কে এই জর্জিয়া মেলোনি?

ইতালির নতুন প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন জর্জিয়া মেলোনি। ইতোমধ্যেই তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটির সবচেয়ে কট্টর ডানপন্থী সরকারের নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন জর্জিয়া মেলোনি। রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রাথমিক ফল অনুযায়ী, প্রথম বারের মতো নারী প্রধানমন্ত্রী পেতে যাচ্ছে ইতালি।
মেলোনির ব্রাদার্স অব ইতালিসহ মাত্তেও সালভিনির লিগ ও সিলভিও বার্লুসকোনির ফোরজা ইতালিয়া জোট রোববারের নির্বাচনে প্রায় ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক ফলাফল থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। ব্রাদার্স অব ইতালি প্রায় ২৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলটি মাত্র ৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।
জর্জিয়া মেলোনির জন্ম ১৯৭৭ সালে। রোমে জন্মগ্রহণ করা জর্জিয়ার বয়স যখন মাত্র এক বছর তখন তার বাবা ফ্রান্সেসকো পরিবার ছেড়ে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে চলে যান। ফ্রান্সেসকো ছিলেন বামপন্থী আর জর্জিয়ার মা আনা ডানপন্থী ছিলেন। অনেকে মনে করেন, বাবার অনুপস্থিতিতে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে তিনি তার রাজনীতির পথ বেছে নিয়েছেন।
তার পরিবার নানাবাড়ির কাছে গারবাতেল্লায় চলে যায়। সেখানেই ১৫ বছর বয়সে নব্য ফ্যাসিবাদী দল ইতালিয়ান সোস্যাল মুভমেন্টের যুব ফ্রন্টে যোগ দেন তিনি। পরে দলটির উত্তরসূরি ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের ছাত্র শাখার সভাপতি হন জর্জিয়া।
মার্কো মার্সিলিও গারবাতেল্লার এমএসআই অফিসে একটি সভা করছিলেন। ঠিক তখন ১৯৯২ সালে জর্জিয়া তার দরজায় কড়া নেড়েছিলেন। বয়সে ১০ বছরের বড় মার্সিলিও তার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং রাজনৈতিক মিত্র হয়ে ওঠেন। মার্সিলিও আজ আবরুজো অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট।
জর্জিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, হালকা পাতলা একটা মেয়ে ছিল সে। কিন্তু সবসময় খুব গুরুগম্ভীর এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। ছাত্র সভাগুলোতে সে নজর কাড়তো। তার হাত থেকে মাইক্রোফোন নিয়ে নিতে চাইলে যে কাউকে সে থামিয়ে দিত।
বছরের পর বছর ধরে মার্সিলিও এবং মেলোনি পারিবারিক ছুটি, সামাজিক অনুষ্ঠান এবং বিতর্কের দিনগুলো একসাথে কাটিয়েছেন। মার্সিলিও তাকে আত্মবিশ্বাসী হয়ে বেড়ে উঠতে দেখেছেন। মার্সিলিও বলেন, নিজের নিরাপত্তাহীনতা ঢেকে রাখতো সে। কিন্তু সম্ভবত এটা তার একটি শক্তি ছিল। কোনো একটি সমস্যা মোকাবিলা করার আগে সে বিষয়ে জানার জন্য আরও বেশি করে পড়াশোনা করত।
২০০৮ সালে জর্জিয়া মেলোনি ইতালির সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হন। তিনি সিলভিও বারলুসকোনির যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী নিযুক্ত হন। ২০১২ সালে নিজের দল গঠন করার পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি মাত্র চার শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন।
এখন মারিও দ্রাঘির জাতীয় ঐক্যজোট সরকারের বাইরে থাকা একমাত্র প্রধান দল হিসেবে ব্রাদার্স অব ইতালি ২২ থেকে ২৬ শতাংশ ভোট জিততে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সিলভিও বারলুসকোনির সঙ্গে তার ডানপন্থী জোট এবং প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাটিও সালভিনির লিগ পার্টি মিলে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার পথে আছে।
জর্জিয়া মেলোনি যদিও ইতালির পশ্চিমা মিত্রদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। যেমন দ্রাঘি সরকারের ইউক্রেনপন্থাকে জোরালোভাবে সমর্থন করেছেন, কিন্তু তার কঠোর রক্ষণশীল সামাজিক নীতিগুলো অনেককে উদ্বিগ্ন করছে।
স্পেনের অতি ডানপন্থী ভক্স পার্টির সাম্প্রতিক সমাবেশে তিনি জোরালো কণ্ঠে বলেছিলেন, প্রাকৃতিক নিয়মের পরিবারের প্রতি হ্যাঁ আর এলজিবিটি লবিদের জন্য না। লিবিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের নৌকা বন্ধ করতে তিনি নৌ অবরোধের আহ্বান জানিয়েছেন।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, মেলোনি গণতন্ত্রের জন্য একটা বিপদ নয়, কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য বিপদ। জর্জিয়া মেলোনিকে হাঙ্গেরি এবং ফ্রান্সের জাতীয়তাবাদী নেতাদের কাতারে ফেলা হয়েছে।
তিনি মেরিন ল্য পেন বা ভিক্টর অরবানের মতো একই দিকে আছেন এবং তিনি ‘এক জাতির ইউরোপ চান’। ইতালি পুতিনের ট্রোজান হর্স হয়ে উঠতে পারে। সে ইউরোপকে দুর্বল করতে কাজ করে যাবে।
রোমের সাপিয়েঞ্জা ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জিয়ানলুকা প্যাসারেলি বলেন, ইতালির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য জর্জিয়া মেলোনি তার নারী পরিচয় ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তিনি তা করেছেন পুরুষালি রাজনৈতিক ধাঁচে।
প্যাসারেলি বলেন, ইতালীয় পরিবারের আধিপত্য থাকে মায়েদের হাতে। যা একটি পুরুষালি ব্যক্তিত্ব। যিনি রান্নাঘর নিয়ন্ত্রণ করেন। জর্জিয়া চমৎকারভাবে এই ইমেজটি ব্যবহার করেছেন। যা সরাসরি আমাদের জীবনের কেন্দ্রে রয়েছে। ইতালির দীর্ঘ অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং প্রবীণদের রাজনীতির সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তার মিত্রদের জন্য আমূল রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
এদিকে নির্বাচনী ফলাফল জানার পর সোমবার রাতেই এক বক্তৃতায় জর্জিয়া মেলোনি বলেন, ‘এটাই দায়িত্ব পালনের সময়। আমাদের যদি সরকার গঠনের জন্য বলা হয়, তবে আমরা ইতালীয়দের জন্য কাজ করবো, আমরা জনগণকে একত্রিত করার লক্ষ্যে কাজ করবো। তিনি আরও বলেন, ব্রাদার্স অব ইতালি দলের সরকার হবে প্রত্যেকের এবং আমরা মানুষের আস্থার সঙ্গে প্রতারণা করবো না’। রোমে কথা বলার সময় তিনি আরও বলেন, ‘ধন্যবাদ ইতালি’।
জর্জিয়া মেলোনির প্রথম চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো বাজেট পরিকল্পনার খসড়া তৈরি করা। এই খসড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সংসদে জমা দেওয়া এবং বছরের শেষে তা অনুমোদন করা। মন্থর গতিতে চলছে ইতালির অর্থনীতি। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান সুদের হারসহ বিভিন্ন সংকট মোকাবিলা করতে হবে নতুন এই প্রধানমন্ত্রীকে।
৪৫ বছর বয়সী মেলোনির সরকারি কাজের অভিজ্ঞতা খুব বেশি নয়। এখন জর্জিয়া মেলোনিকে এমন একজন হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে যে সত্যিই ইতালির অর্থনীতির উপস্থিত চ্যালেঞ্জগুলো তিনি মোকাবিলা করতে পারবেন। রক্ষণশীল থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কিপসেলির মহাপরিচালক ডমেনিকো লোম্বার্ডি বলেন, ‘আমাকে বলতে দিন যে রক্ষণশীল হওয়ার অর্থ আপনার দেশের পাবলিক ফাইন্যান্স সম্পর্কে রক্ষণশীল হওয়া’।
টিটিএন