নভেম্বরের সতর্কতায় গুরুত্ব না দেয়ার ফল ভুগছে ভারত?
ব্রিটেনের অভিজ্ঞতা থেকে গত নভেম্বরেই বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, ভারতে করোনা সংক্রমণের আরও মারাত্মক দ্বিতীয় ধাক্কা আসতে চলেছে। বিরোধীদের অভিযোগ, ওই সতর্কবার্তা সত্ত্বেও পরিকাঠামোগত উন্নতির দিকে কেন্দ্রের মনোযোগ না দেওয়ার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে দেশবাসীকে।
দেশের প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে রোগীর চাপ, অক্সিজেনের অভাব, জীবন রক্ষাকারী ওষুধের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এসব কারণে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন ও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব রাজেশ ভূষণের পদত্যাগ দাবি করেছেন কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম।
করোনা সংক্রমণে একের পর এক রেকর্ড ভেঙেই চলেছে ভারতে। কোনভাবেই যেন দেশটিতে করোনার লাগাম টানা যাচ্ছে না। গত কয়েকদিন ধরেই টানা সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছেই।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রোববার সকালে জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৬৯১ মানুষের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে যা এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এখন পর্যন্ত ভারতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ৬৯ লাখ ৬০ হাজার ১৭২।
গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৭৬৭ জনের, যা এখন পর্যন্ত একদিনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণে ১ লাখ ৯২ হাজার ৩১১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যত শূন্য থেকে শুরু করলেও নরেন্দ্র মোদি সরকারের হাতে এক বছরের বেশি সময় ছিল। কিন্তু ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বা গোষ্ঠী সংক্রমণের উপর সরকারের ভরসা এবং অতিরিক্ত প্রতিষেধক-নির্ভরতার কারণে পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে চলে গিয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
তারা বলছেন, গত নভেম্বর থেকে যখন সংক্রমণের হার কমতে শুরু করেছিল, তখন সাধারণ মানুষ যেমন কোভিড সতর্কবিধি মেনে চলা ছেড়ে দেয়, তেমনই গা-ছাড়া মনোভাব দেখা যায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও। অথচ গত বছর ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব মেডিসিন রেগুলেটরি অথরিটিজের (আইসিএমআর) এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, দেশের জনসংখ্যার প্রতি পাঁচ জনে এক জন কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। অর্থাৎ বাকি চার জনের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা তখনই ছিল।
আইসিএমআরের এক বিশেষজ্ঞের মতে, ওই গবেষণা থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, দেশের ১৩৪ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় একশো কোটির দ্বিতীয় ধাক্কায় করোনা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সরকারের উচিত ছিল, সেই কথা ভেবে চিকিৎসা পরিকাঠামোকে প্রস্তুত করে তোলা।
এর পাশাপাশি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও গত নভেম্বরে নিজেদের রিপোর্টে কেন্দ্রকে একাধিক সুপারিশ করেছিল। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনযুক্ত শয্যা, আইসিইউ শয্যা, ভেন্টিলেটরের সংখ্যা বাড়ানোর উপর জোর দেওয়া হয়েছিল।
সেজন্য স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়েছিল। বড় হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলোতে নিজস্ব অক্সিজেন প্লান্ট গড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কংগ্রেস নেতা রণদীপ সুরজেওয়ালার অভিযোগ, এসবের কোন কিছুই মানেনি কেন্দ্র। ফলে অক্সিজেনের অভাবে মানুষকে মরতে হচ্ছে। রোববার কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম বলেন, ‘সরকার কি এত দিন পরে জেগে উঠল? মানুষ আত্মীয়দের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হাতে-পায়ে ধরছেন, অনেকে পিঠে করে অক্সিজেনের সিলিন্ডার বয়ে আনছেন। এই অপদার্থতার জন্য কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিবের কি পদত্যাগ করা উচিত নয়?’
গত বছর দেশে করোনার সংক্রমণ কমে আসার পরে বিশেষজ্ঞদের বৈঠকও কমে যায়। চলতি বছরের শুরুতে বিশেষজ্ঞদের করোনা সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের একটি মাত্র বৈঠক হয়েছে। এর পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, সরকারের কোভিড সংক্রান্ত পরামর্শদাতা গোষ্ঠীর অনেকেই ‘হার্ড ইমিউনিটি’ নীতির পক্ষে ছিলেন।
তাদের যুক্তি ছিল, এ ধরনের সংক্রমণ জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে না পড়া পর্যন্ত তা সাধারণ রোগে পরিণত হবে না। তাই প্রবীণদের প্রতিষেধকের আওতায় আনা হোক, যাতে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু কমে যায়। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিজের গতিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠুক, এমন ভাবা হয়েছিল। এই নীতি কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল ব্রিটেন ও সুইডেনে। তা সত্ত্বেও একই নীতিতে ভরসা রেখেছিল ভারত সরকার।
এর সঙ্গে রয়েছে ভ্যাকসিন নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতির অভাব। অনেকেই মনে করছেন, যথেষ্ট প্রতিষেধক না থাকা সত্ত্বেও বিদেশে প্রচুর ভ্যাকসিন রফতানির ফলে দেশে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। উপরন্তু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দু’টি মাত্র সংস্থার ভরসায় ভারতের মতো দেশে ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা যথেষ্ট ঝুঁকির ছিল। ফলে এখন যথেষ্ট পরীক্ষামূলক প্রয়োগ না করেই বিদেশি প্রতিষেধককে ছাড়পত্র দিতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলেন, গত ১৫ জানুয়ারি দেশে ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আর কোভিড রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে। অর্থাৎ হাতে এক মাসও পাওয়া যায়নি। অনেকেই দ্বিতীয় ডোজ পাওয়ার আগেই আক্রান্ত হয়েছেন। তার মতে, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা যদি কয়েক মাস পরে শুরু হতো এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী তার আগেই যদি প্রথম ৩০ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিনের দু’টি ডোজ দেওয়া সম্ভব হতো তাহলে হয়তো সংক্রমণের চিত্র এতটা ভয়াবহ হতো না।
টিটিএন/জিকেএস