এক যুগ ধরে শিকলবন্দি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শুকুম

নাম শুকুম চৌকিদার, বয়স ৩৮ বছর। প্রথম দেখায় মনে হবে সুস্থ-সবল একজন মানুষ। কাছে গেলেই এলোমেলো কথা শুনলে ভুল ভাঙবে। আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক নন তিনি। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় প্রায় এক যুগ ধরে শিকলবন্দি শুকুম। ছাড়া পেলেই হারিয়ে যাবেন, অথবা কাউকে মেরে বসবেন, এই ভয়ে শুকুমকে বেঁধে রাখা হচ্ছে। তার সারাদিন কাটে বাড়ির পাশে থাকা একটা গাছের শিকড়ের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায়। রাত হলে ভাই ও ভাবি ঘরে নিয়ে যান। রাতে ভিন্ন রুমে ঘুমান, ঘরের বাহির থেকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় তাকে।
শুকুম চৌকিদার শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ডিঙ্গামানিক ইউনিয়নের জালিয়াহাটি গ্রামের মৃত হাশেম চৌকিদার ও মৃত আনোয়ারা বেগম দম্পতির ছেলে। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছোট।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। তার মা ১৭ বছর ও বাবা ৯ বছর হয়েছে মারা গেছেন। মেঝ ভাই লোকমান চৌকিদার (৫৯) গ্রামে গ্রামে ফেরি করে ভাঙারি এনে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালান। লোকমানের মাঠে কোনো চাষযোগ্য জমি নেই, টেনেটুনে জীবন যাপন করছেন। ছোট থেকে শুকুমকে লালনপালন করছেন তিনি।
লোকমান চৌকিদার বলেন, জন্মের পর থেকেই শুকুমকে অন্যরকম মনে হতো। অন্য বাচ্চাদের মতো কথা বলা বা হাঁটাচলা করতেন না। পরবর্তী সময়ে ছয় থেকে সাত বছর বয়সে আমরা বুঝতে পারি, শুকুম আর দশজনের মতো নন। তখন থেকে নানা স্থানে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। অনেক চেষ্টা করেও ভালো করা যায়নি। নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছি। ১৩ থেকে ১৪ বছর আগে হঠাৎ হারিয়ে যায় শুকুম। তার প্রায় দেড় বছর পর ঢাকার কেরানিগঞ্জ থেকে উদ্ধার করি। তারপর থেকে হাঁটতে পারে না শুকুম। এখন সারাক্ষণ বসে থাকে। প্রতিবন্ধী হওয়ায় কখন কোথায় চলে যায় ভয়ে থাকি। তাই শিকলবন্দি করে রাখি। আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় ঠিকমতো চিকিৎসা আর চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি।
পরিবারের সদস্যরা জানান, শুকুম আগে ছাড়া অবস্থায় ছিলেন। এই সময়ে মাঝেমধ্যে হারিয়েও গিয়েছিলেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাকে ফিরিয়ে আনা হয়। এই অবস্থায় ২০১০ সাল থেকে শুকুমকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছেন পরিবারের সদস্যরা। দিনের বেশির ভাগ সময় তাকে বেঁধে রাখা হয় বাড়ির পাশের একটি গাছের শিকড়ে। এখানেই খাবার দেওয়া হয়। রাত হলেই ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।
শুকুম চৌকিদারের মেঝ ভাবি পারুল বেগম বলেন, দেবরকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। রাতে খেয়াল রাখতে হয় এলোমেলো কিছু করে ফেলছে কি না। তবে কোনো কিছুর ওপর তার কোনো আগ্রহ নেই। কাউকে কাছে পেলে সালাম দেয় ও পাঁচ টাকা চায়। দেবরকে সন্তানের মতো আদর করে লালনপালন করি।
এ বিষয়ে প্রতিবেশী মো. আলী আকবর বলেন, শুকুম যখন ছাড়া থাকতো, তখন রাস্তায় রাস্তায় থাকতো। কখনো মানুষের সঙ্গে তেমন খারাপ আচরণ করেনি। দেখলেই সালাম দেয়। মাঝে মধ্যে সিগারেট কিনে দিই। শুকুম চৌকিদার দেখতে সুস্থ-সবল একজন মানুষ। বোঝার উপায় নেই সে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। একটু ভালো চিকিৎসা পেলে সুস্থও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু অর্থের কারণে হচ্ছে না। পরিবারটি খুবই দরিদ্র হওয়ায় ইচ্ছা থাকলেও ভালো চিকিৎসা করাতে পারছে না। সরকার বা বিত্তবানরা সহযোগিতা করলে সুস্থ হতেও পারে শুকুম।
শরীয়তপুরের সিভিল সার্জন এস এম আব্দুল্লাহ আল মুরাদ বলেন, শুনলাম শুকুম চৌকিদার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, এছাড়া শারীরিক সমস্যাও রয়েছে। এক্ষেত্রে ভালো চিকিৎসককে দেখানো জরুরি। আমরাও খোঁজ নিয়ে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো। তিনি চিকিৎসা করালে ভালো হলেও হতে পারেন।
মো. ছগির হোসেন/এমআরআর/জিকেএস