এবারও হচ্ছে না জব্বারের বলীখেলা
করোনা পরিস্থিতির কারণে এবারও হচ্ছে না চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আব্দুল জব্বারের বলীখেলা। প্রতি বছর ১২ বৈশাখ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তি বা বলীখেলা নামে পরিচিত এ আসর বসে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে। হঠাৎ করে দেশব্যাপি আবারও করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবারও ঐতিহ্যবাহী আব্দুল জব্বারের ১১২তম বলীখেলার আসর স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আয়োজক কমিটি।
বুধবার (১০ মার্চ) সকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিং মেলা কমিটির পক্ষে সভাপতি কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী এ ঘোষণা দেন।
এ সময় মেলা কমিটির সহ-সভাপতি সাংবাদিক চৌধুরী ফরিদ, সাধারণ সম্পাদক শওকত আনোয়ার বাদল, সাংগঠনিক সম্পাদক মুহাম্মদ জামাল হোসেন, বলীখেলা ও মেলা কমিটির সহ-সভাপতি সাবেক কাউন্সিলর এম এ মালেক, কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব, সাবেক কাউন্সিলর এস এম জাফর, সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ তৈয়ব, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আখতার আনোয়ার বাদল, সাংবাদিক আইয়ুব আলী, সাংবাদিক দেবু প্রাসাদ উপস্থিত ছিলেন।
১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এ প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। করোনার কারণে গত বছরও স্থগিত করা হয়েছিল জব্বারের বলীখেলা।
জব্বারের বলীখেলা একটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত। বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লালদীঘি ময়দানের আশপাশে প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। এটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকার সবচেয়ে বড় বৈশাখী মেলা।
বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর এ দেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়। এক সময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়। শুরু হয় স্বদেশি আন্দোলন। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একইসঙ্গে বাঙালি যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর প্রেরণা থেকেই চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলীখেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন।
১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ লালদীঘি ময়দানে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামিদামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন।
চট্টগ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের ভাষ্য, চট্টগ্রাম বলীর দেশ। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের ১৯টি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী, সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরত প্রদর্শন। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলীখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলীখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা।
জব্বার মিয়ার বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়। খেলাকে কেন্দ্র করে তিনদিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও কার্যত পাঁচ-ছয় দিনের মেলা বসে লালদীঘি ময়দানের আশপাশের এলাকা ঘিরে।
জব্বারের বলীখেলার পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন স্থানে যেমন- কক্সবাজারে ডিসি সাহেবের বলীখেলা, সাতকানিয়ায় মক্কার বলীখেলা, আনোয়ারায় সরকারের বলীখেলা, রাউজানে দোস্ত মোহাম্মদের বলীখেলা, হাটহাজারীতে চুরখাঁর বলীখেলা, চান্দগাঁওতে মৌলভীর বলীখেলা এখনো কোনো রকমে বিদ্যমান। যদিও এবার কোনোখানেই এই খেলা অনুষ্ঠিত হবে না।
জব্বরের বলীখেলার বর্তমান চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার শাহজালাল বলী। জব্বারের বলীখেলায় এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ চ্যাম্পিয়ন দিদার বলী। তিনি সর্বোচ্চ ১৩ বার বিজয়ী হয়েছেন। বর্তমানে দিদার বলী এ খেলা থেকে অবসরে আছেন।
আবু আজাদ/এএএইচ/এএসএম