থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, নিহত ২
দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে ফের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুই দেশ থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সেনাবাহিনী। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) ভোরে উত্তর-পশ্চিম কম্বোডিয়ার ওদ্দার মিনচে প্রদেশে অবস্থিত বিতর্কিত তা মোয়ান থম মন্দিরের কাছে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে থাইল্যান্ডে কমপক্ষে দুই বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন ও থাই সেনাবাহিনীর অন্তত দুই সদস্য আহত হয়েছেন।
থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনী জানায়, সংঘর্ষ শুরু করে কম্বোডিয়ান বাহিনী। তাদের দাবি, কম্বোডিয়ার সেনারা একটি নজরদারি ড্রোন মোতায়েনের পর ভারী অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ চালায়, যার মধ্যে ছিল আর্টিলারি ও দূরপাল্লার বিএম২১ রকেট।
থাই সেনাবাহিনীর মুখপাত্র রিচা সুকসুয়ানন সাংবাদিকদের জানান, অন্তত দুই সেনা আহত হয়েছেন। অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের সুরিন প্রদেশের এক জেলা প্রশাসক সুত্তিরোৎ চারুয়েনথানাসাক রয়টার্সকে বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে কম্বোডিয়ান গোলাবর্ষণে অন্তত দুই বেসামরিক নাগরিক নিহত হন ও আরও কয়েকজন আহত হন।
৪০ হাজার মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে
থাই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সীমান্ত এলাকার ৮৬টি গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার বাসিন্দাকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় প্রশাসন।
কম্বোডিয়ার পাল্টা অভিযোগ: ‘আমরা আত্মরক্ষায় পাল্টা জবাব দিয়েছি’
এক বিবৃতিতে কম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, থাইল্যান্ডই প্রথমে আক্রমণ চালায়। তারা বলছে, নিজেদের সেনাদের ওপর হামলা হলে কম্বোডিয়ান বাহিনী আত্মরক্ষার্থে পাল্টা জবাব দেয়।
কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হুন সেন সামাজিক মাধ্যমে বলেন, থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী ওদ্দার মিনচে ও প্রেয়াহ ভিহেয়ার প্রদেশে গোলাবর্ষণ করেছে। তিনি বলেন, কম্বোডিয়ান সেনাবাহিনীর লড়াই করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।
তবে তিনি জনগণকে শান্ত থাকতে বলেন ও চালসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের অযৌক্তিক মজুত বা আতঙ্কিত হয়ে কেনাকাটায় না যেতে আহ্বান জানান।
পরে কম্বোডিয়ায় অবস্থিত থাইল্যান্ডের দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানায়, সীমান্ত পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হচ্ছে ও এই সংঘর্ষ ‘দীর্ঘস্থায়ী ও বিস্তৃত’ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কম্বোডিয়ায় অবস্থানরত থাই নাগরিকদের, যারা অত্যাবশ্যক কারণে সেখানে নেই, তাদের ‘যত দ্রুত সম্ভব দেশ ছাড়ার’ পরামর্শ দেওয়া হলো।
এফ-১৬ যুদ্ধবিমান মোতায়েন, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের পথে দুই দেশ
এই ঘোষণার পরপরই থাই সেনাবাহিনী জানায়, তারা সীমান্ত এলাকায় কম্বোডিয়ান বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতে একটি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে।
এই সংঘর্ষের মাত্র একদিন আগে এক থাই সেনা সীমান্তে পুঁতে রাখা একটি ল্যান্ডমাইনের বিস্ফোরণে তার একটি পা হারান। এছাড়া ১৬ জুলাই আরও তিন সেনা মাইন বিস্ফোরণে আহত হন।
থাই কর্তৃপক্ষ এই মাইন পুঁতে রাখার জন্য কম্বোডিয়াকে দায়ী করলেও, কম্বোডিয়া তা অস্বীকার করে বলেছে, থাই সেনারা নির্ধারিত গহিন জঙ্গলের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পুরোনো যুদ্ধকালীন বিস্ফোরকে পা রেখেছিলেন।
এ ঘটনার পর থাইল্যান্ডের ক্ষমতাসীন ফেউ থাই পার্টি জানায়, তারা কম্বোডিয়ায় নিযুক্ত থাই রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে আনছে ও থাইল্যান্ডে নিযুক্ত কম্বোডিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করা হবে। পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ‘ডাউনগ্রেড’ করা হয়েছে।
কম্বোডিয়ার পাল্টা সিদ্ধান্ত ও বাণিজ্যিক অবরোধ
এর জবাবে কম্বোডিয়াও থাইল্যান্ডে তাদের সব কূটনীতিককে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় ও থাই কূটনীতিকদের দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেয়। দেশটি জানিয়েছে, দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ‘নিম্নতম পর্যায়ে’ নামিয়ে আনা হয়েছে- যা এখন কেবল দ্বিতীয় সচিব পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকবে।
এরই মধ্যে কম্বোডিয়া থাইল্যান্ড থেকে জ্বালানি, গ্যাস, ফলমূল ও সবজি আমদানিও বন্ধ করে দিয়েছে। সীমান্তে বিভিন্ন চেকপোস্টও বন্ধ রাখা হয়েছে।
দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ ফের রক্তাক্ত রূপে
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে ৮১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ স্থল সীমান্তের বহু অংশ আজও সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত হয়নি। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই সীমান্ত অঞ্চল নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে বিরোধ চলছে। এর আগে গত মে মাসেও এই সীমান্ত বিরোধ ঘিরে সংঘর্ষে একজন কম্বোডিয়ান সেনা নিহত হন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের চলমান উত্তেজনা এখন সামরিক সংঘর্ষ ও কূটনৈতিক অবনতির দিকেই এগোচ্ছে, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
সূত্র: আল জাজিরা
এসএএইচ