টিকাদানের কিটে গুটি বসন্ত নির্মূলের নতুন বোঝাপড়া

নভেল করোনাভাইরাস মহামারিতে বিপর্যস্ত বিশ্ব। মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপনে হঠাৎ ছন্দপতনকারী এই ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকিসন আবিষ্কারের প্রতিযোগিতায় মগ্ন রয়েছেন বিশ্বের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রতিযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। এর মাঝে বিশ্ব থেকে সংক্রামক ব্যাধি ‘গুটি বসন্ত’ সফলভাবে নির্মূলের অভিজ্ঞতার দিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। গুটি বসন্তের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যবহৃত প্রাথমিক ভ্যাকসিনগুলোর ব্যাপারে জানছেন তারা।
রোববার জিনোম বায়োলজিতে প্রকাশিত ম্যাক মাস্টার ইউনিভার্সিটি, মাটার মিউজিয়াম এবং ইউনিভার্সিটি অফ সিডনির বিজ্ঞানী এবং ইতিহাসবিদদের নতুন এক গবেষণায় গৃহযুদ্ধকালীন যুগে মানুষকে রক্ষার জন্য গুটি বসন্তের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যবহৃত পাঁচটি ভ্যাকসিন স্ট্রেন শনাক্ত করা হয়েছে।
মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, ভাইরাসজনিত রোগ গুটি বসন্তের কারণে মানুষের সারা শরীরে ফুসকুড়ি উঠতো। এই রোগে আক্রান্তদের প্রায় ৩০ শতাংশই মারা যেতেন।
১৭৯৬ সালে ব্রিটিশ জীবাণু গবেষক এডওয়ার্ড অ্যান্টনি জেনার গুটি বসন্তের টিকার পরীক্ষা চালান। সেই সময় দুধ দোয়ায় এমন গোয়ালিনীরা গরুর বসন্তে আক্রান্ত হলেও তাদের মধ্যে প্রাণঘাতী গুটি বসন্তের সংক্রমণ একেবারেই বিরল ছিল। সে সময় গুটি বসন্ত ছিল সবচেয়ে ভয়ানক সংক্রামক ব্যাধি।
ওই বছর জেমস ফিপস নামে আট বছর বয়সী এক ছেলের ওপর এক পরীক্ষা চালান ডা. জেনার। তিনি গরুর বসন্ত থেকে পুঁজ সংগ্রহ করে ইনজেকশন দিয়ে তা ওই ছেলের দেহে প্রয়োগ করেন। কিছুদিন পর জেমস ফিপসের দেহে গরুর বসন্তের লক্ষণ ফুটে ওঠে। রোগ ভালো হয়ে যাওয়ার পর তিনি ছেলেটির দেহে গুটি বসন্তের জীবাণু ঢুকিয়ে দেন।
এতে দেখা যায়, জেমস ফিপসের শরীরে গুটি বসন্ত সংক্রমণ ঘটাতে পারেনি। গরুর বসন্তের জীবাণু তাকে আরও মারাত্মক গুটি বসন্ত থেকে রক্ষা করেছে।
ড. জেনারের এই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় ১৭৯৮ সালে। বিশ্ব এই প্রথম ভ্যাকসিন শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয়। জেনারের প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং আধুনিক ও মানসম্মত টিকাদান চর্চার মধ্যে ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বিশ্ব থেকে গুটি বসন্ত নির্মূলের ঘোষণা দেয়। চিকিৎসকরা মানুষ থেকে মানুষে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করলেন। তখন একজনের দেহ থেকে সংক্রামক পদার্থ সংগ্রহ করে সুস্থ-সবল মানুষের শরীরে তা প্রয়োগ করে রোগ প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া যাচাই করা হয়।
জিনোম বায়োলজিতে প্রকাশিত গবেষণায় পরীক্ষিত ভ্যাকসিন কিটগুলোর মধ্যে এ ধরনের উপাদান পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়েছে। গবেষক দুগান বলেন, আমরা এসব উপাদন থেকে যেসব অনু সংগ্রহ করেছি সেগুলো খুবই নিম্নমানের। সেগুলো অক্ষত ভাইরাস বা জিনোম নয়। বরং সেগুলোর ডিএনএর ছোট ছোট টুকরো; যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, সক্রিয় ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি আছে কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সিডিসি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিল। কিন্তু গবেষকদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় ছিল- আধুনিক ডিএনএ’র দূষণ থেকে কিটগুলোকে রক্ষা করা। দুগান বলেন, প্রাচীন একটি ডিএনএ ক্লিনরুমের ভেতরে পুরো গবেষণা কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছে; যেখানে নমুনাগুলো রক্ষার জন্য আমরা তাইভেক স্যুট, মাস্ক এবং গ্লোভস পড়েছিলাম।
মার্কিন এই গবেষক বলেন, অনুগুলো সংগ্রহ করার পর আমরা ডিএনএর টুকরো বিশুদ্ধ এবং সেগুলোর সিকোয়েন্স করতে সক্ষম হই। এর মাধ্যমে ভ্যাকসিনে ব্যবহৃত ভাইরাস শনাক্ত করার জন্য আমরা জিনোমগুলো একত্রিত করতে শুরু করি।
দশকের পর দশক ভুল ড্রয়ারে পড়ে ছিল কিটগুলো
ভ্যাকসিন কিটগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার কলেজ অফ ফিজিশিয়ান্সের মাটার মিউজিয়ামের ফ্লেবোটোমি বিভাগের একটি ড্রয়ারে পাওয়া গেছে। এসব কিটের বাইরের অংশটা দেখতে রক্তসংগ্রহ করার সিরিঞ্জের মতো। এগুলো যে দশকের পর দশক ড্রয়ারের ভেতরে কাটিয়ে দিয়েছে সেটি পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়।
গবেষক দলের সদস্য ও মাটার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আনা ঢোদি বলেন, আমি আনন্দিত যে আমরা সেগুলো খুঁজে পেয়েছি এবং এটি আমাদের বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের পথে নিয়ে গেছে।
কিটগুলো খোলার পর দেখা যায়, সেগুলো শরীর থেকে রক্তক্ষরণের কাজে ব্যবহৃত হতো। গুটি বসন্তে আক্রান্তদের সৃষ্ট ফুসকুড়ি এবং নাসিকা থেকে নুমনা সংগ্রহের টিনের বাক্স এবং গ্লাসের স্লাইডও পাওয়া যায়।
করোনাভাইরাসের পুরোপুরি হুমকিতে নতুন গবেষণা
বিজ্ঞানীরা কিটগুলোতে থাকা খোস পাঁচড়ার ডিএনএ এবং যন্ত্রপাতি ও টিনের বক্স থেকে অন্যান্য সংশ্লিষ্ট অনুকণা উদ্ধার করেন। এসব কিছুই করা হয় অ-ধ্বংসাত্মক উপায়ে- অর্থাৎ নমুনা অক্ষত রেখে গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন তারা।
আনা ঢোদির মতে, বিশ্বজুড়ে যাদুঘরের নিজস্ব সংগ্রহশালা নিয়ে নতুন উপায়ে গবেষণার পথ সুগম করতে পারে তাদের এই গবেষণা প্রক্রিয়া। তিনি বলেন, এতে চিকিৎসাও মিলতে পারে, নিরাময়ও মিলতে পারে।
করোনাভাইরাস মহামারির অর্থনৈতিক প্রভাব কীভাবে মেডিক্যাল যাদুঘরগুলোকে টিকে থাকার ঝুঁকিতে ফেলেছে সেব্যাপারে কথা বলেন আনা। তিনি বলেন, মহামারির কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রত্যেকটি মেডিক্যাল যাদুঘরে থাকা তথ্যগুলো চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার খুবই সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, এটি ভীতিকর, কারণ সেগুলো আমাদের কি দিতে পারে সেব্যাপারে এখনও আমরা অনুসন্ধান করিনি।
ভাইরাস নির্মূলে সম্ভাব্য বহু সমাধান
গৃহযুদ্ধকালীন-যুগের চিকিৎসকরা ভাইরাসের স্ট্রেইন বাণিজ্যিক ভ্যাকসিনে কীভাবে ব্যবহার করেছিলেন গবেষণায় সেটিও দেখা গেছে। সেই ভ্যাকসিনে ১৯৭০ এবং ১৯৮০ সালের দিকে গুটি বসন্তকে কার্যকরভাবে নির্মূল করা সম্ভব হয়।
গবেষক দুগান বলেন, আমাদের গৃহযুদ্ধ যুগের এবং বিশ শতকের সব ভ্যাকসিনই ভাইরাস থেকে তৈরি। তবে (আমাদের ভ্যাকসিনগুলো) তৎকালীন বাণিজ্যিক ভ্যাকসিনগুলোর কোনোটির মতো নয়।
বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিনের স্ট্রেইন নিয়ে গবেষণা কেন উপকারী হতে পারে সেব্যাপারে ম্যাক মাস্টার ডিএনএ সেন্টারের পরিচালক ও গবেষক দলের সদস্য হেনরিক পোইনার বলেন, ১৯ শতকের তুলনায় বর্তমান সময়ে ভ্যাকসিন এবং ওষুধ আবিষ্কার একেবারে ভিন্ন। তবে বহু ভ্যাকসিনের উত্স এবং তৈরির কৌশল অনুসন্ধানে নতুন সম্ভাবনা মিলতে পারে।
তিনি বলেন, এই কাজটি ভ্যাকসিনের বিভিন্ন স্ট্রেইনের বৈচিত্রতায় নজর দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে। ফ্লু অথবা করোনাভাইরাসের মতো বিভিন্ন ভাইরাস থেকে কোন ভ্যাকসিন মানুষকে সুরক্ষা দেবে সেটি আমরা জানি না।
ভ্যাকসিনের শক্তি
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের জন্য পুরো বিশ্ব এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। গবেষক দুগান বলেন, অতীতের টিকাদান প্রচেষ্টার সাফল্য এবং শিক্ষা উদযাপন করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, আমি মনে করি কোভিড-১৯ এবং গুটি বসন্ত নির্মূলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো- এই ভাইরাস নির্মূলে বৃহত্তর জনসাধারণের কল্যাণে বৈশ্বিক সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে তিনি বলেন, গুটি বসন্ত নির্মূল শুরু হয়েছিল চিকিৎসকদের হাত ধরে; যারা জানতেন যে, তাদের কাছে একটি প্রক্রিয়া আছে, যেটি কাজ করে। তবে কেন কাজ করছে সেটি তারা বুঝতেন না। কিন্তু তারা জানতেন, এটি মানুষের জীবন বাঁচায়।
এমনকি ভাইরাস এবং জীবাণু তত্ত্ব গঠনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনের আগেও চিকিত্সকরা গুটি বসন্তের বিরুদ্ধে যৌথভাবে লড়াই করেছিলেন। বৈশ্বিক পরিসরে তথ্য ভাগাভাগির ব্যাপারে সর্বোত্তম চর্চা করতেন তারা। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের গবেষণায় এডওয়ার্ড জেনার এবং তৎকালীন চিকিৎসকদের কাজ অনুপ্রেরণা হতে পারে বলে মনে করেন দুগান।
এসআইএস/পিআর