চট্টগ্রামে করোনার জিন বিন্যাসে ইউরোপের নমুনার মিল
অডিও শুনুন
চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের নমুনার সঙ্গে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তদের নমুনার মিল পেয়েছেন গবেষকরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) একদল গবেষক করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করে এই মিল পেয়েছেন। এছাড়া সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন যে ধরন পাওয়া গেছে, তার বেশ কয়েকটি মিউটেশনের একটির সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন তারা।
এর মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো চট্টগ্রাম বিভাগের করোনাভাইরাসের জিনের বিন্যাস উন্মোচনের কাজ সম্পন্ন হলো। গবেষকরা চট্টগ্রাম বিভাগের সব জেলা থেকে করোনাভাইরাসের (SARS-CoV-2) নমুনা সংগ্রহ করে বড় আকারে গবেষণার মাধ্যমে জিনের বিন্যাস উন্মোচন (জিনোম সিকোয়েন্সিং) করেছেন। এই জিনোম সিকোয়েন্সিং থেকেই এসব তথ্য মিলেছে।
এই গবেষণা দলে ছিলেন- চবির বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভুঁইয়া, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল এবং মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ইমরানুল হক ও ড. এইচ এম আবদুল্লাহ আল মাসুদ।
এছাড়াও উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. খন্দকার রাজিউর রহমান, ইমাম হোসেন, মো. আরিফ হোসাইন ও সজীব রুদ্র, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের শান্তা পাল এবং বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের মো. ওমর ফারুক এই গবেষণায় সম্পৃক্ত ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে, এই গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম বিভাগে করোনার সার্বিক চিত্র তুলে ধরা, সে লক্ষ্যে প্রতিটি (১১টি) জেলার সবগুলো উপজেলা/থানা থেকে করোনা পজিটিভ রোগীর নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তারপর, আরএনএ এর পরিমাণ (কনসেনট্রেশন) ও গুণের (কোয়ালিটি) ওপর ভিত্তি করে ৪৬টি নমুনা জিনোম সিকোয়েন্সিং এর জন্য নির্বাচন করা হয়। যার মধ্যে ৩৩টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স ৯৯ শতাংশের ওপরে উন্মোচিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ১২টি নমুনার জিনের বিন্যাস গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা (GISAID) ডেটাবেইসে জমা দেয়া হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে ৩০টি জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে ধারণা পাওয়া গেছে, চট্টগ্রাম বিভাগের ভাইরাসটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, সৌদি আরব, তাইওয়ান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার ভাইরাসের দারুণ সাদৃশ্য রয়েছে। প্রত্যেক জেলার ডেটা পৃথকভাবে পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে এর মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা আছে।
যেমন- চট্টগ্রাম জেলায় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইটালি, চেক রিপাবলিক, সৌদিআরব ও তাইওয়ান; নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী জেলায় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপান; কুমিল্লা ও চাঁদপুরে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, চেক রিপাবলিক, ভারত ও জাপান; ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সৌদি আরব ও ভারত; কক্সবাজার, রাঙামাটি ও বান্দরবানে যুক্তরাষ্ট্র, সিয়েরা লিওন, জার্মানি, ইটালি, তাইওয়ান ও চেক রিপাবলিক এবং খাগড়াছড়িতে অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব ও তাইওয়ানের নমুনার সাথে সাদৃশ্য বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
গবেষকরা জানান, দেশের ভাইরাসের সিকোয়েন্সগুলোর (বিশ্লেষণকৃত ৩০টির) স্পাইক প্রোটিনের বিন্যাসে অন্য মিউটেশনের সাথে ৫টি এমন মিউটেশন পাওয়া গেছে, যেগুলো GISAID ডাটাবেইস অনুসারে অন্যান্য দেশে পাওয়া গেলেও বাংলাদেশ থেকে এই প্রথম শনাক্ত করা হয়।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্পাইক প্রোটিনে উপযুক্ত পরিবর্তনগুলো একত্রে পাওয়া না গেলেও কয়েকটি পরিবর্তন আলাদা আলাদাভাবে ভিন্ন ভিন্ন দেশে লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু ভাইরাসটি একত্রে কিংবা আলাদা আলাদা পরিবর্তনগুলোর জন্য অধিক শক্তিশালী হচ্ছে কিংবা শক্তি হারাচ্ছে কি না তা বলার জন্য আরও উচ্চতর গবেষণা প্রয়োজন।
বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের ছাত্র ওমর ফারুক জানান, চট্টগ্রাম বিভাগের প্রায় সব জেলায় আক্রান্তদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইরাসের সদৃশ ভাইরাস পাওয়া গেছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যে মিউটেশনটি সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে সেটি হচ্ছে ডি৬১৪জি। চট্টগ্রাম বিভাগেও এটি সবচেয়ে বেশি আছে। যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন স্ট্রেইনের মধ্যে ছয়টি মিউটেশনের একটি পরিবর্তন হচ্ছে ‘পি৬৮১এইচ’। এটি এখানেও পাওয়া গেছে। তবে কোনোভাবেই বলা যাবে না যে এটি যুক্তরাজ্যের সেই ভ্যারিয়েন্ট। কারণ যুক্তরাজ্যের ভাইরাসের ১৭টি মিউটেশন আছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। এর মধ্যে মাত্র একটি মিউটেশন পাওয়া গেছে।
তিনি জানান, গবেষণায় প্রাথমিকভাবে দেখা যাচ্ছে সব সিকোয়েন্সের বিভিন্ন লোকেশনে মোট ১২৬টি ভিন্ন ভিন্ন মিউটেশন হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি মিউটেশন চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে।
প্রসঙ্গত, এর আগে করোনাভাইরাসের সাতটি নমুনার জিনোম সিকুয়েন্স নির্ণয় করে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)। সেটি ছিলো চট্টগ্রাম বিভাগে প্রথম করোনাভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্স উদঘাটনের ঘটনা।
সে সময় সিভাসু উপাচার্য ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ জাগো নিউজকে জানিয়েছিলেন, সাতটি সিকুয়েন্সের মধ্যে দু’টি সম্পূর্ণরূপে সিঙ্গাপুরে আক্রান্তদের সঙ্গে মিলে গেছে। বাকি পাঁচটি সিকুয়েন্স শতভাগ অন্য কোনো দেশের আক্রান্তদের সঙ্গে মেলেনি। শূন্য দশমিক ১ শতাংশ হলেও হয়তো মিউটেশন ঘটেছে।
গত ১২ মে দেশে সর্বপ্রথম চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন (সিএইচআরএফ) করোনাভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্স নির্ণয় করে।
ইএ/এমএস