গণঅভ্যুত্থানে পাঁজরে গুলিবিদ্ধ
এসএসসি পাস করলেও সৈনিক হওয়ার স্বপ্ন মলিন জুবায়েরের
এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৩ দশমিক ৩৯ পেয়ে পাস করেছে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পাঁজরে গুলিবিদ্ধ মো. জুবায়ের আহম্মেদ। রাজধানীর তুরাগের কামারপাড়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল জুবায়ের।
বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) দুপুরে প্রকাশিত ফলাফলে সে এ ফল অর্জন করে। কামারপাড়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিউটি আক্তার শ্যামলী জাগো নিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিউটি আক্তার শ্যামলী বলেন, জুবায়ের গণঅভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। তারপরও সে পড়ালেখা চালিয়ে গেছে। মানবিক বিভাগ থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে। পরীক্ষার ফলাফল জানতে আজ সে স্কুলে এসেছিল। ভালো ফল করায় শিক্ষকরা তাকেসহ উত্তীর্ণদের মিষ্টিমুখ করিয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকেও দমে না গিয়ে ভালো ফল করায় তাকে নিয়ে আমরা গর্বিত।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান চলাকালে গত বছরের ৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে উত্তরায় বিএনএস সেন্টারের সামনে গুলিবিদ্ধ হন জুবায়ের আহম্মেদ। চিকিৎসকদের তথ্যমতে, গুলি তার পাঁজরের নিচের অংশ ভেদ করে পাকস্থলী স্পর্শ করে বাঁ পাশে আটকে যায়।
দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকার পরও এসএসসি পাস করায় খুশি জুবায়ের আহম্মেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘রেজাল্টটা আরেকটু ভালো হলে আরও খুশি হতাম। তারপরও যেটা হয়েছে, তা নিয়ে আমি খুশি। মা-বাবাও খুশি।’
- আরও পড়ুন
এসএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশ, পাসের হার ৬৮.৪৫
কারিগরি বোর্ডে পাসের হার ৭৩.৬৩ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেলেন ৪৯৪৮
দাখিলে পাসের হার ৬৮.০৯, জিপিএ-৫ পেলেন ৯০৬৬ জন
জুবায়েরের বাবা মো. জাকির হোসেন পেশায় গাড়িচালক। মা জেসমিন আক্তার গৃহিণী। বাবা-মায়ের সঙ্গে রাজধানীর তুরাগ থানার কামারপাড়া এলাকায় বসবাস করেন জুবায়ের। তার একমাত্র বোন জাকিয়া বিবাহিত। থাকেন রাজধানীর বাড্ডা এলাকায়।
সেনাবাহিনীতে চাকরির স্বপ্ন মলিন জুবায়েরের
জুবায়েরের উচ্চতা ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। স্বপ্ন ছিল সেনাবাহিনীতে চাকরি করবেন। সেজন্য এসএসসি পাস করতে হবে। হবে পরিবারের আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় মাঝে দুই বছর তিনি এসএসসি পরীক্ষায় বসতে পারেননি। এবার ফরম পূরণ করে পরীক্ষায় বসেন তিনি। পাসও করেছেন।
তবে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুই দফা অস্ত্রোপচারের কারণে সৈনিক হওয়ার স্বপ্ন এখন মলিন তার। জুবায়ের বলেন, প্রথম দফা অপারেশনে গুলি বের করতে পারেননি চিকিৎসকরা। প্রথম পাঁজরের ভাঙা হাড়টা ঠিক করা হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় গুলি বের করা হয়।
এসএসসির ফল প্রকাশের পর বন্ধুদের সঙ্গে জুবায়ের আহম্মেদ (বাম পাশ থেকে চতুর্থ, কালো শার্ট পরিহিত)
তিনি বলেন, ‘প্রায় সাড়ে ১০ মাস তো হয়ে গেলো। এখনো শরীরে অসহনীয় যন্ত্রণা হয়। ১০ এপ্রিল যখন এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়, তখন শারীরিক অবস্থা আরও বেশি খারাপ ছিল। তারপরও বহু কষ্টে সবগুলো পরীক্ষা দিয়েছি। শিক্ষকরাও আমাকে সহযোগিতা করেছেন।’
পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান জানিয়ে জুবায়ের বলেন, ‘দুটো অপারেশন করা হয়েছে। সেনাবাহিনীতে তো আর যোগ দেওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে না। অনেকে পরামর্শ দিয়েছেন, সেনাবাহিনীতে তবু আবেদন করতে। দেখি, আবেদন করে দেখবো কী হয়। তবে পড়াশোনা আর ছাড়তে চাই না। আমি ভিডিওগ্রাফি ভালো পারি। ভালো ক্যামেরা পেলে এ কাজ করে কিছু আয় করতে পারবো।’
একবার গুলিতে আহত হওয়ার পরও আন্দোলনে যান জুবায়ের
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে একবার পায়ে গুলিবিদ্ধ হন জুবায়ের। তারপরও আবার আন্দোলনে যোগ দেন। সেই সময়ের ঘটনা সম্পর্কে জুবায়ের বলেন, জুলাইয়ের শেষদিক স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমি এবং আমার বন্ধু নাঈম আন্দোলনে যোগ দিই। ১৮ জুলাই মীর মুগ্ধ ভাই শহীদ হন। এতে প্রচণ্ড ক্ষোভ মনে দানা বাঁধে।
- আরও পড়ুন
গণিতের ভরাডুবিতে এসএসসিতে ফল ‘বিপর্যয়
এসএসসির ফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন শুরু শুক্রবার
কাউকে বাড়তি নম্বর দেওয়া হয়নি, এটিই প্রকৃত ফল: চেয়ারম্যান
শহীদ মুগ্ধ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কাউট গ্রুপের সদস্য ছিলেন। ২০২২ সাল থেকে ওই একই গ্রুপের সদস্য জুবায়ের। তিনি বলেন, আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পর ২ আগস্ট আমার পায়ে ছররা গুলি লাগে। সেটা ততটা গুরুতর ছিল না। ৪ আগস্ট সকাল ১০টায় অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বের হই।
এদিন দুপুর ১২টার দিকে বুকের হাড়ে ভারী কিছু আঘাত করার মতো অনুভূত হয়। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। শার্ট খুলে ফেললাম। শার্ট খুলে দেখি, বুকে ছিদ্র। কয়েক সেকেন্ড পর রক্ত পড়া শুরু হলো। শরীরের সব শক্তি দিয়ে পাঁচ-সাত পা দৌড়ে বন্ধুর কাছে গিয়ে বলি, দোস্ত, আমার গুলি লেগেছে। এটা বলেই নিচে পড়ে যাই।’
তিনি বলেন, পরে শুনেছি- কখনো অচেতন ছিলাম, কখনো জ্ঞান ছিল। আমাকে শিক্ষার্থীরা কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার পর আরেকটি বড় হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অক্সিজেন ও রক্ত দেওয়া হয়। পরীক্ষা করে শনাক্ত করা হয় গুলিটি কোথায় আটকে আছে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
‘কিন্তু তারা উত্তরায় অন্য একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে এমআরআইসহ (ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং) বেশ কয়েকটি পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে অস্ত্রোপচারের জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়। কিন্তু পরে ঝামেলার ভয়ে অস্ত্রোপচার না করেই পরীক্ষা–নিরীক্ষা বাবদ ১৯ হাজার টাকা বিল ধরিয়ে দেয়। অনেক দেনদরবার করে ওই হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা ৭টা বেজে যায়।’
জুবায়ের বলেন, ‘৫ আগস্ট হাসপাতালের একটি বেডে ঘুমের মধ্যে শুনতে পাই যে, কেউ একজন বলছেন শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। পরে এক ভাই এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, তোমার রক্ত বৃথা যায়নি। আমি তখনো ভালোভাবে চোখ খুলতে পারছিলাম না। যা শুনছি, তা ঠিক কি না বুঝতে পারছিলাম না। সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছিল।’
জুবায়েরের মা জেসমিন আক্তার বলেন, ‘ছেলে পাস করায় আমরা খুব খুশি হয়েছি। বাবার অনেক ঋণ আছে। ওর বাবা ছেলের পড়ালেখার পেছনে খরচ করতে পারেন না। জুবায়ের নিজের চেষ্টায় এ পর্যন্ত হয়েছে। ছেলেটা এখনো পুরোপুরি সুস্থ না। কিন্তু ও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওর চেষ্টা দেখে আমরা ভরসা পাচ্ছি।’
এএএইচ/এমএএইচ/জেআইএম