায়না টকিজসহ বেশ কয়েকটি হল গড়ে ওঠে। তবে ব্যবসায়িক লোকসান আর দর্শক খরার কারণে ২০০৪-২০০৫ সাল থেকে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে হলগুলো।

বিজ্ঞাপন

জায়গার মালিকানা নিয়ে মামলার কারণে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে ওরিয়েন্টাল ও লক্ষ্মী হল। সামনে গড়ে উঠেছে কিছু চা-পান ও বিভিন্ন সামগ্রীর দোকান। দরদী ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছে দোকানপাট। সেনা অডিটোরিয়াম বন্ধ করে কমিউনিটি সেন্টারসহ ক্লিনিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছে।

jagonews24

বিডিআর সিনেমা হল ভেঙে জায়গা খালি করা হয়েছে। বন্ধু সিনেমা হল ধানের গোডাউন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। কাউনিয়ার দুটি হলই ভেঙে দোকানপাট গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া অন্য হলগুলোর অবস্থাও একই।

বিজ্ঞাপন

লক্ষ্মী হল বন্ধের পর ২০০৫ সালের দিকে নুর মহল সিনেমা হল কিনে নিয়ে আকাশ টকিজ নাম দিয়ে পরিচালনা করছেন আনারুল ইসলাম। এছাড়া শাপলা টকিজের প্রকৃত মালিক নজরুল ইসলাম মাসুমের মৃত্যুর পর তার ভাই মিন্টু মিয়া দায়িত্ব নেন। কিন্তু হলের ব্যবসা ভালো না হওয়ায় একই সময়ে শাপলা টকিজ ভাড়া দেয়া হয় কামাল হোসেন নামে ঢাকার এক ব্যবসায়ীর কাছে।

ধুঁকে ধুঁকে চলা আকাশ টকিজের সুপারভাইজার আনু মিয়া ২২ বছর ধরে হলের সঙ্গে জড়িত। তার বাবাও ছিলেন এই পেশায়।

আনু মিয়া জানান, প্রতিদিন চারটি করে শো হয়। প্রতি শো’তে ৮-১০ জন করে দর্শক পাওয়া যায়। যে টাকা খরচ হয় তার অর্ধেকও ওঠে না। এছাড়া মাইকিং খরচ, অটোভাড়া ও কর্মচারীদের বেতনও দেয়া সম্ভব হয় না।

আনু মিয়া আরও জানান, হল মালিক নতুন করে বিনিয়োগের ভরসা পাচ্ছেন না। দর্শক হবে কিনা তা বলা যায় না। ভালো মানের সিনেমা তৈরি হচ্ছে না। ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় বানানো সিনেমাগুলো যদি আনা যেত তাহলে হলগুলো ঐহিত্য ফিরে পেত।

তিনি বলেন, সিনেমা হলের অবস্থা শোচনীয়। কর্মচারীরাও খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, তিনি যেন এ শিল্পে নজর দেন।

jagonews24

শাপলা টকিজের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন শাহাবুদ্দিন। তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, সিনেমা হলে দর্শক না ফেরার অন্যতম কারণ মানসম্মত সিনেমা না থাকা। এছাড়া মালিকপক্ষের অর্থনৈতিক সমস্যা তো আছেই। নতুন করে বিনিয়োগের সাহসও পাচ্ছেন না মালিকপক্ষ।

শাহাবুদ্দিন বলেন, ভারত-বাংলাদেশ একসঙ্গে ছবি রিলিজ করলে আবার দর্শক হলমুখী হতেন। কিন্তু নানা জটিলতায় ভারতে মুক্তির ২/৩ মাস পর বাংলাদেশে সেসব সিনেমা আসে। এরমধ্যে সিনেমা বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দর্শক হলে আসে না।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বর্তমানে শাপলা হলের যে আয় তা দিয়ে হল ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ ও ১১ কর্মচারীর বেতন দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র চলচ্চিত্রকে টিকিয়ে রাখতেই শাপলা হল ভাড়া নিয়ে ভর্তুকি দিচ্ছেন মালিক। তবে হল ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও প্রয়োজন। বড় বাজেটের ছবি বানানো, কাহিনী, গান ও গল্প মানসম্মত হলে দর্শক আবার ফিরবে বলে আশা করেন তিনি।

নগরীর মুলোটোল এলাকার ষাটোর্ধ্ব মোতাহার হোসেন স্মৃতিচারণ করে বলেন, ৭০-৮০’র দশকে নতুন সিনেমা মুক্তি পেলে তার টিকিট পাওয়া ছিল সোনার হরিণের মতো। দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়ে টিকিট কাটতে হিমশিম খেতে হয়েছে। তবুও প্রিয় নায়ক-নায়িকার ছবি না দেখে বাড়ি ফিরিনি। তখনকার ছবিগুলো ছিল সামাজিক ও বাস্তবধর্মী। বর্তমানে ছবির মান ভালো না। হলের পরিবেশও নেই।

এ প্রজন্মের জোনায়েদ, হিমেল, ফিরোজ ও তমাল বলেন, প্রযুক্তির যুগে ছবি দেখে সময় ও টাকা খরচ করার কোনো মানেই হয় না। ঘরে বসেই টেলিভিশন বা মোবাইলে সিনেমা দেখা যায়। চলচ্চিত্রের নামে বাংলাদেশ যা তৈরি হচ্ছে তা রীতিমতো বিরক্তিকর। সিনেমা হল ও দেশীয় চলচ্চিত্র রক্ষায় সরকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের যত্নবান হওয়া দরকার বলে জানান তারা।

jagonews24

এক সময়ে বিভিন্ন নাটক ও সিনেমায় অভিনয় করা রংপুরের বিকন নাট্য কেন্দ্রের সদস্য আরিফুল হক বলেন, প্রযুক্তির আবির্ভাব এবং ইতিবাচক, জীবনমুখী ও রুচিশীল সিনেমার পরিবর্তে কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীলতার কারণে মানুষ হল বিমুখ। ফলে একের পর এক হল বন্ধ হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম চলচ্চিত্র। শুধু বিনোদনের জন্য নয়, সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার, সুস্থ চিন্তা চেতনায় মানুষকে শাণিত করতে চলচ্চিত্র শিল্পকে রক্ষা করা দরকার। এ কাজে সরকার ও চলচ্চিত্র নির্মাণকারী উভয়কে যত্নবান হতে হবে। তবেই চলচ্চিত্রের হারানো দিন ফিরবে।

শাপলা টকিজের কামাল হোসেন বলেন, দেশি-বিদেশি যেটাই হোক না কেন প্রতি সপ্তাহে ভালো মানের ৩/৪টা করে ছবি রিলিজ দিতে হবে। এখনতো মাসে একটাও ভালো সিনেমা পাওয়া যায় না।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

সরকারিভাবে ঋণ সহায়তার কথা বলা হলেও সেখানে আইনগত জটিলতা আছে। যারা ভাড়া নিয়ে হল ব্যবসা করতে চান তাদেরকে ঋণ দেয়া হচ্ছে না। ঋণ নিতে হলে হলের লাইসেন্স, জমির দলিল ব্যাংকে জমা দিতে হয়। এক্ষেত্রে প্রকৃত মালিকরা ঋণ নিতে আগ্রহী হচ্ছে না। সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে হলে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দিতে হবে। তাহলে অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠবেন।

এফএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।