ওমেগা-৩ ডিম কি সত্যিই আলাদা কিছু
সানজানা রহমান যুথী
অনেকেরই ধারণা, ডিম তো ডিমই, সেটা হোক ওমেগা-৩ ডিম অথবা সাধারণ মুরগির ডিম। এগুলোর মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। এই ধারনা কি ঠিক? বিশ্ব ডিম দিবসে ডিম নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন আল্-হায়াত হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কনসালটেন্ট ডায়টেসিয়ান ও পুষ্টিবিদ মোহাম্মদ আরিফ ইকবাল।
জাগো নিউজ: সাধারণ ডিম ও ওমেগা থ্রি ডিমের মূল পার্থক্যটা আসলে কী?
মোহাম্মদ আরিফ ইকবাল: সাধারণ ডিম ও ওমেগা-৩ ডিম এর মূল পার্থক্য ডিমের কুসুমে। ডিমের সাদা অংশে প্রোটিন সমান থাকে কিন্তু কুসুমে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সাধারণ ডিমের তুলনায় ৫ থেকে ১৫ গুণ বেশি থাকে। এছাড়া ওমেগা-৩ ডিমে ভিটামিন ডি, ভিটামিন ই, কোলিন, লুটেইন ও জিয়াজ্যানথিন কিছুটা বেশি থাকে।

জাগো নিউজ: ওমেগা থ্রি ডিম বলতে ঠিক কী বোঝায়? এটি কীভাবে তৈরি বা উৎপাদন করা হয়?
মোহাম্মদ আরিফ ইকবাল: মুরগীকে সাধারণ খাবারের পাশাপাশি ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ খাবার (যেমন- ফ্ল্যাক্সসিড, ফিশ অয়েল, শৈবাল, বা চিয়া সিড) খাওয়ানো হয়, তাহলে ডিমে ওমেগা-৩ জমা হয়, এবং তখন এই ডিমকে ওমেগা-৩ ডিম বলে।
জাগো নিউজ: ওমেগা থ্রি ডিম খেলে কী ধরনের স্বাস্থ্য উপকার পাওয়া যায়?
মোহাম্মদ আরিফ ইকবাল: ওমেগা-৩ ডিম নিয়মিত খাওয়া হৃদরোগ ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে সহয়তা করে। এটি দৃষ্টি শক্তি ভাল রাখার পাশাপাশি রেটিনা সুরক্ষা করে ও চোখের ছানি প্রতিরোধ করে। এছাড়া এর পুষ্টিগুণ শরীরের প্রদাহ কমায় এবং ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্যও উন্নত করে।
জাগো নিউজ: হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য ওমেগা থ্রি ডিম কেন ভালো?
মোহাম্মদ আরিফ ইকবাল: ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ ডিম হৃদরোগ ও উচ্চরক্তচাপ রোগীর জন্য ভাল, কারণ এটি রক্তের ঘনত্ব কমায়। ফলে রক্ত জমাট বাঁধে না। এতে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে। ওমেগা–৩ ফ্যাট এলডিএল কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয়, যা ধমনিতে চর্বি জমা প্রতিরোধ করে। একইসঙ্গে এইচডিএল কোলেস্টেরল বাড়ায়, যা রক্তনালী পরিষ্কার রাখে।
ওমেগা–৩ রক্তনালীকে শিথিল করে, ফলে ব্লাড প্রেসার কমে আসে। তাই নিয়মিত খেলে উচ্চরক্তচাপ রোগীরা উপকার পান। শরীরের প্রদাহই অনেক সময় হৃদরোগের মূল কারণ। ওমেগা-৩ ডিমে থাকা ইপিএ ও ডিএইচএ এই প্রদাহ কমিয়ে হার্টের টিস্যুকে সুরক্ষা দেয়।
ওমেগা–৩ হৃদপিণ্ডের কোষের বৈদ্যুতিক কার্যক্রম স্থিতিশীল রাখে, ফলে অনিয়মিত হার্টবিট কম হয়। এটি মানসিক চাপ বা স্ট্রেস কমায়, যা রক্তচাপ ও হৃদরোগে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

জাগো নিউজ: শিশু, গর্ভবতী নারী বা বয়স্কদের জন্য ওমেগা-৩ ডিম কতটা উপকারী?
মোহাম্মদ আরিফ ইকবাল: ওমেগা–৩ ডিম শিশু, গর্ভবতী এবং বয়স্কদের জন্য অত্যন্ত উপকারী, কারণ এতে থাকা ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন ডি, ই ও কোলিন শরীরের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
১–১২ বছর বয়সী শিশুদের জন্য উপকারিতা: ওমেগা–৩ ডিম শিশুর মস্তিষ্ক, চোখ ও ইমিউন সিস্টেমের জন্য খুবই উপকারী। এটি মস্তিষ্কের বিকাশে সাহায্য করে। ডিএইচএ শিশুদের স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ ও শেখার ক্ষমতা বাড়ায়, চোখের দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে। চোখের রেটিনা গঠনেও ডিএইচএ একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। ভিটামিন ডি ও ই শিশুর ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। এছাড়াও এটি মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার নিয়ন্ত্রণে রাখে।
গর্ভবতী নারীদের জন্য উপকারিতা: গর্ভাবস্থায় ওমেগা–৩ ভ্রূণের মস্তিষ্ক ও চোখের বিকাশে সাহায্য করে। কারণ, ডিএইচএ হলো শিশুর মস্তিষ্ক ও চোখের কোষের মূল উপাদান। গর্ভাবস্থায় মায়েদের হরমোনজনিত রক্তচাপ বাড়ে; ওমেগা–৩ তা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এটি রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে। ফলে প্রি–এক্লাম্পসিয়ার (গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ) ঝুঁকিও কমে। এছাড়াও ওমেগা–৩ মায়ের বিষণ্নতা কমাতে সাহায্য করে।
বয়স্কদের জন্য উপকারিতা: ওমগো-৩ সমৃদ্ধ ডিম রক্তের খারাপ ফ্যাট (এলডিএল) কমায় ও রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে। এটি স্মৃতিভ্রংশ ও আলঝাইমার প্রতিরোধেও সহায়ক। ডিএইচএ স্নায়ুকোষের সুরক্ষা দেয় ও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বজায় রাখে। ভিটামিন ডি ও প্রোটিন হাড় ক্ষয় প্রতিরোধে সাহায্য করে। লুটেইন, জিয়াজ্যানথিন, ডিএইচএ একসঙ্গে চোখের কোষকে রক্ষা করে দৃষ্টি শক্তি ভাল রাখে।
জাগো নিউজ: সাধারণ মানুষের জন্য ওমেগা থ্রি ডিম খাওয়া কি সত্যিই প্রয়োজন?
মোহাম্মদ আরিফ ইকবাল: সাধারণ মানুষের জন্য ওমেগা-৩ ডিম খাওয়া প্রয়োজনীয় নয়, তবে উপকারী হতে পারে।
জাগো নিউজ: প্রতিদিন কয়টা ডিম খাওয়া স্বাস্থ্যকর? ওমেগা থ্রি ডিম হলে কি পরিমাণ আলাদা হবে?
মোহাম্মদ আরিফ ইকবাল: সাধারণভাবে প্রতিদিন ১ টা ডিম খাওয়া স্বাস্থ্যকর। তবে পুষ্টিবিদের পরামর্শ মতে রোগীর স্বাস্থ্য বিবেচনা করে কম বেশি হতে পারে।

জাগো নিউজ: বাজারে ওমেগা থ্রি ডিম কিনতে গেলে কোন বিষয়গুলো লক্ষ্য করা উচিত?
মোহাম্মদ আরিফ ইকবাল: ‘ওমেগা থ্রি সমৃদ্ধ ডিম’, ‘ওমেগা-৩ ডিএইচএ/ইপিএ ডিম’ বা “ফ্ল্যাক্সসিড-ফেড হেনস্’ ডিম” লেখা দেখে কিনতে হবে। এছাড়া প্রতি ডিমে ≥১০০ গ্ৰাম ডিএইচএ বা ≥২৫০ গ্ৰাম সম্পূর্ণ ওমেগা–৩ লেখা দেখে নেওয়া উচিত।
>> কিছু ব্র্যান্ড শুধুমাত্র ‘ফ্ল্যাক্সসিড-ফেড’ বলে, কিন্তু পরিমাণ উল্লেখ করে না। এগুলোতে ওমেগা-৩ কম থাকতে পারে।
>> ডিমগুলো বিশ্বস্ত ব্র্যান্ড বা প্রতিষ্ঠিত পোল্ট্রি ফার্ম থেকে কিনুন।
>> আইএসও, বিএসটিআই, বা ‘হালাল’ সার্টিফিকেট থাকলে ভালো।
>> মেয়াদ আছে কিনা নিশ্চিত করুন।
>> ফ্রিজে রাখার উপযোগী কিনা লেবেলে দেখুন।
>> প্যাকেট ফাটা বা নোংরা হলে কিনবেন না।
জাগো নিউজ: কারও যদি ডিমে অ্যালার্জি থাকে, তার জন্য কি ওমেগা থ্রি ডিম নিরাপদ?
মোহাম্মদ আরিফ ইকবাল: ডিমের এগ হোয়াইট প্রোটিন বা সাদা অংশটি প্রধানত অ্যালার্জি সৃষ্টির জন্য দায়ী। তবে ডিমে অ্যালার্জি থাকলে ওমেগা-৩ ডিম খাওয়াও নিরাপদ নয়। কারণ, ওমেগা-৩ ডিমও মূলত মুরগির ডিমই। এতে প্রোটিন ও অন্যান্য ডিমের উপাদান থাকে, যা অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে।
এএমপি/এএসএম