লোডশেডিংয়ে চাল উৎপাদন ব্যাহত, কমেছে ধানের দাম
ধানের জেলা দিনাজপুর। কিন্তু ভরা মৌসুমে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে চাল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ধান সংগ্রহ করেও বিদ্যুতের অভাবে অধিকাংশ সময় মিল বন্ধ রেখে অসহায় বসে থাকছেন মিল মালিকরা। এই অবস্থায় ধান কিনেও চাল উৎপাদন করতে না পারায় ধান কেনা একরকম বন্ধ করে দিয়েছেন মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। এতে ভরা মৌসুমেও এক সপ্তাহের ব্যবধানে দিনাজপুরের বাজারে বস্তাপ্রতি (৭৫ কেজি) ধানের দাম কমেছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এ নিয়ে হতাশ কৃষকরাও।
দিনাজপুর সদর উপজেলার উত্তর গোবিন্দপুর এলাকার ‘থ্রি-স্টার’ অটোরাইস মিলে গিয়ে দেখা যায়, গোটা মিল ও মিল চত্বরে কয়েক হাজার ধানের বস্তার স্তূপ। বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ রয়েছে মিল। মিলের প্রায় ৩০ জন শ্রমিক সময় কাটাচ্ছেন শুয়ে ও বসে।
কেন বসে আছেন জিজ্ঞেস করতেই মিলের অপারেটর আশরাফুল ইসলাম বললেন, ‘আগে বসে থাকিছিনো ধানের অপেক্ষায়। আর এখন মিলত ধান ভর্তি, বসি আছি কারেন্টের (বিদ্যুৎ) অপেক্ষায়। মাঝে মাঝে কারেন্ট আসিলেও মিলের সুইচ দিতেই একটু পরে কারেন্ট নাই। মিলটা চালাবায় পারছনাই, কেমন করি কাম চলিবে।’
সহকারী অপারেটর আজিমুল হক বলেন, ‘কারেন্টের অপেক্ষায় দিন-রাত বসি থাকেছি। কামও হয় না-ঘুমও হয় না। অথচ এই সময় হামেরা কামের ফুরসৎ পাই না। এইভাবে চলিলে মালিকেরও লস, হামারও লস।’
মিল মালিক সুনন্দ বসাক জানান, একটি ড্রায়ার চালাতে প্রতিবার ধান লাগে ৩শ বস্তা (প্রতি বস্তা ৭৫ কেজি)। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে দিনে ২টি ড্রায়ারে চাল উৎপাদন করা যায়। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে বিদ্যুতের যে অবস্থা তাতে দু’দিনেও একটি ড্রায়ার করা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, মিলে তার নিজের ও ব্যবসায়ীদের প্রায় ৫ হাজার বস্তা ধান পড়ে আছে। বোরো ধান বেশিরভাগ কাঁচা থাকে। ভরা এই মৌসুমে ঠিকমতো মিল চালাতে না পেরে ধানও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় যেসব ব্যবসায়ী ধান কিনে চাল তৈরি করতে এসেছেন, তাদেরও লোকসান হচ্ছে, মিল মালিক হিসেবে তিনিও চরম লোকসানের মুখে পড়েছেন।
সুনন্দ বসাকের মতো এই দুর্বিসহ অবস্থা দিনাজপুর জেলার ১৮৮টি অটোরাইস মিল মালিকের। বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ের ভরা মৌসুমেও ধান কিনে বিদ্যুতের অভাবে চাল উৎপাদন করতে পারছেন না এসব মিল মালিকরা। চালের ভরা এই উৎপাদন মৌসুমে অধিকাংশ সময় মিল থাকছে বন্ধ। এ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
দিনাজপুর জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি মোসাদ্দেক হুসেন জানান, বিদ্যুতের অস্বাভাবিক লোডশেডিংয়ের কারণে অটোরাইস মিল মালিকরা দুটি চরম সমস্যায় পড়েছেন। প্রথম সমস্যা হলো তারা সময়মতো ও মানসম্পন্ন চাল উৎপাদন করতে পারছেন না। আর দ্বিতীয় সমস্যা হলো খাদ্য বিভাগের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ চাল সরবরাহ নিয়ে।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অটোরাইস মিলের একটি ড্রায়ার চালু করার জন্য প্রথমেই ৬ ঘণ্টা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে আধাঘণ্টা পর পর। এতে ড্রায়ারের চাল অধিকাংশই ভেঙে যাচ্ছে। ফলে মানসম্পন্ন চাল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি আর্থিকভাবে চরম লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদের।
তিনি বলেন, কেনার সময় আমন ধান শুকনা থাকলেও বোরো ধান থাকে কাঁচা। আর এই কাঁচা বোরো ধান কিনে বেশিক্ষণ রাখলেই নষ্ট হয়ে যায়। মিল ঠিকমতো চালু রাখতে না পেরে ভরা মৌসুমে ধান কিনে ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। বিদ্যুতের এই অবস্থা চলতে থাকলে চলতি বোরো সংগ্রহ অভিযানে খাদ্য বিভাগের সঙ্গে চুক্তি করেও চাল সরবরাহ নিয়ে শংকা প্রকাশ করেন তিনি। এজন্য খাদ্য উদ্বৃত্তের এই জেলায় ভরা মৌসুমে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবিও জানান তিনি।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বোরো সংগ্রহ অভিযানে দিনাজপুর জেলায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ৫৪৬ মেট্রিক টন চাল সরবরাহের লক্ষ্যে জেলার ১৮৮টি অটোরাইস মিল এবং ৯৪৭টি হাস্কিং মিল চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
এদিকে বিদ্যুতের অস্বাভাবিক লোডশেডিংয়ের কারণে ধান ক্রয় করেও চাল উৎপাদন করতে না পারায় ধান কেনা কমিয়ে দিয়েছেন মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। এতে গত কয়েকদিনের ব্যবধানে বাজারে বস্তাপ্রতি (৭৫ কেজি) ধানের দাম কমেছে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। দিনাজপুরের অন্যতম বৃহৎ ধানের বাজার সদর উপজেলার পাঁচবাড়ী ও আমবাড়ী ধানের হাটে গিয়ে দেখা যায়, গত ৩-৪ দিনের ব্যবধানে বিআর-২৮ ধান প্রতিবস্তা (৭৫ কেজি) ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে কমে ২ হাজার ২০০ টাকা, হাইব্রিড ধান ২ হাজার ৫০ টাকা থেকে কমে ১ হাজার ৮০০ টাকা, জিরা-৪০ ধান ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে কমে ২ হাজার ২০০ টাকা এবং গোল্ডেন কাটারি ধান ২ হাজার ৬০০ টাকা থেকে কমে ২ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ের ভরা মৌসুমে হঠাৎ ধানের দাম কমে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন কৃষকরা।
বিদ্যুৎ বিভাগও স্বীকার করেছে বিদ্যুতের চরম লোডশেডিংয়ের কথা। নর্দার্ন ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (নেসকো) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দিনাজপুরে বিদ্যুতের চাহিদা ৪৬ মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ মিলছে মাত্র ২১ থেকে ২২ মেগাওয়াট। যা চাহিদার অর্ধেকেরও কম।
নেসকো দিনাজপুর ডিভিশন-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার মো. কালাম জানান, তার এলাকায় চাহিদা ২৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কিন্তু তিনি সরবরাহ পাচ্ছেন ১০ থেকে ১২ মেগাওয়াট। তাই রেশনিং পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, মিল মালিকরা তাদের সমস্যার কথা জানিয়েছেন। পরিস্থিতির উন্নয়ন হলেই নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।
নেসকো দিনাজপুর ডিভিশন-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার মো. ফজলুর রহমান জানান, তার জোনে বিদ্যুতের চাহিদা ১৮ মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ পাচ্ছেন ১১ মেগাওয়াট। এজন্য বাধ্য হয়েই এলাকা ভাগ করে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ঘুর্ণিঝড় ‘মোখা’র কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। অচিরেই এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এফএ/এএসএম