ক্যামেরা চুরির মামলার আসামি আরাভ খান, করেছেন একাধিক বিয়ে

জাহাঙ্গীর আলম
জাহাঙ্গীর আলম জাহাঙ্গীর আলম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৩৯ পিএম, ১৯ মার্চ ২০২৩

>> শ্বশুরকে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করতেন আরাভ খান
>> একাধিক মেয়েকে বিয়ে করেছেন আরাভ
>> পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলার বিচার শুরু
>> আয়নাবাজির মতো অন্যকে পাঠানো হয় কারাগারে

দুবাইয়ের সোনা ব্যবসায়ী আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। খুনের মামলা মাথায় নিয়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে দুবাইয়ে পাড়ি জমানো আরাভ এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে দুবাইয়ে ‘আরাভ জুয়েলার্স’ নামে একটি গোল্ড শোরুমের সম্প্রতি উদ্বোধন করেছেন তিনি। এছাড়াও কিনেছেন বাড়ি-গাড়ি। সেখানে রয়েছে তার কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। অথচ এই মানুষটিই কি না ডিএসএলআর ক্যামেরা চুরির মামলার আসামি। চুরির মামলা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে রয়েছে পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যা, অস্ত্র ও অন্যের রূপ ধারণ করে প্রতারণাসহ বিভিন্ন অভিযোগের একাধিক মামলা। এছাড়া একাধিক বিয়েও করেছেন তিনি। শ্বশুরদের ভয়ভীতি দেখিয়ে আদায় করেছেন কাড়ি কাড়ি টাকা।

আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম তার বিরুদ্ধে হওয়া সব মামলায় জামিন নিয়ে বর্তমানে পলাতক। এসব মামলায় সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসছেন না। ফলে মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রম ঝুলে রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, সাক্ষীদের আদালতে হাজির করে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে।

আরও পড়ুন: আট নামে ৫ দেশের নাগরিক, যে কোনো সময় রেড অ্যালার্ট

ডিএসএলআর ক্যামেরা চুরির মামলাটি ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন। ২০১৭ সালের ২৩ জুন মামলার বাদী শুকুর আলী ও তার বন্ধু মো. হাসান হাতিরঝিল এলাকায় ঘুরতে যান। রামপুরাগামী রাস্তার ব্রিজের ওপর অবস্থানকালে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি একটি মোটরসাইকেলে করে এসে বাদীর হাতে থাকা ডিএসএলআর ক্যামেরা এবং মোবাইল ফোন ছিনিয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্রুত মগবাজারের দিকে পালিয়ে যান। ২০১৮ সালের ৭ মে আদালত আরাভ খানের উপস্থিতিতে এ মামলায় অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

বিচার শুরুর পর ২০১৯ সালের ১৪ মে আদালত আসামির জামিন বাতিল করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। একই দিন মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। এরপর আর কোনো সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে ১৬ বার সাক্ষীদের প্রতি সমন দেওয়া হয়। সবশেষ গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য ছিল। তবে কোনো সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ায় পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ১২ জুন দিন ধার্য রয়েছে।

শ্বশুরকে ভয় দেখিয়ে টাকা নিতেন আরাভ খান
২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আরাভ খান তার শ্বশুর সেকেন্দার আলীকে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করতে শ্বশুরের মগবাজারের বাসায় যান। একটি গুলি ভর্তি রিভলবারসহ শ্বশুরের বাসার সামনে থেকে গ্রেফতার হন। এ ঘটনায় আরাভের বিরুদ্ধে রমনা মডেল থানায় অস্ত্র আইনে মামলা করেন ডিবি পশ্চিমের গাড়ি চুরি প্রতিরোধ ও উদ্ধার টিমের তৎকালীন উপ-পরিদর্শক সুজন কুমার কুণ্ডু।

আরও পড়ুন: আরাভ খানকে দেশে ফেরানোর সব চেষ্টা চলছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

মামলাটি বর্তমানে ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মুর্শিদ আহাম্মদের আদালতে বিচারাধীন। এখন পর্যন্ত চার্জভুক্ত ২০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন আদালত। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির উপ-পরিদর্শক শেখ হাসান মুহাম্মদ মোস্তফা সারোয়ারসহ বাকি সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।

একাধিক মেয়েকে বিয়ে করেছেন আরাভ
অস্ত্র মামলায় গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে আরাভ খান জানান, তিনি একাধিক মেয়েকে বিয়ে করেছেন। এরপর ভয়ভীতি দেখিয়ে ও প্রভাব খাটিয়ে শ্বশুরদের কাছ থেকে আদায় করেছেন নগদ অর্থ।

পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলার বিচার শুরু
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান হত্যা মামলায় আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলামসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক এ বিচার শুরুর আদেশ দেন। মামলার বাদী জাহাঙ্গীর আলম খানের আংশিক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। আর কোনো সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ২১ মার্চ দিন ধার্য রয়েছে।

আরও পড়ুন: দুবাই পালানোর আগে আরাভ খান থাকতেন কলকাতার বস্তিতে!

এ মামলায় আরাভ খান ওরফে রবিউল ছাড়াও আসামি নয়জন। তারা হলেন- রবিউলের স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়া (২১), ইমরানের বন্ধু রহমত উল্লাহ (৩৫), স্বপন সরকার (৩৯), দিদার পাঠান (২১), মিজান শেখ (২১), আতিক হাসান (২১), সারোয়ার হোসেন (২৩) এবং দুই কিশোরী মেহেরুন নেছা স্বর্ণ ওরফে আফরিন ওরফে আন্নাফী (১৬) ও ফারিয়া বিনতে মীম ওরফে মাইশা (১৬)।

২০১৮ সালের ৯ জুলাই গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায় উলুখোলা এলাকার একটি জঙ্গল থেকে পুলিশ পরিদর্শক মামুনের হাত-পা বাঁধা বস্তাবন্দি পোড়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার দুদিন আগে অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে নিখোঁজ হন তিনি। এ ঘটনায় মামুনের ভাই বাদী হয়ে রাজধানীর বনানী থানায় মামলা করেন।

আয়নাবাজির মতো অন্যকে পাঠানো হয় কারাগারে
মামুন হত্যা মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর রবিউল ইসলাম নামের একজন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তাকে জেলে পাঠান। প্রায় ৯ মাস কারাবাসের পর ওই তরুণ বলেন, তিনি রবিউল ইসলাম নন, তার আসল নাম আবু ইউসুফ। রবিউলের কথামতো তার নাম-পরিচয় ব্যবহার করে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তিনি। এরপর আদালত বিষয়টি অনুসন্ধান করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) প্রতিবেদন দিতে বলেন।

আরও পড়ুন: কোনো বাংলাদেশি জড়িত কি না খতিয়ে দেখবে ডিবি

ডিবির অনুসন্ধানে জানা যায়, খুনের মামলার আসামি রবিউলের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মতিউর রহমান। আর রবিউলের পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পণকারী আবু ইউসুফের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানার আইনপুর গ্রামে। তার বাবা নুরুজ্জামান ও মা হালিমা বেগম।

এ ঘটনায় অন্যের রূপ ধারণ করে জামিনের জন্য আত্মসমর্পণ ও সহায়তার অপরাধে ২০২১ সালের ১ জুন ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী এএসএম শাহাদাৎ আলী বাদী হয়ে আরাভ খান ওরফে রবিউলের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। তদন্ত শেষে একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের উপ-পরিদর্শক অনিল চন্দ্র রায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার মহানগর হাকিম আতাউল্লাহের আদালতে বিচার শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। সর্বশেষ গত ২৯ জানুয়ারি এ মামলার অভিযোগ গঠনের জন্য দিন ধার্য ছিল। তবে আসামিপক্ষ সময় আবেদন করায় আগামী ১৫ মে অভিযোগ গঠনের দিন ধার্য রয়েছে।

আরও পড়ুন: ফিরিয়ে আনা হবে আরাভ খানকে, কীভাবে দেশত্যাগ খতিয়ে দেখছে পুলিশ

আরাভ খানের বিষয়ে গতকাল শনিবার (১৮ মার্চ) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, দুবাইয়ের সোনা ব্যবসায়ী আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলামকে দেশে ফিরিয়ে আনার সব চেষ্টা হচ্ছে। এরই মধ্যে তাকে (আরাভ খান) ধরতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।

কিন্তু আরাভ খান যেহেতু ভারতীয় পাসপোর্টধারী সেক্ষেত্রে কোন আইনে ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হবে, এ প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দেননি মন্ত্রী।

আরও পড়ুন: প্রয়োজনে সাকিব-হিরো আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে: হারুন

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু জাগো নিউজকে বলেন, আরাভ খান ওরফে রবিউলের বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো রয়েছে সেসব মামলার সাক্ষীদের আদালতে হাজির করে দ্রুত সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করা হবে। আরাভ খান ওরফে রবিউল পলাতক থাকায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

এদিকে পুলিশ খুনের আসামি আরাভ খানের সঙ্গে ‘কোনো পরিচয় নেই’ বলে জানিয়েছেন সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ। শনিবার এক ফেসবুক পোস্টে বেনজীর লিখেছেন, সম্মানিত দেশবাসী, আমি আপনাদের সবাইকে আশ্বস্ত ও সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত করতে চাই যে আরাভ ওরফে রবিউল ওরফে হৃদয় নামে আমি কাউকে চিনি না। আমার সঙ্গে তার এমনকি প্রাথমিক পরিচয়ও নেই।

দুবাইয়ের গিয়ে আরাভের ধনকুবের বনে যাওয়ার নেপথ্যের রহস্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে আলোচনার মধ্যেই কারও কারও কথায় ওঠে আসে বেনজীরের নাম।

আরও পড়ুন: আরাভ খানকে আমি চিনি না: সাবেক আইজিপি বেনজীর

এ নিয়ে বেনজীর আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন, আমি আমার ল’ এনফোর্সমেন্ট ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় খুনি, সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি, চোরাকারবারি, ভেজালকারী ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, কখনোই সখ্যতা নয়।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আলোচিত আরাভ খানই পুলিশ কর্মকর্তা মামুন খুনের মামলার সেই আসামি কি না, তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে। তথ্য-প্রমাণ মিললে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। এরই মধ্যে দুবাই থেকে তাকে দেশে ফেরত আনার আইনি প্রক্রিয়া চলছে।

জেএ/এমকেআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।