জুলাইয়ে গুলিবিদ্ধ আকাশ মিয়া

যে আশা নিয়ে আন্দোলনে গিয়েছিলাম, পুরোপুরি পূরণ হয়নি

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:১০ পিএম, ০৪ আগস্ট ২০২৫
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে এক পা হারিয়েছেন নেত্রকোনার মদন উপজেলার আকাশ মিয়া/জাগো নিউজ

২০২৪ সালের ২০ জুলাই। নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডে গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল মিছিলে ছিলেন আকাশ মিয়া। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ এক সাথীকে নিরাপদ স্থানে রেখে ফিরছিলেন কর্মস্থলে। সেখানেই ঘটে জীবনের ভয়াবহ মোড়।

পুলিশের দুজন সদস্য দোকানে এসে শটগান দিয়ে আকাশকে লক্ষ্য করে গুলি করে। বাঁ পায়ের হাঁটুতে সরাসরি আঘাত লাগে। আশপাশের কয়েকজন বড় ভাই প্রথমে তাকে স্থানীয়ভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে একটি ভ্যানগানে করে কাঁচপুর পর্যন্ত নিয়ে যান। কাকতালীয়ভাবে সেখানে একটি অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়, যা ঢাকায় হৃদরোগ হাসপাতালে এক রোগী নিয়ে যাচ্ছিল। সেই অ্যাম্বুলেন্সে করেই শুরু হয় তার ঢাকার দিকে যাত্রা।

নেত্রকোনার মদন উপজেলার বাসিন্দা ২৩ বছর বয়সী আকাশকে প্রথমে নেওয়া হয় শ্যামলীর ডক্টরস কেয়ার হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয় পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। শুরুতেই ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। মাত্র দুদিনেই বিল দাঁড়ায় প্রায় তিন লাখ টাকা, অতিরিক্ত খরচ আরও ৫০ হাজার টাকা। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়, সেখানে চিকিৎসা সম্ভব নয়।

একের পর এক রেফারাল শেষে আকাশ মিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। পরে ট্রমা সেন্টার, বাংলাদেশ মেডিকেল হয়ে শেষে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর)। গত বছরের ২৩ জুলাই নিটোরে তার পা কেটে ফেলা হয়।

আরও পড়ুন

গোটা সময়ে হুমকির ভয়ে চুপ ছিলেন মিষ্টির দোকানের কর্মচারী আকাশ। বলা হয়েছিল, গুলি করে মেরে ফেলবে। অবশেষে ১ আগস্ট হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়ে গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় ফিরে যান তিনি।

আকাশ মিয়া আজ এক পা হারিয়ে, সম্মানহীন জীবনের গ্লানিতে, নীরবে লড়াই করে যাচ্ছেন—একটি ন্যায্য ভবিষ্যতের জন্য।

যেভাবে পাশে দাঁড়ায় ব্র্যাক

নিটোরে চিকিৎসা নেওয়ার সময় আকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্র্যাকের লিম্ব অ্যান্ড ব্রেস সেন্টারের (বিএলবিসি) কর্মীরা। তারা তখনই আশ্বস্ত করেন, বিনামূল্যে কৃত্রিম পা সংযোজন করে দেবেন। পরে নিজেরাই যোগাযোগ করে পা সংযোজন করে দেন।

যে আশা নিয়ে আন্দোলনে গিয়েছিলাম, পুরোপুরি পূরণ হয়নি

শুধু আকাশ মিয়া নন, এ পর্যন্ত ৩৪ জনের শরীরে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে উন্নতমানের কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন করেছে বিএলবিসি। চিকিৎসাসেবা দিয়েছে ১৮৪ জনকে। মানসিক অবস্থার উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, সহযোগিতা করছে। আগামী পাঁচ বছর বিনামূল্যে এ সেবা দেবে বিএলবিসি। এতে তাদের বাজেট ১২ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

একটা জব হলেই ভালো হতো

চিকিৎসার সময়ে কিছু সহায়তা মিললেও তা পর্যাপ্ত ছিল না। ‘জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে একবার এক লাখ টাকা পেয়েছি। দ্বিতীয়বার আবেদন করিনি। এত দুর্নীতি হচ্ছে যে, আর যেতে মন চায় না,’ বলেন আকাশ মিয়া। এছাড়া জেলা প্রশাসকের অফিসের মাধ্যমে আরও এক লাখ টাকা পেয়েছেন বলে জানান তিনি।

আকাশ মিয়া বর্তমানে বেকার। আগে ঢাকার উত্তর বাড্ডার সাতারকুলে মেসে থাকতেন, এখন গ্রামে। কম্পিউটারে কোর্স করেছেন, কোম্পানির চাকরির খোঁজে আছেন।

আকাশ মিয়া বলেন, ‘একটা জব হলেই ভালো হতো। সাত ভাইবোনের মধ্যে আমি বড়, একমাত্র উপার্জনকারী। বাবা কৃষিকাজ করেন। পরিবারের সব দায়িত্ব আমার কাঁধেই ছিল। সরকার থেকে প্রাপ্য সবকিছু পেলেও হয়তো ঘুরে দাঁড়ানো যেত। নিজের ওয়াশরুমের জন্য হাই কমোড দরকার, কিন্তু সেটাও পাইনি। যারা দৌড়ঝাঁপ করতে পারে, চিল্লাতে পারে, তারাই পাচ্ছে।’

আরও পড়ুন

হতাশার মধ্যেও আছে আশা

বর্তমানে অনেক আন্দোলনকারী কিছু হলেই নিটোরের সামনে গিয়ে অধিকার চান। কিন্তু আকাশ নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। বলেন, ‘মানুষ এখন খোঁজ নেয় না, সম্মানও দেয় না। এখনই যদি না দেয়, সামনে তো মোটেও দেবে না।’

তবে হতাশার মধ্যেও কিছুটা আশা দেখছেন আকাশ। ‘যে আশা নিয়ে আন্দোলনে গিয়েছিলাম, সেটা পুরোপুরি পূরণ হয়নি। তবে আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম কিছুটা কমেছে।’ বলছিলেন আকাশ।

এসইউজে/এমএমএআর/ এমএফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।