মোখার তাণ্ডব
এখনো শুকায়নি সেন্টমার্টিন-শাহপরীর দ্বীপের ক্ষত

অডিও শুনুন
কক্সবাজারের টেকনাফ-সেন্টমার্টিনসহ উপকূলে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আঘাত হানার ২০ দিন পেরিয়ে গেছে। আবহাওয়া পরিস্থিতিও এখন স্বাভাবিক। তবে এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেননি মোখায় ক্ষতিগ্রস্তরা।
উপকূল অতিক্রমকালে টেকনাফের সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপে প্রভাব ফেলে ‘মোখা’। সেন্টমার্টিনে দুই হাজারের বেশি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লবণাক্ত পানির প্লাবনে নলকূপ থেকে উঠছে লোনা পানি। ফলে সুপেয় পানি সংকটে ভুগছেন দ্বীপবাসী।
ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে কিছু পরিবার ত্রাণ হিসেবে টিন ও নগদ টাকা পেলেও এখনো ঘরবাড়ি দাঁড় করাতে পারেনি অনেকে। স্থল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এ দ্বীপে কাঁচাবাড়ি নির্মাণসামগ্রী ও শ্রমিকের মজুরি আকাশছোঁয়া। ফলে বিপাকে পড়েছেন তারা।
আরও পড়ুন: ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবকালে জন্ম, নাম রাখলেন ‘মোখা’
সেন্টমার্টিনের পূর্বপাড়ার বাসিন্দা জেলে ইমাম হোসাইন (৩০) বলেন, ‘মাছ শিকার করে সংসার চলে। সন্তানদের পড়াশোনা করাই। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় মোখা সব ওলট-পালট করে দিয়েছে। বিধ্বস্ত হয়ে গেছে আমার ঘর। উপজেলা প্রশাসন থেকে দুই বান্ডেল টিন ও নগদ ছয় হাজার টাকাসহ খাবার দিয়েছে। কিন্তু বাড়িটি এখনো তুলতে পারিনি। টিন লাগাতে হলে গাছ ও অন্য সরঞ্জাম দরকার। দরকার মিস্ত্রিও। তবে, যা খরচ পেয়েছি তা দিয়ে কোনোটাই হচ্ছে না বলেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে মাথাগোঁজার ঠাঁই করেছি।’
সেন্টমার্টিন দক্ষিণপাড়া কাড়াবনিয়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল্লাহ বলেন, ‘তালিকা করেছে শুনলাম। তবে কবে সহযোগিতা পাবো জানি না। জনপ্রতিনিধিদের আত্মীয়রা শুরুতেই ত্রাণ পেয়েছে। অল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও অনেকে সহযোগিতা পেয়েছে। কিন্তু আমার মতো অনেকের ভাগ্যে এখনো ত্রাণ জোটেনি।’
শুধু আব্দুল্লাহ নন, সরকারি সহযোগিতা পাননি বলে দাবি করেন দক্ষিণপাড়া পোঁচ কাড়াবনিয়ার বাসিন্দা ফায়সাল, নুরুল ইসলাম কালো, রফিক, রশিদ আহমদ, মুহাম্মদ আলম এবং আব্দু সালামসহ অনেকে। তবে উপজেলা প্রশাসন এবং ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে বলা হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সহযোগিতা পৌঁছানো হয়েছে।
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সফলভাবে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করেছি
সেন্টমার্টিন দক্ষিণপাড়ার নুরুল ইসলাম (কালু মিয়া) বলেন, ‘সরকারি কোনো সাহায্য এখনো পাইনি। শুনেছি পাশের গ্রামের অনেকে টিন ও নগদ টাকা পেয়েছে। আমিও পাবো বলে আশ্বাস পেয়েছি।’
কুনারপাড়ার রফিক আহমদ বলেন, ‘আমি ৬ হাজার টাকা ও দুই বান টিন পেয়েছি। কিন্তু মিস্ত্রির উচ্চ মজুরি দিয়ে ঘর দাঁড় করানো কঠিন। তাই বিধ্বস্ত ঘর এখনো সংস্কার করতে পারিনি। কষ্ট করে থাকছি।’
উত্তরপাড়ার নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত কম হয়েছে এমন অনেক পরিবার দ্রুত সরকারি সহযোগিতা পেয়েছে। তালিকায় আমাদের নাম থাকলেও এখনো সাহায্য পাইনি।’
তথ্যমতে, গত ১৪ মে ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে সেন্টমার্টিনে প্রায় দুই হাজারের মতো বসতবাড়ি নষ্ট হয়। ঘূর্ণিঝড়ের পরপরই ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, জনপ্রতিনিধিদের স্বজনপ্রীতির কারণে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা ত্রাণ পেতে বিলম্ব হয়েছে। আবার সাহায্য পেয়েও উচ্চমূল্যের নির্মাণসামগ্রী কিনে বেশি দামে শ্রমিক দিয়ে ঘর মেরামতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেকে। ফলে ক্ষত সারিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন: ১৬ বছরে এবারই প্রথম, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়েনি সাতক্ষীরায়
সেন্টমার্টিনের ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান বলেন, ত্রাণ হিসেবে পাওয়া টিন দিয়ে অনেকে ঘর তুলতে পারেননি। এজন্য তারা টিনগুলো বিক্রি করে ত্রিপল-বাঁশ কিনে মাথাগোঁজার চেষ্টা করছেন।
শাহপরীর দ্বীপের ডাঙ্গরপাড়ার বাসিন্দা জাহিদা বেগম (৩২) বলেন, ‘মোখার তাণ্ডবে আমার ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। ফসলি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। তবে আমরা এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাইনি।’
তিনি বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে পাঁচ সন্তান নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। বড় ছেলে প্রতিবন্ধী। দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করছি। এরপরও জনপ্রতিনিধিদের স্বজনপ্রীতির কারণে সরকারি সহযোগিতা থেকে আমরা বঞ্চিত।
শাহপরীর দ্বীপের কৃষক কামাল হোসাইন (৪৫) বলেন, মোখায় বাড়িঘর ও পানের বরজসহ প্রায় ৮-১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন দুই বান্ডেল টিন ও ৬ হাজার টাকা দিয়েছে। এটা দিয়ে কিছু করতে পারিনি।
আরও পড়ুন: মোখা রেখে গেছে ক্ষত, দুর্ভোগে কয়েক হাজার মানুষ
লবণ ব্যবসায়ী ইদ্রিস বলেন, মোখায় সাবরাং ও শাহপরীর দ্বীপসহ উপকূলে প্রায় ২-৩ কোটি টাকার লবণ নষ্ট হয়েছে। তবে আমরা কোনো দপ্তর বা এনজিও থেকে সহায়তা পাইনি।
হোয়াইক্যংয়ের বাসিন্দা আবু শামা (৫৫) জাগো নিউজকে বলেন, আমার ঘরের ছাউনি-বেড়াসহ অনেক টাকার ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ত্রাণ সহায়তা পাইনি।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এলাকার জন্য এক মেট্রিক টনের মতো ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ পেয়েছেন বলে জানান হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারী। তিনি বলেন, ক্ষতির তুলনায় ত্রাণের পরিমাণ অতি অল্প, যা ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সহায়ক হয়নি।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন দরকার। তবে আমাদের তরফ থেকে কোনো ধরনের স্বজনপ্রীতি করা হয়নি। উপজেলা প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়ন করছে। শিগগির আরও সহযোগিতা আসবে বলে জেনেছি।
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তিন হাজার শেল্টার ক্ষতিগ্রস্ত
টেকনাফের সহকারী কমিশনার (ভূমি) এরফানুল হক চৌধুরী বলেন, সেন্টমার্টিনে ক্ষতিগ্রস্তদের আমরা তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছি। যাদের ঘর একেবারে বিধ্বস্ত হয়েছে তাদের এ-ক্যাটাগরি, এর চেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্তরা বি-ক্যাটাগরি এবং বাকিদের সি-ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। সে অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান বলেন, মোখায় ক্ষতিগ্রস্তদের টিন, টাকা, চাল, ডালসহ প্রয়োজনীয় ত্রাণ দেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, জনপ্রতিনিধিরা সুযোগ পেলে স্বজনপ্রীতি করেন, এমন অভিযোগ থাকায় তাদের দেওয়া তালিকা ক্রস চেক করে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনে নির্মাণসামগ্রীর দাম ও শ্রমিকের মজুরি বেশি। তাই সহযোগিতা পেয়েও বেশিরভাগই ঘর তুলতে পারেননি। তবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ এবং অন্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ঘর করে দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে জেলা প্রশাসন।
এসআর/এএইচ/এএসএম