প্রতারণা এড়াতে ডিজিটাল হাটে থাকবে কঠোর নজরদারি
ঈদুল আজহা এলেই হাট ঘুরে পছন্দ মতো পশু কেনা চিরায়ত এক ঐতিহ্য। ডিজিটাল পদ্ধতির বিকাশ ও করোনা পরিস্থিতির কারণে পশুর হাটেও লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ঘরে বসে হাজারো পশুর ভিড়ে বাজেট অনুযায়ী পছন্দের পশু কেনা যাচ্ছে অনায়াসেই। বিগত বছরে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পশু বিক্রিতে রয়েছে প্রতারণার অভিযোগ। তাই এবার তা প্রতিরোধে কঠোর নজরদারি রাখা হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রস্তুতিমূলক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে বিদ্যমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশন-পৌরসভাগুলোর ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনের স্থানীয় প্রতিনিধি, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে অনলাইনে গবাদি পশু বেচাকেনার উদ্যোগ গ্রহণে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত হয়। বিভাগীয় কমিশনাররা অনলাইনে গবাদিপশু বিক্রির লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণে নির্দেশনা দেয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়।
এছাড়া সিদ্ধান্ত হয়, সংশ্লিষ্ট ভেটেরিনারি সার্জনরা অনলাইনে আপলোড করার আগে গবাদিপশুর স্বাস্থ্য সনদ প্রদান করবে, যা অনলাইনে আপলোড করতে হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর অনলাইনে গবাদিপশু বিক্রির জন্য খামারিদের সংশ্লিষ্ট অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংযোগের সহযোগিতা প্রদান করবে এবং আপলোডকৃত গবাদিপশুর ক্ষেত্রে মালিকের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, গবাদিপশুর বয়স, ওজন, মূল্য ও গবাদিপশুর ছবি প্রদান করতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে ডিজিটাল পদ্ধতিকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। গত বছর এ পদ্ধতিতে ভালো সাড়া মিলেছে। এ বছরও গত বছরের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি পশু বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। বিগত বছর পশু বিক্রি নিয়ে কিছু প্রতারণার অভিযোগও ছিল। অভিযোগের সংখ্যা সামান্য হলেও এ বছর যাতে এ ধরনের কোনো ঘটনা না ঘটে সেজন্য পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্টের সঙ্গে পশুর ছবি আপলোড করার জন্য বলা হয়েছে। সার্বিকভাবে ডিজিটাল হাটে ব্যাপক নজরদারি থাকবে, কেউ কোনো প্রতারণার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা গেছে, গত বছরের মতো এ বছরও গবাদিপশুর পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। গত বছর হৃষ্টপুষ্টকরণের আওতায় কোরবানির জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ সারাদেশে গবাদিপশুর সংখ্যা ছিল এক কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০টি। এ বছর এ কার্যক্রমের আওতায় মাঠ পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, ৪৫ লাখ ৪৭ হাজার গরু-মহিষ, ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং অন্যান্য চার হাজার ৭৬৫টি পশুসহ মোট এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু রয়েছে। চলতি বছর হৃষ্টপুষ্টকৃত গরু-মহিষের সংখ্যা ৩৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮০০টি, হৃষ্টপুষ্টকৃত ছাগল-ভেড়া ২৩ লাখ ৭২ হাজার ৭৪৮ এবং গৃহপালিত গরু-মহিষের সংখ্যা ৬৮ লাখ ৮৮ হাজার ২০০ ও গৃহপালিত ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৪৯ লাখ ৯২ হাজার ২৫২টি।
রোববার (৪ জুলাই) পর্যন্ত সারাদেশে ৬০ হাজারের বেশি পশু বিক্রির জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আপলোড করা হয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ১১ হাজার গবাদিপশু অনলাইনে বিক্রি হয়েছে। এ পর্যন্ত ৮০ কোটি টাকার বেশি পশু বিক্রি হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর অনলাইনে পশু বিক্রির সংখ্যা বাড়ছে। গত বছর সারাদেশে অনলাইন-অফলাইনে প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকার গবাদিপশু কোরবানি উপলক্ষে বিক্রি হয়।
এদিকে রোববার জুম প্ল্যাটফর্মে ‘ডিএনসিসি ডিজিটাল গরু হাট ২০২১’-এর উদ্বোধন করা হয়। ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের এলাকার মানুষ এই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে গরু কিনতে পারবেন। এছাড়া রয়েছে পশু বিক্রি সংক্রান্ত বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যারা সারাদেশে সার্ভিস দিচ্ছেন। অনলাইনে কেনা কোরবানির পশুতে কোনো ত্রুটি পেলে ফোনে বা ই-মেইলে ই-ক্যাবের কাছে অভিযোগ করা যাবে। অভিযোগ গ্রহণের তিন কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগের সুরাহা করবে ই-ক্যাব। অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থা রেখে ২০২১ সালের ঈদুল আজহায় অনলাইনে পশু বিক্রির ব্যবস্থা রেখে অনলাইনে পশু বিক্রয়ের নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে।
অনলাইন পশুর হাটের বিষয়ে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল জাগো নিউজকে বলেন, ডিজিটাল গরুর হাট সবার জন্যই উন্মুক্ত একটা প্ল্যাটফর্ম। ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে দেশব্যাপী অনেক উদ্যোক্তা রয়েছেন, প্রান্তিক খামারি রয়েছেন তাদের আমরা কানেক্ট করছি। ই-কমার্স সাইটগুলোও অনেক খামারির সঙ্গে কানেক্টেড আছে, তাদের আমরা কানেক্ট করার চেষ্টা করছি এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে।
তিনি আরও বলেন, দেশব্যাপী যেন এটি ছড়িয়ে যায় সে লক্ষ্যেই এ ডিজিটাল হাট। আমরা এক লাখ গরু অনলাইনে বিক্রির টার্গেট নিয়েছি। গত বছর ২৭ হাজার গরু অনলাইনে বিক্রি হয়েছিল, এবার একটু বড় টার্গেট নিচ্ছি। গতবার গরু বিক্রির কোনো পলিসি ছিল না, এবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনলাইনে গরু বিক্রির জন্য একটি পলিসি তৈরি করা হয়েছে। এই পলিসিগুলো মেনে যাতে সবাই গরু বিক্রি করতে পারে সে বিষয়টি আমরা হাইলাইট করতে চাই।
তিনি বলেন, ‘পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাগজের বিষয়ে ইন্সট্রাকশন দেয়া হবে কিন্তু সেটি কতটুকু নিশ্চিত করা যাবে সেটি ডিফিকাল্ট একটি বিষয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে সেটির সার্টিফিকেট নিয়ে অনলাইনে আপ করার মতো কালচার বাংলাদেশে সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এটা শুরু হচ্ছে, ধীরে ধীরে হয়তো সামনের দিনগুলোতে আরও ভালোভাবে করা সম্ভব হবে। কিছুটা সমস্যা হলেও সবাইকে চেষ্টা করতে হবে, কারণ কাস্টমারেরও তো রাইটস আছে। গত বছর দেখেছি অনেক গরু বিক্রি হয়েছে কিন্তু সেটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করেই কাস্টমারের কাছে চলে এসেছে। ক্ষুরা রোগসহ অন্যান্য সমস্যা নিয়ে অসুস্থ গরু চলে এসেছে এমন অনেক সমস্যা হয়।’
তিনি বলেন, একটা গরু এতো দাম দিয়ে কেনার পর সেটার স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট না থাকলে একজন কাস্টমার সেই মুহূর্তে কী করবেন, তিনি তো অনলাইনে আগেই টাকা পরিশোধ করেছেন। এমন অনেক সমস্যা হচ্ছে বা হতে পারে বলেই এ ধরনের একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সময় মতো পশু ডেলিভারির বিষয়ে আমাদের কঠোর দিকনির্দেশনা রয়েছে, আমরা সেটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করবো।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, যেকোনো কাজের মধ্যেই ভালো-খারাপ কিছু থাকে। গত বছর অনলাইনে পশু বিক্রির বিষয়ে অভিযোগ যে খুব বেশি তা নয়, তারপরও মানুষের অভিযোগ টুকটাক থাকে। এ বছর পশুগুলোর যে তথ্য অনলাইনে আপলোড করা হবে সেক্ষেত্রে মানুষ যাতে প্রতারিত না হয় সেজন্য আমাদের উপজেলা লেবেলের অফিসারদের পশু বিক্রির সব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের জন্য বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, বিশেষ করে যে ওজনের কথা বলা হচ্ছে, দাম যেটা দেয়া হচ্ছে, কালার যেটা দেয়া হচ্ছে এটা যাতে সঠিক থাকে, সে বিষয়গুলো দেখার জন্য বলেছি। কেউ যদি এগুলো অমান্য করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং আপলোড বাতিল করা দেয়া হবে। দামের ক্ষেত্রেও আমরা কঠোর নজরদারি রাখব, সুতরাং খুব বেশি ঝামেলা হবে না। তারপরও কেউ ব্যত্যয় করলে আলাদা আইনকানুন তো আছেই। গত বছরের চেয়ে এ বছর আরও সুসংগঠিত হচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে এ বিষয়ে যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো আইডেন্টিফাই করে সমাধান করা হচ্ছে। এ বছর হয়তো আরও ভালোভাবে এটি করতে পারব।
তিনি আরও বলেন, করোনার যে অবস্থা এ পরিস্থিতির মধ্যে ফিজিক্যালি মানুষকে মার্কেটে নিয়ে যাওয়া জটিল হবে। সেজন্য এ বছর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে আরও জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছি। গত বছর কোরবানি উপলক্ষে প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকার গবাদিপশু বিক্রি হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর অনলাইনে পশু বিক্রির সংখ্যা বাড়ছে।
পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট বিষয়ে তিনি বলেন, এ বছর আমাদের প্রায় এক কোটি ১৯ লাখ কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে। আমি যদি এর সবগুলো ওভারনাইট হ্যাসেল ফ্রি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিতে পারব বলি সেটা ইম্পসিবল। কিন্তু আমরা চাচ্ছি, মেজরিটির যেন করা হয়। এটা হ্যাসেলফ্রি করার জন্য দুভাবেই কাজ করছি। একদিকে যারা আপলোড করবে অনলাইনে তাদের অনুরোধ করছি স্বাস্থ্য সনদ নিয়ে আপলোড করার জন্য। এতে তাদের যে গবাদিপশু তার অথেনটিসিটি মানুষের মধ্যে আস্থাটা বাড়বে। বাকি বিষয়গুলো নিজেরাই মনিটরিং করবো।
তিনি আরও বলেন, আমি যদি বলি- একদিনে এক কোটি ১৯ লাখ পশুর স্বাস্থ্য সনদ আমরা লোকজন দিয়ে দিতে পারব, সেটা সম্ভব না। মানুষজনের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য যাতে তার প্রোডাক্টের বিষয়ে মানুষ আগ্রহী হয় এবং আস্থা পায়। মানুষ যদি আগেভাগে এটি করে তাহলে দেখা যাবে যেটি আমরা এখন করছি আগামী বছর হয়তো বিক্রেতারা তিন মাস আগে থেকে পশুর স্বাস্থ্য সনদ নেয়ার চেষ্টা করবে।
অনলাইনে পশু বিক্রির বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, করোনা মহামারির কারণে সরকার অনলাইনে গবাদিপশুর ক্রয়-বিক্রয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রতিটি উপজেলায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে। জেলা-উপজেলায় স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে অনলাইনে গবাদিপশু বিক্রয়ের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ইতোমধ্যে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জনরা গবাদিপশু অনলাইনে আপলোডের আগে স্বাস্থ্য সনদ দেবে। এছাড়া অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে খামারিদের সংযুক্ত করা এবং ওজন অনুযায়ী পশুর দাম নির্ধারণের বিষয়ে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ দফতর ব্যবস্থা নেবে। এজন্য খামারিদের ডাটাবেজ তৈরি করেছে সংশ্লিষ্ট প্রাণিসম্পদ দফতর। খামারিরা যাতে অনলাইনে তাদের গবাদিপশু সহজে বিক্রি করতে পারে সেজন্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আইএইচআর/এআরএ/এসএইচএস/এমএস