৫ ছেলের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে আরেক ছেলের সুস্থতা কামনা মানু রানীর

সায়ীদ আলমগীর
সায়ীদ আলমগীর সায়ীদ আলমগীর কক্সবাজার
প্রকাশিত: ০৯:২৩ পিএম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২
শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে সাদা শাড়িতে নিহত পাঁচ ভাইয়ের স্ত্রী

কক্সবাজারের চকরিয়ায় পিকআপ চাপায় নিহত পাঁচ ভাইয়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান গভীর শোকাবহ পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী মৃত্যুর চারদিন পর শুক্রবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এদিন হাজারখানেক মানুষকে খাওয়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিহত পাঁচ ভাইয়ের বোনজামাই খগেশপ্রতি চন্দ্র।

কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট রিংভং ছগিরশাহকাটা হাসিনাপাড়া এলাকার পরিচিত মুখ ছিলেন পল্লীচিকিৎসক সুরেশ চন্দ্র শীল (৬০)। বার্ধক্যজনিত কারণে গত ৩০ জানুয়ারি তিনি মারা যান।

এর ১০ দিনের মাথায় মঙ্গলবার (৮ ফেব্রুয়ারি) ভোরে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের জন্য সুরেশের সাত ছেলে ও দুই মেয়ে স্থানীয় তিনমাথা এলাকার মন্দিরে যান। সেখান থেকে ৯ ভাইবোন একসঙ্গে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে পিকআপের ধাক্কায় ঘটনাস্থলে চার ভাই অনুপম শীল (৪৬), নিরুপম শীল (৪০), দীপক শীল (৩৫) ও চম্পক শীল (৩০) মারা যান। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিকেলে মারা যান আরেক ভাই স্মরণ শীল (২৯)।

একই ঘটনায় গুরতর আহত হয়ে চট্টগ্রাম মহানগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র্রে (আইসিইউ) ভর্তি আছেন আরেক ভাই। আরেকজন চিকিৎসাধীন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর তাদের বোন হিরা শীল (৪৫) চিকিৎসাধীন চকরিয়ার মালুমঘাট খ্রিস্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে। বৃহস্পতিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) তার পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।

ডুলাহাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর বলেন, সকাল থেকে ধর্মীয় রীতিতে ওই পরিবারে আচার অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা যোগ দেন। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ এক লাখ টাকা সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া শীতবস্ত্র ও ভোগ্যপণ্যও দেওয়া হয়েছে ওই পরিবারকে।

jagonews24

শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে যান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আমিন আল পারভেজ। এসময় চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেপি দেওয়ান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাহাতুজ্জামান এবং ডুলাহাজরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে, ১০ দিনের ব্যবধানে স্বামী ও পাঁচ ছেলে হারিয়ে নির্বাক সুরেশের স্ত্রী মানু রানী শীল (৫০)। শোকের বোঝা বুকে নিয়ে শুক্রবার পাঁচ ছেলের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করেন তিনি।

শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে চট্টগ্রামের হাসপাতালের আইসিইউতে সংকটাপন্ন ছেলে রক্তিম সুশীলের সুস্থতা কামনা করে প্রার্থনা করেন মা মানু রানী। আর ক্ষণে ক্ষণে বলছিলেন, ‘ভগবান, রক্তিমকে ফিরিয়ে দাও। মায়ের কাছে পাঠিয়ে দাও। এ জীবনে আর কত পরীক্ষা নিবা ভগবান। ভগবান, পাঁচ ছেলের পরিবর্তে আমাকে উঠিয়ে নিলেই বেশি খুশি হতাম। এতো কষ্ট হতো না; আর সহ্য করতে পারচ্ছি না।’ এসব কথার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন এ বৃদ্ধা। তার কান্না উপস্থিত সবাইকে কাতর করে তোলে।

চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতালের পাশের গ্রাম হাসিনাপাড়া। বনবিভাগের পরিত্যক্ত ভূমিতে ৩৪টি সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবার এ পাড়ায় বাস করে। অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য পরিদর্শক সুরেশ চন্দ্রের টিনের আধাপাকা বাড়ি পাড়ার মাঝখানে। শুক্রবার সকাল থেকে সুরেশের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীর উপস্থিতি। বাড়ির উঠানে চলছে নিহত পাঁচ ভাইয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। স্বামী আর পাঁচ ছেলেকে হারিয়ে শোকে কাতর মানু রানী শীল নিজেই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান তদারকি করেন।

দেখা গেছে, উঠানে টাঙানো শামিয়ানার নিচে পূজামণ্ডপ। সেখানে চেয়ারে রাখা পাঁচ ভাইয়ের ছবির ওপর পরানো ফুলের মালা। পুরোহিত পাশে বসে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করছেন। মা মানু রানী নিহত পাঁচ সন্তানের স্ত্রীদের পূজার স্থলে নিয়ে আসেন। সবার পরনে সাদা শাড়ি।

jagonews24

মণ্ডপের পাশে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছিলেন নিহত অনুপম শীলের স্ত্রী পপি শীল (৩৫)। পাশে মেয়ে দেবত্রী শীল (১৫)। পপি বলেন, স্বামীর অবর্তমানে দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। মেয়ে পড়ছে দশম শ্রেণিতে, ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে। তার স্বামী ছিলেন পল্লীচিকিৎসক। লামার আজিজনগর বাজারে তিনি রোগী দেখে সংসার চালাতেন, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতেন। এখন তিনি নেই, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ, সংসার চালানোর মতো কোনো সম্বলও তার নেই।

একই কথা বলেন নিহত দীপক শীলের স্ত্রী পূজা শীল (২৬)। একমাত্র ছেলে আয়ূশ শীলের (৬) মা পূজা বলেন, তার স্বামী দীপক সুশীল কাতারপ্রবাসী ছিলেন। সেখানে তার (দীপক) একাধিক দোকান ছিল। বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে এসে পিকআপের চাপায় মারা গেলেন তিনি। এখন কাতারের দোকানের খবর নেওয়ার লোকও নেই। তার হাতে স্বামীর রেখে যাওয়া কিছুই নেই।

পূজাস্থলের আরেক পাশে রান্নাবান্নার কাজ শেষে দুপুর থেকে খাওয়ানো হয় লোকজনকে। সবকিছু দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন মা মানু রানী শীল।

ঘটনায় অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যাওয়া সুরেশ চন্দ্রের মেয়ে মুন্নী শীল বলেন, ‘ঘটনার চারদিন পার হলেও পুলিশ এখনো পিকআপ চালককে আটক করতে পারেনি। চালক ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের চাপা দিয়েছেন। এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’

অনুষ্ঠান তদারকির দায়িত্বে থাকা মুন্নী শীলের স্বামী খগেশপ্রতি চন্দ্র বলেন, নিহত পাঁচ ভাইয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান দুপুরে শেষ হলে খাবার পরিবেশন শুরু হয়। অন্তত এক হাজার মানুষকে খাওয়ানো হয়েছে। আপ্যায়নে রকমারি সবজির সঙ্গে ছিল সাদা ভাতের নিরামিষ।

jagonews24

খগেশপ্রতি বলেন, চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাদের ভাই রক্তিম শীলের অবস্থা সংকটাপন্ন। তাকে বাঁচানো যাবে কি না, তাতে সন্দেহ রয়েছে। বুধবার (৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে আইসিইউতে ৭২ ঘণ্টা পার হয়েছে, কিন্তু এখনো তার নড়াচড়া নেই। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্লাবন শীলের অবস্থাও অপরিবর্তিত, উন্নতি হচ্ছে না। বুধবার দুপুরে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে হঠাৎ তিনি মাটিতে পড়ে যান। এখনো তিনি কথা বলতে পারছেন না।

স্বজনরা জানান, হিন্দুধর্মীয় রীতি অনুযায়ী স্বাভাবিক কারও মৃত্যু হলে ১০ দিন পর আর অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে চারদিনের মাথায় শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করা হয়। এ কারণে শুক্রবার নিহত পাঁচ ভাইয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়েছে।

চকরিয়ার মালুমঘাট হাইওয়ে থানার ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক শেফায়েত হোসেন বলেন, ঘটনার দিন রাতেই নিহতদের ভাই বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় চালককে আসামি করে মামলা করেছেন। পিকআপ ভ্যানটি জব্দ করা হয়েছে। ভ্যানের চালক ও মালিককে ধরার চেষ্টা চলছে। ঘটনাটি পরিকল্পিত কি না তা গভীরভাবে তদারক করে দেখা হচ্ছে।

সায়ীদ আলমগীর/এসআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।