মহামারি কী অফিসকে গিলে খাবে?
মহামারিকালে কাজের ধরন বদলেছে। মানুষ ঘরে বসে কাজ করছেন গত কয়েক মাস। বিশ্বের বড় বড় টেক জায়ান্ট থেকে শুরু করে অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের আগামী বছর পর্যন্ত বাড়িতে বসেই কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। অফিসের রুপান্তরিত এই ধরন নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট।
বেশিরভাগ লোক রুটিন ও নিয়ম মেনে অফিস করেন। তবে সম্প্রতি এটি দ্রুত অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং উত্তপ্ত বিতর্কের উৎস হয়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপী কর্মী, মালিক, বাড়িওয়ালা এবং সরকারগুলো অফিস অচল হয়ে পড়লে কাজ কীভাবে হবে তার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং তারা মূলত এ নিয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করছে।
ফ্রান্সের প্রায় ৮৮ শতাংশ অফিসকর্মী তাদের ডেস্কে ফিরেছেন। তবে ব্রিটিশদের মধ্যে তা ৪০ শতাংশেরও কম। টুইটারের প্রধান নির্বাহী জ্যাক ডরসি বলেছেন, কোম্পানির কর্মীরা বাড়ি থেকে ‘চিরকালের জন্য’ কাজ করতে পারেন। তবে নেটফ্লিক্সের প্রতিষ্ঠাতা রিড হেস্টিংস বলেছেন যে, হোম-ওয়ার্কিং ‘প্রকৃত অর্থে নেতিবাচক’।
কোম্পানিগুলো অনিশ্চিত অবস্থায় পড়ে যাওয়ার কারণে ৩০ লাখ কোটি ডলারের বৈশ্বিক বাণিজ্যিক-সম্পত্তির বাজার আরও গভীর এক মন্দার আশঙ্কায় ডুবে গেছে। কিছু কর্মী অযৌক্তিকভাবে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদী হলেও অন্যরা পদোন্নতি, বেতন এবং চাকরির নিরাপত্তা হুমকির মতো বিষয়গুলো নিয়ে বিচলিত।
সামাজিক দূরত্ববিধি কতটা কার্যকর হবে এবং সবার জন্য কোভিড-১৯ এর একটি ভ্যাকসিন সহজলভ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত কতদিন তা জারি থাকবে— এসব নিয়ে অনিশ্চিয়তার প্রতিফলন ঘটেছে উল্লিখিত দুই পক্ষের ভিন্নমতে। তবে বিষয়গুলো শুধু এর মধ্যেই সীমাবন্ধ নয়। ইকোনমিস্ট বলছে, এটা এর চেয়েও বেশি কিছু।
বিংশ শতাব্দীর ধ্বংসাবশেষ হিসেবে কতগুলো অফিস টিকে আছে মহামারি চোখে আঙ্গুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিচ্ছে, এমনকি গণহারে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হওয়া সত্ত্বেও। ফলস্বরূপ কোভিড-১৯ বিপর্যয় প্রযুক্তি ও সামাজিক পরীক্ষার দীর্ঘমেয়াদী পর্যায়ে প্ররোচিত করবে, না স্বাভাবিক হিসেবে ব্যবসায় এবং না অফিসে মারাত্মক আঘাত।
অবশ্য এই যুগের কিছু প্রতিশ্রুতি রয়েছে। রয়েছে নানা রকম হুমকিও। তবে তা কোম্পানি কালচারের মধ্যে সীমাবন্ধ নয়। আর এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার পরিবর্তে সরকারগুলোকে বিদ্যমান প্রাচীন কিংবা অপ্রচলিত কর্মসংস্থান আইন হালনাগাদ করার সঙ্গে সঙ্গে শহর কেন্দ্রগুলোকে নিয়ে নতুন করে ভাবা উচিত।
দুইশো বছর আগে বাষ্পশক্তির আবিষ্কার শ্রমিকদের কারখানায় নিয়ে আসে, যেন সেখানে তারা নতুন মেশিন ব্যবহার করতে পারেন। উনিশ শতকের শেষদিকে করপোরেট জায়ান্টদের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পরিচালনা করার জন্যও কর্মীদের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তখনকার পরিপ্রেক্ষিত তো ছিল একেবারে ভিন্ন।
কর্মীরা নিজেরা কি কাজ করছে এর রেকর্ড রাখার জন্য পরিকল্পনা সভা এবং মেমো প্রকাশ, চালান এবং অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে কাজ করার প্রয়োজন ছিল তাদের। এসব কারণে এই সমস্ত শ্রমিক-কর্মীকে একসঙ্গে থাকা এবং কেন্দ্রীয় অফিসে মিলিত হওয়ার জন্য গাড়ি বা ট্রেনে করে যাতায়াতের ধাঁচ তৈরি করার প্রয়োজন পড়ে।
তবে এই পদ্ধতির কিছু চাক্ষুষ ত্রুটি ছিলই। এর মধ্যে কিছু ত্রুটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। বেশিরভাগ অফিস কর্মী যাত্রাপথের এই ঝাক্কি-ঝামেলা এবং এর কারণে হওয়া ব্যয় সহ্য করতে পারেন না। ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, যাত্রাপথের কারণে সপ্তাহে গড়ে চার ঘণ্টার বেশি সময় নষ্ট হয় আমেরিকান কর্মীদের।
কিছু কর্মী যাত্রাপথে শব্দ এবং অফিসের আনুষ্ঠানিকতা পছন্দ করেন না আবার এর মধ্যে অনেকেই বৈষম্যের শিকার হন। অফিসে গিয়ে কাজ করা কর্মীরা এটা অনুধাবন করেন যে, তারা তাদের সন্তানদের দেখাশোনা করতে পারেন না। আর যেসব পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে কর্মী, তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা ক্রমাগত প্রকট হচ্ছে।
অনেকে হয়তো এটা ভাবতে পারেন যে, নতুন নতুন প্রযুক্তিই এই অসন্তোষজনক স্থিতাবস্থাকে নাড়া দিয়েছে। তাহলে শুনুন পিডিএফ এর যাত্রা শুরু ১৯৯১ সালে, ২০০০ এর দশকে ব্যান্ডউইথের দাম ব্যাপক কমে যায় এবং প্রযুক্তিতে দূরবর্তী কাজ করার ক্ষমতাসম্পন্ন জুম এবং স্ল্যাক— উভয়ই প্রায় এক দশক পুরানো।
তবুও আলস্যের কারণে ভয়াবহ নানারকম বাধা-বিপত্তি নিয়ে এখনও অফিসে আগের মতো কাজ চলছে। কোভিড-১৯ আঘাত হানার আগে, নমনীয়-অফিসগুলোর বাজারের শেয়ারের পরিমাণ ছিল ৫ শতাংশের নিচে। গ্রাহকদের আগে বেশিরভাগ কোম্পানি পাইকারি ব্যবসায় দূরবর্তী প্রযুক্তিতে কাজ শুরু করতে রাজি ছিল না।
কোভিড-১৯ এর অবসান ঘটিয়েছে। মহামারির আগে মাত্র ৩ শতাংশ আমেরিকান নিয়মিত বাড়িতে বসে কাজ করতেন; আর এখন বিশাল সংখ্যক কর্মী এটা করছে। এমনকি জেরক্সের মতো কোম্পানির অনেক কর্মীও ঘরে বসে কাজ করছে। ইকোনমিস্ট বলছে যত বেশি মানুষ ঘরে বসে কাজ করবে তত এই নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হবে।
বর্তমানে মাইক্রোসফট টিমস, জুম, গুগল মিট এবং সিসকো ওয়েবএক্স এর মতো ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপগুলোর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩০ কোটিরও বেশি। দেওয়ানি আদালত এখন আদালতে না গিয়ে ঘরে থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ঘরে বসেই কাজ করা যায় এমন অনেক সেবা ইন্টারনেটে দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
অবশ্য ভ্যাকসিন আসার পর এটা কতটা চলবে তা বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু ঘরে বসেই যে অনেক কাজ করা সম্ভব এটা আমরা মহামারিকালে প্রত্যক্ষ করলাম। এটা যে চলমান রাখলে কোনো সমস্যা হবে না তাও প্রমাণিত। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এভাবে কাজ করার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এসএ/জেআইএম