করোনাকালে ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে
করোনাকালে দেশের ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এ সময় ঝরে পড়া ১৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরী এখন আর পড়াশোনার খরচই চালাতে পারছে না।
বুধবার (১ জুন) রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে কিশোরীদের ঝুঁকি ও পরিবর্তিত পরিস্থিতি’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরেন বক্তারা।
এ সময় বক্তারা জানান, কোভিড-১৯ মহামারিকালীন সংকটে দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকায় কিশোর-কিশোরীদের জীবনাচরণে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন এসেছে।
মহামারির আগে ৩৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা পড়াশোনা করতো। কিন্তু মহামারির সময় এই হার ১৪ শতাংশে নেমে আসে।
গবেষণায় পাওয়া তথ্য হতে দেখা যায়, করোনাকালীন ২৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরী নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ছেলেরা শারীরিক ও মেয়েরা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে।
গবেষণা বলছে, মহামারির আগে ও পরে বাল্যবিবাহের হারে সামান্য ব্যবধান হয়েছে। প্রায় ৫০ শতাংশ অভিভাবক জানিয়েছেন, মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে কোভিড-১৯'র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিলো।
কিশোরী ও তার পরিবারের সম্মান সুরক্ষিত রাখতে তাকে দ্রুত বিয়ে দিতে হবে- করোনাকালীন প্রতিনিয়ত এমন সামাজিক চাপের মুখে ছিল কিছু পরিবার। এর ফলে বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা।
গবেষণা পাওয়া ফলাফলে দেখা যায়, বাল্যবিবাহ ও স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পেছনে দারিদ্র্যের চেয়ে নিরাপত্তা এবং পারিবারিক সম্মান হারানোর ঝুঁকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্কুল বন্ধের প্রেক্ষাপটে অভিভাবকরা কিশোরদের কাজে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, করোনার সময় শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মনো-সামাজিক টানাপোড়ন, সহিংসতার ঝুঁকি বৃদ্ধি, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ- এমন বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে কিশোর-কিশোরীদের।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, করোনাকালীন অর্থনৈতিক কারণ ও স্কুল বন্ধ থাকা- এই দুটি বিষয় কিশোর-কিশোরীদের জন্য আগে থেকেই চলমান ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে এবং নতুন ঝুঁকির ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
‘আমাদের গবেষণা ও আজকের আলোচনা থেকে আমরা এটাই দেখার চেষ্টা করেছি নীতি নির্ধারণে ও কর্মসূচি প্রণয়নে কীভাবে ব্যাপারটিকে তুলে ধরা যায়। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমস্যা পর্যালোচনা, শিক্ষার মানে ওপর গুরুত্বারোপ ও সামাজিকীকরণের শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে স্কুলকে গড়ে তোলা হতে পারে আমাদের নীতিগত অগ্রাধিকার।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার বলেন, আমাদের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সমস্যা থেকে উত্তরণ এবং একই সঙ্গে মানুষের সক্ষমতা ও সুস্থতাকে সামগ্রিকভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। আরও স্থিতিস্থাপক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা প্রণয়নে সরকার, উন্নযন অংশীদার ও সুশীল সমাজ একসঙ্গে কাজ করতে পারে। সেই ব্যবস্থাই আমাদের লিঙ্গ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা নির্বিশেষে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে একটি মৌলিক মানবিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন জার্মান উন্নয়ন সংস্থা জিআইজেড প্রকল্পের জাতীয় প্রকল্প পরিচালক উম্মে কুলসুম। তিনি বলেন, এটি খুব সুষ্পষ্ট যে সরকার ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কোভিড-১৯ থেকে পুনরুদ্ধারের কৌশল এবং লৈঙ্গিক সমতা ও নারীর ক্ষমতা কাঠামোকে চিহ্নিত করেছে।
‘আলোচক-দর্শকদের মতামত ও গবেষণার মূল বিষয়বস্তু জানার পর আমি মনে করি, কোভিড থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে লৈঙ্গিক সমতা এবং নারী ক্ষমতায়ন কাঠামোকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এ গবেষণায় নারী ও কিশোরীদের যেসব সমস্যা উঠে এসেছে তা মোকাবিলায় এই কাঠামো বড় ভূমিকা রাখবে।’
ব্রিটিশ হাই কমিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার জাভেদ প্যাটেল বলেন, ইউকে (যুক্তরাজ্য) ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও) ও জার্মান ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ইকোনমিক কো-অপারেশান অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিএমজেড) এর সহায়তায় বিআইজিডি যে গবেষণাটি করেছে তাতে পরিষ্কার বোঝা যায় মহামারি কীভাবে কিশোর-কিশোরীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে।
কোভিড পরবর্তী সময়ে তাদের স্কুলে ফিরিয়ে নেওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। বিশেষ করে কিশোরীদের শিক্ষায় ফিরিয়ে নেওয়াটা হয়তো আরও অনিশ্চিত হবে। ইউকে সরকার সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করেছে। নারী ও কিশোরীরা তাদের সফলতার পথটি যাতে স্বাধীনভাবে বেছে নিতে পারে সে ব্যাপারে এই ধরনের গবেষণা আমাদের অনেক সহাযতা করবে।
জার্মান দূতাবাসের উন্নয়ন সহযোগিতা বিভাগের উপপ্রধান ক্যারেন ব্লুম বলেন, এবছর বাংলাদেশ-জার্মান অংশীদারত্ব ৫০ বছরে পদার্পণ করলো। আজকের গবেষণার মতো অন্যান্য গবেষণাগুলো উন্নয়ন অংশীদারত্বের কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেওয়ার জন্য সুযোগ তৈরি করা। এই গবেষণার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, কোভিডের কারণে কিশোর-কিশোরীদের সম্ভাবনা এবং সুযোগ কিভাবে সীমাবদ্ধ হয়েছে।
জিআইজেডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. অ্যাঙ্গেলিকা ফ্রেডারমান বলেন, কিশোর-কিশোরীদের ওপর করা গবেষণা আমাদের ভবিষ্যৎ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের জনগণের ২১ শতাংশই তরুণ অর্থাৎ এ দেশের ভবিষ্যৎ তরুণ জনগোষ্ঠীর হাতে। শিশুদের জন্য সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে সেটা তাদের জীবন ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করবে।
মিশ্র পদ্ধতির এই গবেষণাটি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস- এই সময়ের মধ্যে করা হয়। করোনা সংকট কিশোর-কিশোরীদের জীবনে কীভাবে পরিবর্তন এনেছে ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে এ দেশের নারী ও কিশোরীদের অবস্থা কেমন, বিশ্লেষণের মাধ্যমে এসব জানা ছিলো গবেষণার লক্ষ্য।\
গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনের অতিথিরা একটি প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি) এম এম মাহমুদুল্লাহ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম, ব্র্যাকের সাবেক পরিচালক (শিক্ষা) ড. শফিকুল ইসলাম ও ক্ল্যারিসা কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর ড. জিনিয়া আফরোজ প্রমুখ।
এএএম/এমপি/এএসএম