মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা
কারাগারে খামারি, খাবার না পেয়ে মরছে গরু
১০ বছর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে গড়ে উঠেছিল মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা নামে একটি এনজিও। এরইমধ্যে জেলায় প্রায় ৪৪টি শাখা কার্যালয়ও খোলা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির। এমনকি বিশাল আঁকারের ডেইরি খামারও ছিল তাদের, যা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৮-১০ মণ দুধ বিক্রি হতো। এছাড়া এনজিওটিতে কর্মসংস্থানও হয়েছিল প্রায় ৬০০ মানুষের।
কিন্তু গত বছরের ১৭ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মাসুদ রানাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। তখন থেকে কারাগারে আছেন তিনি। এতেই বাঁধে বিপত্তি। এখন খামারে থাকা প্রায় ২৫০টি গরুর খাবার জুটছে না। এমনকি কয়েকটি গরু না খেয়ে মারাও গেছে। আর অন্য গরুগুলোর অবস্থাও খারাপ। খেতে না পেয়ে ক্ঙ্কালসার হয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিন শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট শিবনারায়ণপুর এলাকার মধুমতি ডেইরি খামারে গিয়ে দেখা যায়, এখনো খামারে আছে ফ্রিজিয়ান জাতের বিশালদেহী গাভী। কিন্তু খামারে থাকা বেশিরভাগ গরু ও বাছুরের চোখের কোনে গড়িয়ে পড়ছে পানি। দেখে মনে হচ্ছে, সবগুলো গরু রোগাক্রান্ত। খামারে মানুষ প্রবেশ করা মাত্রই হাম্বা হাম্বা শব্দে ডাকছে গরুগুলো। গবাদি পশুগুলোর পেটের পাশ দিয়ে সুস্পষ্টভাবে হাড়ের দেখা মিলছে। পর্যাপ্ত খাবার না পেয়ে গরুগুলোর এ অবস্থা হয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এনজিওটির এমডি মাসুদ রানা কারাগারে যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা টাকা আত্মসাৎ করেছেন। আর জমা রাখা টাকা না পেয়ে দিশেহারা হয়ে ঘুরছেন প্রায় ৩৫ হাজার গ্রাহক।
মধুমতি ডেইরি খামারের শ্রমিক আব্দুল বারী বলেন, গত পাঁচ বছর ধরে এই খামারে কাজ করি। কখনো বেতন বন্ধ হয়নি। কিন্তু মালিক আটক হওয়ার পরে আর বেতন পাচ্ছি না। আমরা মাত্র তিনজন রয়েছি এখানে। গরুগুলোর অবস্থা দেখে ছেড়ে যেতে পারিনি। তাই কষ্ট করে আছি। তবে মনে হচ্ছে আর থাকতে পারবো না। কারণ আমারও তো সংসার আছে। বেতন পাইনি ছয় মাস, কী দিয়ে সংসার চালাবো? এদিকে গরুগুলোকেও খাবার দিতে পারছি না। না খেয়ে মরে যাচ্ছে গরু। তাদের কষ্টও দেখতে পারছি না।
খামারের পাঁচটি গরুকে নিজ হাতে মাটি দিয়েছেন শ্রমিক আশিক আলী। তিনি বলেন, নিজ হাতে গুরুগুলো বড় করে খাবারের অভাবে মরতে দেখার কষ্ট বলে বোঝাতে পারব না। শুধু গরু নয়, গাড়লগুলোও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। যেসব গরু-গাড়লকে দৈনিক ১২ রকমের দানাদার খাবার দিতাম এখন তার কিছুই পারি না। গরুগুলোর কষ্ট দেখে এই খামার ছেড়ে যেতে পারিনি।
আলমগীর নামে আরেক এক শ্রমিক বলেন, গত পাঁচ বছর থেকে আমি মধুমতি ডেইরি খামারে কাজ করি। বছরখানেক আগে গো-খাদ্য কাটতে দিয়ে আমার হাত কেটে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। তখন মালিক মাসুদ রানা বলেছিলেন, আমাকে ঘর করে দেবেন। কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না। তার আগেই তিনি কারাগারে চলে গেলেন। এখন ঘর তো দূরের কথা, আমি নিজেই খেতে পারছি না। এমনকি গরুগুলোও খেতে পারছে না।
এদিকে, মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থায় টাকা জমা রেখে ভোগান্তিতে পড়েছেন ৩৫ হাজার গ্রাহক। টাকা না পেয়ে অসহায় হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন অনেকে। দফায় দফায় আদালতে মামলা, সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, সমাবেশ, প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েও তারা পাচ্ছেন না কোনো সুরাহা।
গ্রাহকদের দাবি, এক লাখ টাকায় মাসে ১২০০ টাকা লাভ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমানত সংগ্রহ করে মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা। মাসুদ রানা থাকা পর্যন্ত কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকলেও হঠাৎ করেই অস্ত্রসহ আটকের পর সবকিছু থমকে যায়। তাই গ্রাহকদের দাবি, মাসুদ রানাকে কারাগার থেকে বের করা হোক। তাহলে হয়তো তারা টাকা ফেরত পাবেন। তারা বলছেন, তাদের টাকা দেওয়ার মতো সম্পদ মধুমতি এনজিওর আছে।
জানা যায়, মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা জেলাজুড়ে প্রায় ৪০টির অধিক শাখায় ৩৫ হাজার গ্রাহকের প্রায় ১০৫ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে। এসব টাকায় ট্রাকের ব্যবসা, বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতসহ খামার স্থাপন করেন মাসুদ রানা। কিন্তু তিনি কারাগারে যাওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় জেলাজুড়ে থাকা মধুমতির বেশিরভাগ শাখার কার্যক্রম।
শিবনারায়ণপুর গ্রামের মো. হেলাল নামে মধুমতির এক গ্রাহক বলেন, আমরা জানি মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার এমডি মাসুদ রানা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বশীল আরও অনেকেই ছিলেন। যে কোনো কারণে মাসুদ কারাগারে রয়েছেন। তার মানে কি সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে? এটা কোনো কথা? জনগণের কোটি কোটি টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাসুদ রানার এক প্রতিবেশী বলেন, সবকিছু ভালো চলছিল। কিন্তু এনজিওটির যে ম্যানেজারগুলো ছিল তারা অনেক টাকা টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এতে বিপাকে পড়েছেন এনজিওটির মালিক। তবে এখনো কিছু জমি, নগদ অর্থ, কয়েকটি ট্রাক আছে যা বিক্রি করে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, আমরা দেখেছি এনজিওটি প্রায় ৬০০ মানুষের কর্মস্থান করেছে। কিন্তু তিনি আটক হওয়ার পরে এখন সেই কর্মচারীগুলো তার অর্থ-সম্পদ লুটে খাচ্ছেন। এমনকি এই এনজিওটির কয়েকটি শাখার ম্যানেজার এনজিওর টাকা দিয়ে বাড়ি-গাড়ি জমি কিনেছেন।
মধুমতি সমাজ উন্নয়ন সংস্থার এরিয়া ম্যানেজার তানভীর আলী বলেন, সবকিছু ভালোই চলছিল। ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ রানা আটকের পর তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহমুদা খাতুনের উচিত ছিল দায়িত্ব নেওয়ার। কিন্তু মাসুদ রানা আটকের পর থেকেই তিনিও পলাতক। আমরা এখন মাসুদ রানা ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি। কিন্তু তিনি আসছেন না। তাহলে কি আমরা ভেবে নেবো ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন?
শিবগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. শাহাদাৎ হোসেন বলেন, না খেয়ে গুরু মরে যাচ্ছে এমন খবর আমার জানা ছিল না। আপনি বললেন, আমি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেবো। তারা আমাকে জানাতে পারত বিষয়টি।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম সাহিদ বলেন, মধুমতির প্রতারণার বিষয়ে আদালতে মামলা চলমান। কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেফতারের অভিযান অব্যাহত আছে। বিষয়টি যেহেতু প্রতারণার, তাছাড়া আদালতে মামলা চলছে। এ নিয়ে পুলিশের তেমন কিছু করার নেই।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খাঁন বলেন, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখার আগে অবশ্যই খোঁজ-খবর নিতে হবে। এ বিষয়ে জনসাধারণের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এছাড়া মধুমতির বিষয়ে আদালতে কয়েকটি মামলা চলমান। আদালত নির্দেশনা দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমআরআর/এএসএম