বিশ্ব প্রবীণ দিবস

প্রবীণদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে দরকার সঠিক প্ল্যান

আনিসুল ইসলাম নাঈম
আনিসুল ইসলাম নাঈম আনিসুল ইসলাম নাঈম , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ০৭:১০ পিএম, ০১ অক্টোবর ২০২৫
প্রবীণদের ক্ষেত্রে টাইপ-২ ডায়াবেটিস বেশি দেখা দেয়। ছবি/জাগো নিউজ

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা যেমন কমে, তেমনি বাড়ে নানা রোগের ঝুঁকি। এর মধ্যে অন্যতম হলো ডায়াবেটিস। বাংলাদেশে অনেক প্রবীণ নাগরিকই এই রোগে আক্রান্ত। আবার অনেকেই জানেন না - তাদের দেহে হয়তো নীরবে বাসা বেঁধেছে এই ব্যাধি।

অথচ সচেতনতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন ও চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমেই ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এ বিষয়ে বিস্তারিত জাগো নিউজকে জানিয়েছেন মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসের হেড অফ ডায়াবেটিস সেন্টার, ডা. এজাজ বারী চৌধুরী-

  • জাগো নিউজ: প্রবীণদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস কেন বেশি দেখা যায়? বয়সের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?

ডা. এজাজ বারী চৌধুরী: প্রবীণদের ক্ষেত্রে সাধারণত দুটি কারণে ডায়াবেটিস বেশি দেখা দেয়। প্রথমত, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। তখন শরীরে আগের মতো ইনসুলিন তৈরি করতে বা ইনসুলিনের কার্যকারিতা ধরে রাখতে পারে না। একারণে প্রবীণদের ডায়াবেটিস প্রবণতা বেশি।
দ্বিতীয়ত, যুবক বয়সে আমাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম করা হয়ে থাকে। বয়সের পাল্লা ভারী হলে সবাই স্বাস্থ্য সচেতন হয়। তখন বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। আর তখনই ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। তবে মনে রাখতে হবে প্রায় ৫০% ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের কোন লক্ষণ থাকে না। সেকারণে বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগ ধরা পড়ে বেশি।

  • জাগো নিউজ: প্রবীণদের জন্য টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের মধ্যে কোনটি বেশি দেখা যায়?

ডা. এজাজ বারী চৌধুরী: প্রবীণদের ক্ষেত্রে টাইপ-২ ডায়াবেটিস বেশি দেখা দেয়। প্যানক্রিয়াস বা অগ্নাশয়, যেখানে আমাদের ইনসুলিন তৈরি হয়, সেটা অকার্যকর হয়ে গেলে ইনসুলিন তৈরি করার কৌশলও ধ্বংস হয়ে যায়। এটিই টাইপ-১ ডায়াবেটিস। এজন্য টাইপ-১ বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। এটি বয়স্কদের একেবারে হবেনা, এমন নয়। তবে পরিমাণ খুব কম।
আর টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে অন্যান্য সমস্যা থাকে। যেমন- ইনসুলিন রেজিস্ট্র্যান্স, ইনসুলিন রিসেপ্টার ব্লক, ইনসুলিন কম তৈরি হওয়া, কার্যকারিতা কমে যাওয়া, লিভারে সমস্যা থাকা ইত্যাদি সমস্যার কারণে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হতে পারে। প্রবীণদের ক্ষেত্রে টাইপ-২ ডায়াবেটিস বেশি হয়ে থাকে।

  • জাগো নিউজ: একজন বয়স্ক ব্যক্তির ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে কী ধরনের খাদ্য গ্রহণ করা উচিত?

ডা. এজাজ বারী চৌধুরী: একজন প্রবীণ বা বয়স্ক ব্যক্তির ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সুষম খাদ্যাভ্যাস জরুরি। দৈনিক নির্ধারিত সময়ে খাবার খেতে হবে। যারা ঔষধ বা ইনসুলিন নেন, তাদের ক্ষেত্রে জেগে থাকা অবস্থায় তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার মধ্যে খাবার গ্রহণ করা জরুরি। সেক্ষেত্রে সকালের নাস্তায় রুটি, ভাজি, ডিম এবং টক ফলমূল খাওয়া। দুপুরের খাবারে ভাত, মাছমাংস, ডাল, সবজি খাওয়া। রাতের খাবারে ভাত বা রুটি, মাছ বা মাংস, ডাল, সবজি খেতে হবে।
সকাল ও দুপুরের মধ্যবর্তী সময়ে কিছু সময় গ্যাপ থাকে। এ গ্যাপের মাঝামাঝি সময়ে একটা হালকা নাস্তা করতে হবে। একইভাবে দুপুর ও রাতের খাবারের মধ্যবর্তী সময়ে কিছু স্ন্যাকস আইটেম বা হালকা নাস্তা করতে হবে। তবে খাবারের মধ্যে ভাজাপোড়া বা অতিরিক্ত তেল জাতীয় খাবার না খাওয়া উত্তম। সর ছাড়া দুধ, বাদাম, গাজর, নুডলস, বিস্কিট, মুড়ি, মিষ্টি ফল - পরিমাণমত এই সুষম খাবার খেতে হবে। প্রবীণ বা বয়স্কদের অনেক সময় ঘুমের সমস্যা থাকে। তারা বেশি রাত জাগলে ব্লাড সুগার কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য বিছানার পাশে মুড়ি, এককাপ দুধ ও বিস্কিট রাখতে পারেন। যাতে ক্ষুধা লাগলে খেতে পারেন।

প্রবীণদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে দরকার সঠিক প্ল্যান

  • জাগো নিউজ: প্রবীণদের রুটিনমাফিক হাঁটা বা হালকা ব্যায়ামের ভূমিকা কতটা কার্যকর?

ডা. এজাজ বারী চৌধুরী: রুটিনমাফিক হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই কার্যকর। এটি রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে অতিরিক্ত সুগার বা শর্করা থাকে। শারীরিক পরিশ্রম করলে এই সুগার কোষের মধ্যে পৌঁছাতে পারে৷ তখন ডায়াবেটিস কমে যায়। আবার কোষও তার খাবার পায়।
আমরা যখন হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করি। তখন মাংসপেশির কোষগুলোর অতিরিক্ত অ্যানার্জি বা শক্তির প্রয়োজন হয়। সেসময় ইনসুলিন ছাড়া নিজে থেকেই কোষের দরজাগুলো খুলে যায়। তখন আমাদের কোষগুলো রক্ত থেকে সরাসরি গ্লুকোজ নিতে পারে। হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করলে রক্তের অতিরিক্ত গ্লুকোজ কোষ বা মাংসপেশি ব্যবহার করতে পারে।
তবে প্রবীণদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যায়াম করা অবশ্যই ক্ষতিকর। এতে অনেক সময় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। হাত-পা ভাঙ্গা ও হাড় ক্ষয় হবার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য দিনে ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করা উত্তম। এর থেকে বেশি করা ঠিক হবে না।

  • জাগো নিউজ: প্রবীণদের ডায়েট প্ল্যান করার সময় কোন বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হয়?

ডা. এজাজ বারী চৌধুরী: প্রবীণদের ডায়েট প্ল্যানের আগে তাদের খাবারের পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে জানতে হবে। পেটের কোন সমস্যা, গ্যাস এবং অ্যালার্জির সমস্যা রয়েছে কিনা। আবার সবার আর্থিক অবস্থা এক নয়। পরিবারে কেমন খাবার বেশি প্রচলিত। এই বিষয়গুলো জেনে-বুঝে আমরা রোগীর জন্য সবচেয়ে বেশি নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য খাবার তালিকা দিয়ে থাকি।
এক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ, আর্থিক অবস্থার বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়। কারণ একেক ধর্মে একেক রকম খাবারের প্রচলন রয়েছে। কেউ মাংস-মাছ খায়, আবার কেউ নিরামিষভোজী। প্রবীণদের মধ্যে কারো দাঁতে সমস্যা থাকে, কারো খাবারের রুচি কম থাকে। এক্ষেত্রে এমনভাবে খাবার তালিকা করা হয় যাতে অল্প খাবারে বেশি ক্যালরি থাকে।

  • জাগো নিউজ: বয়সজনিত কারণে প্রবীণরা অনেক সময় ওষুধ ঠিকমতো নিতে ভুলে যান। এই সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করা যায়?

ডা. এজাজ বারী চৌধুরী: প্রবীণদের ক্ষেত্রে ওষুধ নিতে ভুলে যাওয়া একটা সাধারণ সমস্যা। আবার দেখা যায় অনেকে একবার ওষুধ নিয়েও আবার ভুলবশত ওষুধ খেয়ে ফেলেন। ডাবল ডোজ হতে পারে আবার ডোজ মিসও হতে পারে। এজন্য পরিবারের অন্য সদস্যদের এগিয়ে আসতে হবে। যাতে বয়স্ক সদস্যের সময়মত ওষুধ নিতে ভুল না হয়।
এক্ষেত্রে সকাল, দুপুর ও রাতের জন্য তিনটি বক্স তৈরি করা যেতে পারে। এতে তিন বেলার ওষুধ আলাদা করে রাখবেন। আর যারা ইনসুলিন নেন তাদের বাসার লোকজন ইনসুলিন পুশ করে দিলে ভালো হয়। কারণ প্রবীণরা অনেক সময় চোখে ঠিক মতো দেখেন না, তাই ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে।

  • জাগো নিউজ: ডায়াবেটিস আক্রান্ত প্রবীণরা মানসিকভাবে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন?

ডা. এজাজ বারী চৌধুরী: বয়স বাড়ার সঙ্গে মানুষের মধ্যে ডিপ্রেশন ও একাকিত্ব বাড়তে থাকে। এ ছাড়া মৃত্যুর একটা ভয় সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। আশেপাশের প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধবদের মৃত্যু তাদের মধ্যে একটা বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
আবার ডায়াবেটিস শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও সমস্যা তৈরি করে। যেমন- কিডনি, হার্ট, চোখ, নার্ভ ইত্যাদি। অনেক সময় তাদের শারীরিক সমস্যাগুলো মানসিক চাপের বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রবীণদের ক্ষেত্রে হতাশা, ডিপ্রেশন, একাকিত্ব সামাল দিতে পরিবারের সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।
প্রবীণদের একাকিত্ব দূরীকরণে সঙ্গ দিতে পারেন, এতে তাদের মনের অবস্থা পরিবর্তন হবে। এছাড়া প্রবীণ ডায়াবেটিস রোগীদের একটা গ্রুপ করা যেতে পারে। একসঙ্গে হাঁটা, গল্প করা, নিজেদের মধ্যে সমস্যা শেয়ার করার মাধ্যমে মানসিক চাপ কমবে। তারপরও যদি দেখা যায়, মানসিক চাপ কমছে না। তবে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

এএমপি/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।