গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৩০ লাখ টাকা সরালো কে?

বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) বিরুদ্ধে গ্রাহকের অজ্ঞাতে আমানত স্থানান্তরের অভিযোগ উঠেছে। ব্যাংকটির চট্টগ্রামের মুরাদপুর শাখার গ্রাহক মোহাম্মদ শামসুল হুদা এমন অভিযোগ করেছেন।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এই গ্রাহকের অভিযোগ অজ্ঞাতে তার হিসাব থেকে চলতি বছরের ১৮, ১৯ ও ২০ আগস্ট ১৭টি ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) মাধ্যমে ৩০ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। পরে এক লাখ টাকা হিসাবে ফিরে আসে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান বরাবর এ সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন মোহাম্মদ শামসুল হুদা। লিখিত অভিযোগের কপি অর্থ মন্ত্রণালয়েও এসেছে।
মোহাম্মদ শামসুল হুদা জানান, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের আগ্রাবাদ প্রধান শাখায় গিয়ে তিনি চলতি বছরের ২৭ জুলাই হিসাব খোলার ফরম নেন। ফরমটি নিজে পূরণ করার আগ্রহ দেখালে সংশ্লিষ্ট এক নারী কর্মকর্তা পূরণ করে দেবেন জানিয়ে ফরম পূরণ না করে কয়েকটি স্থানে শামসুল হুদার সই নেন। সেই সঙ্গে তার জাতীয় পরিচয়পত্র, ট্রেড লাইসেন্স, ট্যাক্স সার্টিফিকেটসহ যাবতীয় দলিলপত্রের ফটোকপি নেন।
অভিযোগপত্রে এই গ্রাহক উল্লেখ করেন, তিনি নগদ দুই হাজার টাকা এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ৪০ লাখ টাকার চেক ২৭ জুলাই মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের মুরাদপুর শাখায় জমা দিয়ে হিসাব খোলেন। হিসাবের ফরম পূরণের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের সর্বোচ্চ লিমিট ব্যতীত অন্য সব তথ্য ব্যাংক কর্মকর্তা পূরণ করেন।
তিনি জানান, নতুন আমানতকারী/গ্রাহক হিসেবে ডেবিড কার্ড, চেকবইসহ নানাবিধ প্রয়োজনে একাধিকবার ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ১২ আগস্ট পর্যন্ত কথা হয়। কিন্তু ১৮ আগস্ট জন্মাষ্টমীর সরকারি বন্ধ ছিল। ওই তারিখে বিকেল ৪টার পর থেকে তার মোবাইল নম্বরে কল ও এসএমএস আদান-প্রদানে সমস্যা হয়। প্রথমে তিনি মোবাইলের নেটওয়ার্কের সমস্যা মনে করেন। কিন্তু ১৯ আগস্ট শুক্রবার একই সমস্যার কারণে তার কাছে বিষয়টি সিমের সমস্যা মনে হয়। শুক্রবার কল সেন্টার বন্ধ থাকায় পরের দিন শনিবার (২০ আগস্ট) গ্রামীণ ফোন সেন্টারে গিয়ে জানতে পারেন তার মোবাইল একটি কোড নম্বর দিয়ে ব্লক করা হয়েছে।
ব্লক খোলার পর ওইদিন (২০ আগস্ট) তার মোবাইলে চারটি এসএমএস আসে। এতে দেখা যায় মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে তার অজ্ঞাতে টাকা স্থানান্তরিত হচ্ছে। তাৎক্ষণিক তিনি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এক কর্মকর্তাকে ফোন করেন। কিন্তু চারবার কল দিলেও ওই কর্মকর্তা ফোন রিসিভ করেননি। এরপর ১৬২১৯-এ কল করে তার হিসাবের সব ট্রানজেকশন বন্ধ করে দেন। পরে ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে ফোন দিলে ওই কর্মকর্তা জানান, ১৮-২০ আগস্ট ১৭টি ইএফটি ট্রানজেকশনের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা স্থানান্তর হয়েছে। অভিযোগপত্রে এমনটাই উল্লেখ করেন শামসুল হুদা।
তিনি অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, ২১ আগস্ট মুরাদপুর শাখায় গেলে শাখার ম্যানেজার যথাযথ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এরপর ওইদিনই স্থানীয় পাঁচশাইল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের মুরাদপুর শাখার ম্যানেজারের কাছে একটি দরখাস্ত দেন। মুরাদপুর শাখার ম্যানেজারের সহযোগিতায় স্থানান্তরিত ৩০ লাখ টাকার মধ্যে ১ লাখ টাকা তার হিসাবে ফিরে আসে।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, ২২ আগস্ট থেকে প্রতিদিন ব্যাংকের শাখাটিতে গেলে ম্যানেজার প্রতিবারই ‘ব্যবস্থা নিচ্ছি, টাকা স্থানান্তরিত ব্যাংকের হিসাবগুলোতে গচ্ছিত আছে’ মর্মে আশ্বাস দেন।
এছাড়া মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের চট্টগ্রামের প্রধান শাখায় আঞ্চলিক প্রধানের সঙ্গে ফোনে ও বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
তিনি অভিযোগ করেন, অর্থ উত্তোলনের সীমা নগদ হলে ২ লাখ টাকা এবং ট্রান্সফার হলে ১ লাখ টাকা ফরমে লিপিবদ্ধ হয়। একদিনে সর্বোচ্চ চারটি ট্রানজেকশন করা যাবে মর্মে ফরমে শর্ত দেওয়া আছে। কিন্তু প্রতারক ১৮ আগস্ট ৩ লাখ টাকার দুটি এবং দুই লাখ টাকার একটি ট্রানজেকশনসহ মোট ১০ লাখ টাকার সাতটি ট্রানজেকশন করে।
বিএফআইইউ’র প্রধান বরাবর অভিযোগ করেছেন গ্রাহক-ফাইল ছবি
একইভাবে ১৯ আগস্ট ৩ লাখ টাকার দুটি ও ২ লাখ টাকার একটি ট্রানজেকশনসহ ১০ লাখ টাকার ৫টি ট্রানজেকশন করে। ২০ আগস্ট ৩ লাখ টাকার দুটি ও ২ লাখ টাকার একটি ট্রানজেকশনসহ ১০ লাখ টাকার পাঁচটি ট্রানজেকশন করে। আমানতকারীর হিসাব ফরমের লিমিট ক্রস হলে তো টাকা ট্রান্সফার হওয়ার কথা নয়। লিমিট বাড়াতে হলে আমানতকারী তথা গ্রাহকের স্বাক্ষর আবশ্যক বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন শামসুল হুদা।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, প্রতারক ১৮, ১৯ ও ২০ আগস্ট বন্ধের দিনে এমন অভিনব প্রতারণা করেছে। আমি ব্যাংকের নতুন আমানতকারী- এ হিসেবে বিষয়টি কেন ব্যাংকের নজরে এলো না?
এছাড়া আমানতকারী হিসাব খোলার পর একটিও অনলাইন ট্রানজেকশন সম্পন্ন না করা এবং কোনো প্রকার গোপন নম্বর বা পাসওয়ার্ডও যুক্ত না করার পরও বন্ধের দিন এমন অস্বাভাবিক ট্রানজেকশনেও কেন ব্যাংক সার্ভারে সমস্যা পরিলক্ষিত হয়নি? তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এই গ্রাহক।
তিনি বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে স্থানান্তরিত ৩০ লাখ টাকার মধ্যে ২২ আগস্ট ১ লাখ টাকা গ্রাহকের হিসাবে ফিরে আসাই প্রতারণার সাক্ষ্য বহন করে। তাহলে অবশিষ্ট ২৯ লাখ টাকা ফিরিয়ে আনতে কেন সহযোগিতা পাচ্ছি না।
গ্রাহকের এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক প্রধান মাহামুদ আকতার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের একটি বিষয় ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করছে। আমাদের ব্যাংকও তদন্ত করছে। এটা এখনো কনক্লুশন হয়নি (তদন্ত শেষ হয়নি)। বিষয়টি এখন তদন্তাধীন।’
ইএফটি’র মাধ্যমে সরানো হয়েছে ৩০ লাখ টাকা- সংগৃহীত ছবি
গ্রাহক অভিযোগ করেছেন, হিসাব ফর্মে তার লেনদেনের সর্বোচ্চ যে সীমা ছিল তা অতিক্রম করে টাকা সরিয়ে নেয়া হয়েছে? এটা কীভাবে হলো? এমন প্রশ্নে উত্তরে তিনি বলেন, ট্রানজেকশন প্রোফাইলে গ্রাহকের কাছ থেকে একটা ডিক্লারেশন নেওয়া হয়। কিন্তু এই ট্রানজেকশন অনেক সময় কম-বেশি হয়। কেউ অ্যাকাউন্ট খোলার সময় নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন না তার কতো টাকা ট্রানজেকশন হবে।
বন্ধের দিন টাকা স্থানান্তরের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে বন্ধের দিন লেনদেন বন্ধ থাকে না।
এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি মোবাইলে এসএমএস পাঠানো হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
এমএএস/এসএইচএস/জিকেএস