ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য কোনো উদ্যোগ নিইনি: ড. ইউনূস

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:৪৫ এএম, ১০ নভেম্বর ২০২৩

 

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমি যেসব উদ্যোগ নিয়েছি, কোনোটা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য নিইনি। এটা গ্রামীণ ব্যাংক হোক বা অন্যান্য বহু প্রতিষ্ঠান হোক। মানুষ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করে লাভ করবে, মুনাফা করবে। আমরাও লাভ করেছি। কিন্তু আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের উপকার করা।

বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) বিকেলে তৃতীয় শ্রম আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন শেষে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য, আদর্শ, কর্মসূচি ব্যক্তিগতভাবে লাভবান বা মালিক হওয়া জন্য না।’

শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে করা মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনের পর ড. ইউনূসসহ চার জনের বিরুদ্ধে করা মামলায় যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপনের জন্যে আগামী ১৬ নভেম্বর দিন ধার্য করেছেন শ্রম আদালত। এর আগে জেলা ও দায়রা জজ শেখ মেরিনা সুলতানার তৃতীয় শ্রম আদালতে শুনানিতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন ড. ইউনূস।

এদিন ড. ইউনূসসহ চারজনের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন ও ব্যারিস্টার খাজা তানভীর আহমেদ। অন্যদিকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান ও দায়িত্বরত চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের উপকার করা। এখানে (সামাজিক ব্যবসার প্রতিষ্ঠান) যিনি বিনিয়োগ করবেন তিনি কোনো মুনাফা নেবেন না। আমি এ সামাজিক ব্যবসার প্রবক্তা। বিশ্বব্যাপী এটা প্রচার করার চেষ্টা করছি। আমি নিজে যদি এর উল্টো করি তাহলে তো আর হলো না।’

ইউনূস বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে মুনাফা করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। আমার সঙ্গে যারা আছেন তাদেরও এ উদ্দেশ্য ছিল না। তারপরও বিচারের বিষয়টা এসেছে। কেন এসেছে সেটা আপনারাই বিচার করবেন। মানুষতো আর ফেরেশতা না, অসাবধানতা-বশত কিছু ভুলভ্রান্তি হতেই পারে। মানুষ ভুল করতেই পারে। যেকোনো একটা কাজ করতে গেলে ভুলভ্রান্তি তো হবেই। ভুলভ্রান্তি এক জিনিস, অপরাধ আরেক জিনিস।’

এর আগে আদলতে দোষী সাব্যস্ত হলে ৩০৩ ও ৩০৭ ধারায় ছয় মাস ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে উল্লেখ করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের আইনজীবী বলছেন, যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ইউনূসকে সশরীরে উপস্থিত থাকতে হবে। মক্কেলকে নির্দোষ দাবি করে ইউনূসের আইনজীবী বলছেন, আদালত চাইলে ইউনূস হাজির থাকবেন ১৬ তারিখে। যদিও এর আগে আদালতে বক্তব্যে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন ড. ইউনূস।

এদিন দুপুরে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় জামিনের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় সশরীরে আদালতে এসে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বেলা ১২ টায় আদালতে এলে নিজেকে আইনজীবীর মাধ্যমে ২২ পৃষ্ঠার আত্মপক্ষ সমর্থনের লিখিত বক্তব্য পেশ করান ড. ইউনূস। এরপর শুনানি শেষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য আগামী ১৬ নভেম্বর দিন ধার্য করেন আদালত।

যদিও সাংবাদিকদের সামনে ড. ইউনূসের দাবি, ব্যক্তিগত লাভের জন্য কিছুই করেননি। আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ন্যায়বিচারেরও। এদিকে, ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন, ড. ইউনূসকে একজন দেশপ্রেমিক আখ্যা দিয়ে হয়রানি করার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আদালত চাইলে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ইউনূস উপস্থিত থাকবেন বলেও জানান তিনি।

শুনানিতে চারজনের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন বিচারকের সামনে লিখিত বক্তব্য পাঠ শুরু করেন।

এতে অভিযোগের বিষয়ে ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও অন্য তিনজন বিবাদী পরিচালনা বোর্ডের সদস্য হিসেবে নিয়োজিত আছেন। গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানি আইনে রেজিস্ট্রিকৃত ২৮ ধারায় সৃষ্ট একটি ‘নট ফর প্রফিট’ কোম্পানি। যার লভ্যাংশ বিতরণযোগ্য নয়।

এই লভ্যাংশের অর্থ সামাজিক উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। সে কারণে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠান এর কোনো মালিকানা বা শেয়ার হোল্ডার নেই। বিবাদীদের কেউই শেয়ার হোল্ডার নন। এছাড়া বিবাদীরা শুধু সম্মানজনক পদে থেকে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সহায়তা করছেন। এটি ছাড়া কোম্পানি আইনের ২৮ ধারায় গঠিত গ্রামীণ টেলিকম প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের মুনাফা প্রদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

আইনজীবী বলেন, গ্রামীণ টেলিকমের যেহেতু কোনো স্থায়ী কার্যক্রম নেই সেহেতু এর মূল কাজ হচ্ছে চুক্তির মাধ্যমে পল্লীফোন কার্যক্রম এবং নকিয়া মোবাইল হ্যান্ডসেটের বিক্রয়োত্তর সেবা দেওয়া।

পল্লীফোন কার্যক্রমটি গ্রামীণফোনের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং প্রতি ৩ (তিন) বছর অন্তর তা নবায়ন করা হয়। পল্লীফোন গ্রামীণ টেলিকমের একটি প্রকল্প যা গ্রামীণফোনের নির্দেশে চুক্তির ভিত্তিতে গ্রামীণ টেলিকমের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে। যার বিনিময়ে গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণফোন হতে ১০ শতাংশ রেভিনিউ শেয়ার পায় এবং এই চুক্তির মেয়াদ ৩ বছর পর চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করে থাকে।

অনুরূপভাবে ফিনল্যান্ডের নকিয়া মোবাইল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে গ্রামীণ টেলিকম বাংলাদেশের সকল ক্রেতাদের নকিয়া হ্যান্ডসেটের বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান করে থাকে। যার বিনিময়ে বৈদেশিক মুদ্রায় ৫ শতাংশ ডলার গ্রামীণ টেলিকম আয় করে থাকে। এই চুক্তির মেয়াদ ৩ বছর। ফলে চুক্তিটি প্রতি ৩ বছর পর পর নবায়ন করা হচ্ছে।

এই উভয় চুক্তির আওতায় গ্রামীণ টেলিকম আইন অনুযায়ী এর (চুক্তিভিত্তিক চরিত্র) আওতায় নিয়োগ পাওয়া কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে থাকে। ফলে এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের আওতায় সকল শ্রমিক কর্মচারী-কর্মকর্তা স্থায়ী শ্রমিকের ন্যায় সকল সুযোগ-সুবিধা যেমন-পদোন্নতি, নিয়মিত হওয়া, পে-স্কেল, গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, অর্জিত ছুটি, মেডিকেল ভাতা পেয়ে থাকেন।

তবে গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানি আইনের ২৮ ধারায় সৃষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান (নট ফর প্রফিট কোম্পানি) হওয়ায় কোম্পানি আইন অনুযায়ী লভ্যাংশ বিতরণযোগ্য নয়। সেজন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও নীট মুনাফার ৫ শতাংশ (ডব্লিউপিপিএফ) দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

উল্লেখ করা হয়, বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত থেকে ২০ বছর ধরে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীরা চাকরিতে থাকাবস্থায় এবং রিটায়ারমেন্টে (অবসরে) যাবার পরও তারা কখনো মুনাফা (ডব্লিউপিপিএফ) দাবি করেনি। কিন্তু অতি সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ মহল যারা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সামাজিক ব্যবসার অগ্রগতি পছন্দ করে না তাদের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে মুনাফার (ডব্লিউপিপিএফ) সুবিধা আদায়ের জন্য গ্রামীণ টেলিকমের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী ২০১৭ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ সিভিল বিধানের অধীন ২১১ ধারায় তৃতীয় শ্রম আদালতে অনেকগুলো সিভিল বিএলএ (আই,আর) মামলা এবং সিবিএ কর্তৃক শিল্প বিরোধ মোকদ্দমা দায়ের করে।

কিন্তু সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অযৌক্তিক ও আইন বহির্ভূত দাবি দাওয়া থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরত রাখার পরিবর্তে ইচ্ছাকৃত ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে গ্রামীণ টেলিকম সম্পর্কে ভুল ও মিথ্যা তথ্যের অবতারণা করে মুনাফাসহ (ডব্লিউপিপিএফ) টেলিকমের অবৈতনিক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসহ চার জন পরিচালক বিবাদীর বিরুদ্ধে শ্রম আইনের ৩টি ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা করেন।

লিখিত বক্তব্যে ড. ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠানের এ তিন সহযোগী উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকসহ ৫০টির অধিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। কোনো কোম্পানিতে তার নিজস্ব কোনো শেয়ার নেই। সুতরাং কোনো লভ্যাংশ বা লাভের টাকা ওনার পকেটে ঢোকে না। যখনই দেশের গরিবদের একটা সামাজিক সমস্যা দেখেছেন, সেটার মাধ্যমেই একটা বিজনেস মডেল বানিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষা সমস্যার জন্য বানিয়েছেন গ্রামীণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য বানিয়েছেন গ্রামীণ কল্যাণ। এমন ব্যবসার ধারণা বা মডেল তৈরির জন্য যথেষ্ট সময় দেন। কিন্তু মালিকানায় কখনো নিজেকে জড়াননি। দেশে-বিদেশে কোথাও নিজের নামে কোনো জায়গা জমি গাড়ি-বাড়ি নেই তার।

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দেখান যিনি এতোগুলো ইমপ্যাক্ট তৈরি করেছেন। এতোগুলো বিদেশি ব্র্যান্ড কোম্পানিকে জয়েন্ট ভেঞ্চারে বাংলাদেশে এনেছেন। এত এত মানবসম্পদ তৈরি করেছেন।

লিখিত বক্তব্যে কোম্পানি আইনসহ বিভিন্ন আইনের ব্যাখ্যাসহ এই মামলাটি কেন চলতে পারে না, তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। তাই ড. ইউনূসসহ অন্যদের মামলা থেকে অব্যাহতিও প্রার্থনা করা হয়।

আইনজীবী দাবি করেন, সব অভিযোগ মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপূর্ণ। তাই অভিযোগ অস্বীকার করে বাদীর দায়ের করা মামলা ক্ষতিপূরণসহ খারিজ করার জন্যও বিজ্ঞ আদালতে প্রার্থনা করেন। শুনানিতে বেলা পৌনে তিনটার দিকে লিখিত বক্তব্য পাঠ শেষ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন। এসময় মামলা খারিজ করে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেন তিনি।

এফএইচ/এমএএইচ/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।