‘হাওরের প্রাণ-প্রকৃতি বিবেচনায় নিয়েও উন্নয়ন সম্ভব’

গওহার নঈম ওয়ারা। লেখক, গবেষক। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের সামাজিক ইতিহাস তার প্রধানতম গবেষণার ক্ষেত্র। দুর্যোগ-দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে।
হাওরে বন্যার প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। বলেন, হাওরের স্বকীয়তা বজায় রেখেই উন্নয়ন করা সম্ভব। প্রাণ-প্রকৃতির ভাবনা না করে উন্নয়নে গেলে হাওরের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবেই। প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা-জবাবদিহিতা না থাকার কারণে দুর্যোগে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়ে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু
জাগো নিউজ: হাওরের দুঃখ পুরোনো। আপনার লেখায়, গবেষণায় গুরুত্ব পাচ্ছে এ অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতিও। এবারের বন্যার অস্বাভাবিকতা নিয়ে কী বলবেন?
গওহার নঈম ওয়ারা: অল্পসময়ে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হয়েছে এবং বন্যার জন্য এটিই প্রধানতম কারণ। ক্ষয়ক্ষতির আরেকটি কারণ হচ্ছে, আমরা এই বন্যার অস্বাভাবিকতাকে ধারণায় আনতে পারিনি। আর আমরা আত্মতুষ্টিতে এতই মগ্ন হয়ে আছি যে, আমাদের করণীয় আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম। এ কয়টি কারণেই এবারের বন্যায় দুঃখ-কষ্ট বেড়েছে।
এবারের বন্যাটা আচমকা হয়েছে এবং মানুষ ভাবতেই পারেনি যে, এত পানি নেমে আসবে। মেস বা একা থাকা চাকরিজীবীদের অনেকেই বৃহস্পতিবার অফিস করে বাড়ি যান। পানির কারণে তারা আর রেখে যাওয়া ভাড়াবাড়িতে ঢুকতে পারেননি। ঘর-বাড়ি সব তলিয়ে গেছে। আট-দশ ফুট উঁচু হয়ে জলোচ্ছ্বাসের মতো পানি এসেছে। পরিস্থিতি ধারণার বাইরে ছিল।
জাগো নিউজ: বন্যার পূর্ভাবাস মিলেছিল আগেই। ধারণার বাইরে বলছেন কেন?
গওহার নঈম ওয়ারা: সাধারণ মানুষ তো বুঝতে পারেনি। তাদের সেভাবে বোঝানো হয়নি, বলা হয়নি। যারা বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন তাদের ধারণার বাইরে ছিল না হয়তো। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে যে বার্তা সঠিকভাবে পৌঁছায়নি সেটা এখন পরিষ্কার। কী পরিমাণ পানি এলে সিলেট শহরের কোন কোন জায়গা প্লাবিত হবে, এটি সাধারণ মানুষের বোঝার কথা নয়। তারা বুঝতেও পারেনি।
জাগো নিউজ: প্রকৃতির ওপর কী আসলে অনুমান যায়?
গওহার নঈম ওয়ারা: বৃষ্টি হচ্ছে, কী পরিমাণ বৃষ্টি হতে পারে, তারও অনুমান করে বার্তা মিলছে। উজানের চেরাপুঞ্জি থেকে সিলেটে পানি নেমে আসতে কতক্ষণ সময় লাগবে এসব তথ্য সংগ্রহের প্রযুক্তি তো আমরা ব্যবহার করেই আবহাওয়ার খবর দিচ্ছি। এই তথ্যগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে যদি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো যেত, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হতো।
আমি আরেকটু সহজ করে বিষয়টি বলতে চাই। গত ডিসেম্বর ও মার্চের শুরুতে বাংলাদেশে বৃষ্টি হলো। এই বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি হলো ফসলের। কাঁটাতারের ওপারে পশ্চিমবঙ্গ এবং প্রায় একই ধরনের আবহাওয়ায় দু’অঞ্চলের মানুষ বাস করি। আমাদের ফসলও প্রায় একই। ওই বৃষ্টিতে কিন্তু তাদের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তারা এই অসময়ের ভারি বৃষ্টির কথা একেবারে গ্রামে গ্রামে গিয়ে পঞ্চায়েত পর্যন্ত পৌঁছিয়েছিল। মাইকিং করেছিল। কৃষক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পেল। আর আমাদের কৃষকের কাটা ধান মাঠে থেকে ভিজে নষ্ট হলো। ওরা আলু বা অন্য ফসল বৃষ্টির পরে বপন করলো। আমাদের কৃষক তথ্য না জানার কারণে বৃষ্টির আগেই বপন করে ক্ষতির সম্মুখীন হলেন।
আমাদের আবহাওয়ার বার্তা এতই কেন্দ্রীভূত যে, আগারগাঁওয়ের বাইরে সাধারণ মানুষের কাছে আর পৌঁছায় না। অথচ, আবহাওয়ার বার্তা আরও বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সর্বত্র পৌঁছানোর কথা। আমাদের দেশ ছোট্ট। কিন্তু এখানে কৃষিব্যবস্থার বৈচিত্র্য আছে। একেক অঞ্চলে একেক ফসল জন্মে।
জাগো নিউজ: এই প্রশ্নেই আপনার পরামর্শ জানতে চাই?
গওহার নঈম ওয়ারা: আমাদের মানসিকতার সমস্যা। একই মানুষ পশ্চিমবঙ্গে পারলে আমরা পারছি না কেন। সিস্টেম তো একই হওয়ার কথা।
পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক পরিবেশ আছে, জবাবদিহির বিষয় আছে। সেখানে অফিসে গিয়ে মানুষ প্রশ্ন করতে পারেন, জানতে পারেন। আপনি বাংলাদেশে কোনো নির্বাহী অফিসারকে প্রশ্ন করার ক্ষমতা রাখেন না। এক সাংবাদিক এক ইউএনওকে ভাই বলে সম্বোধন করেছিলেন। এই অপরাধে সাংবাদিককে থাপ্পড় মেরে দুটি দাঁত ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে এদেশে। আমলা স্বৈরতন্ত্র তো আপনার অধিকার প্রতিমুহূর্তে ক্ষুণ্ন করছে।
আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে কাজ করেছি। সেখানে আমলাদের সঙ্গে কাজ করেছি। সুনামির পর একবার দেখলাম, এক আইসিএস অফিসারের বদলির সময় গ্রামের মানুষ শুয়ে পড়েছে। তাকে যেতে দেবে না। আমাদের এখানে এই চিত্র দেখতে পাবেন না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের যে আইন করা হয়েছে সেখানে দায়মুক্তির বিষয়ও রাখা হয়েছে। কোনো কর্মকর্তা অন্যয় করলেও তার বিরুদ্ধে কেউ আদালতে মামলা করতে পারবেন না। এটি আমাদের দেশের আইন। দুর্যোগ আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি যদি কোনো কর্মকর্তাকে অপমান বা অপমান করার চেষ্টা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তির কারাদণ্ড হতে পারে! এটাই এখানকার আইন। এই আইন মাথায় রেখে কে তাকে প্রশ্ন করবে? আর ওই কর্মকর্তা উত্তরই বা দেবে কেন?
আপনাকে আরেকটি উদাহরণ দেই। মে মাসে সিলেটে বন্যা হলো। তখন অনেকগুলো সাবস্টেশন বন্ধ হয়ে গেলো পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলো অনেক জায়গা। এরপর তো প্রস্তুতি নেওয়ার সময় ছিল। বর্ষায় আরও খারাপ অবস্থা হতে পারে। ভাদ্র-আশ্বিন মাসেও বন্যা হচ্ছে।
উচিত ছিল এরমধ্যেই সাবস্টেশনগুলো ঘিরে দেয়াল তুলে দেওয়া বা মাটির বাঁধ দেওয়া। এই বন্যার মধ্যেও পৌরমেয়র সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে কুমারগাঁও সাবস্টেশন নিরাপদ করলেন। তার মানে চাইলেই ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।
সিলেটের মতো একটি শহর নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। একে একে হাসপাতাল, এয়ারপোর্ট, রেলস্টেশন বন্ধ হয়ে গেলো। পানিতেই এই অবস্থা। তাহলে ভূমিকম্পে কী হাল দাঁড়াবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সিলেট শহর।
শহর নিয়ে পরিকল্পনা করতে পারেন একজন মেয়র। কিন্তু মেয়রকে কি আমরা সেই ক্ষমতা দিয়েছি? মেয়রের ডাকে তো মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষই আসবেন না। যে দেশে বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা যত ভালো, সেই দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তত ভালো। এ কারণেই উন্নত দেশগুলোয় স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী করা হয়েছে।
জাগো নিউজ: স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আছেই। কিন্তু সবাই তো কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী। এটি তো প্রতিষ্ঠিত কাঠামো। বিকেন্দ্রীকরণ হলেই সমাধান?
গওহার নঈম ওয়ারা: সমাধান হবেই এমন নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু আমাদের তো চেষ্টা করতে হবে। রাজনৈতিক গণতন্ত্র ব্যর্থ হলে রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এর সমাধান করতে হবে।
বিভিন্ন সংস্থা থেকে নৌকা নামানো হয়েছে। এই নৌকাগুলো তো বন্যার জন্য উপযোগী না। বিশেষ ধরনের নৌকা দরকার। বিশেষ নৌযান কেনার কথা ছিল ১৯৯১ সালের বন্যার পর। কেনা হয়নি। এখন আবারও কেনার কথা হচ্ছে। কেনায় সিদ্ধহস্ত। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণে নজর নেই। বহু যন্ত্র কেনা হয়। কিছুদিন পরেই বিকল হয়ে যায়। যত্নের দরকার পড়ে।
সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে আগুন নেভাতে ঢাকা থেকে যন্ত্রপাতি নেওয়া হয়েছে। ততক্ষণে সব শেষ। সেখানে ইন্ডাস্ট্রি, বন্দর রয়েছে। বাড়তি ব্যবস্থা থাকতে হবে সেখানে। সব কেন ঢাকায় থাকতে হবে?
আজ ভলান্টিয়ার (স্বেচ্ছাসেবী) পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের প্রস্তুতিতেই আত্মতুষ্টি। বাস্তবায়নে নেই। আমাদের এলাকায় এক ছেলে এসএসসি পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে এমন খুশি হলো যে পরে এইচএসসিই পাস করতে পারলো না। উচ্ছ্বাস হোক। সমস্যা নেই। কিন্তু সিলেটের প্রশাসনের কাছে জবাব চাওয়া তো যায়, কেন তারা সাবস্টেশনগুলো রক্ষার আগাম পদক্ষেপ নিলো না।
জাগো নিউজ: হাওরের উন্নয়ন বিশেষ করে অল-ওয়েদার সড়ক নিয়ে তো ইতিবাচক গল্পও আছে। এখন এই উন্নয়নকে বিষফোঁড়া বলছেন অনেকেই। এই বন্যা কেন্দ্র করেই এমন সমালোচনা, নাকি প্রাণ-প্রকৃতির সামগ্রিক বিবেচনা থেকে?
গওহার নঈম ওয়ারা: আমরা ধারণার ভিত্তিতে কথা বলতে অভ্যস্ত। কোনো স্ট্যাডি নেই। হাওরে সড়ক নির্মাণের সময় বলা হলো উত্তর-দক্ষিণে করা হয়েছে আর পানি যায় পূর্ব-পশ্চিমে। পানিপ্রবাহে কোনো সমস্যা হবে না। ল্যাবরেটরির মধ্যে বসে কথা বলা আর মাঠে গিয়ে দেখার মধ্যে অনেক ফারাক। হাওরের মধ্যে ২৯ কিলোমিটার রাস্তা বানিয়ে পানি যাওয়ার জায়গা রাখা হলো ৮শ মিটার।
প্রধানমন্ত্রী এখন বলছেন, হাওরের মধ্যে এমন রাস্তা আর বানানো হবে না। পরিকল্পনামন্ত্রীও বারবার একই কথা বলছেন। এখন উড়ালসেতুর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আগের পরিকল্পনা কে করলো, কেন করলো, তার উত্তর মিলবে?
আপনি হাওরের অষ্টগ্রামে গিয়ে দেখেন। হেক্টরের পর হেক্টর জমিতে আর চাষাবাদ হচ্ছে না। সমস্ত জমিতে বালু পড়ে যাচ্ছে। বালুমিশ্রিত পানি আটকে গিয়ে জমি ভরাট হচ্ছে। ফসল ফলছে না। কৃষক আজ দিশেহারা। আমাদের কৃষক তো আর ইন্ডিয়ার কৃষক না। ইন্ডিয়ার কৃষক দিল্লি দখল করতে পারে। আমাদের কৃষক তার ফসলের জন্য প্রশ্নও করতে পারে না। আমাদের কৃষক তো জমির মালিকানাও না। মালিকরা তো থাকেন ঢাকায়। তারা আগাম নগদ টাকা নিয়ে নেন কৃষকের কাছ থেকে। কৃষক ঋণ নিয়ে চাষ করে। ফসল নষ্ট হলে তার যায়। কিন্তু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলে সেটা পায় জমির মালিক। কৃষক পায় না। প্রান্তিক কৃষক সব সুযোগ থেকেই বঞ্চিত। যমুনা সেতু যখন নির্মাণ করা হয় তখন বলা হয়েছিল, উত্তরবঙ্গের ঘরে ঘরে উন্নয়নের জোয়ার বইবে। মানুষ শস্যের দাম পাবে। এখন লালমনিরহাট থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত আসতে একটি ট্রাক মালিককে যে পরিমাণ চাঁদা দিতে হয়, তাতে দুই বছরে আরেকটি ট্রাক কেনা সম্ভব। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ মিলবে কীভাবে?
জাগো নিউজ: প্রান্তিক কৃষকের জন্য কী উপায় বলবেন?
গওহার নঈম ওয়ারা: সব জায়গায় ব্লক সুপারভাইজর বা সহকারী কৃষি অফিসার আছেন। তারা জানেন কোন জমি কোন শর্তে কে আবাদ করেন। ক্ষতিপূরণ প্রদানে তাকে যুক্ত করতে পারলে সঠিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তার কাছে ক্ষতিপূরণ বা প্রণোদনা পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু এভাবে কেউ চিন্তা করবে না।
জাগো নিউজ: এই উন্নয়ন সংস্কৃতি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
গওহার নঈম ওয়ারা: হাওর ব্যবস্থাপনায় সার্বিকভাবে ভাবতে হবে। হাওরের প্রাণ-প্রকৃতি বিবেচনায় নিয়েও উন্নয়ন করা সম্ভব। মিঠামইনে একটা সড়ক করলে সুনামগঞ্জে তার প্রভাব কী পড়বে তা বিবেচনায় আনতে হবে। বিজ্ঞানীদের কথা, বিশেষজ্ঞদের কথা শুনতে হবে। তাদের কথা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তর্কের মধ্য থেকে যেটি কম ক্ষতিকর সেটি গ্রহণ করতে হবে। এই তর্ক তো হয় না। এই তর্ক তোলা জরুরি। নদী, পাহাড়, হাওরের আলাদা আলাদা ধারা আছে। এই ধারাকে ধারণ করেই ভাবতে হবে।
হাওর চলে গেলে আমাদের অনেককিছুই হারাতে হবে। মেঘনা নদীর পানি সরবরাহ হয় হাওর থেকে। হাওর ক্ষতিগ্রস্ত হলে মেঘনা নদীও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব নিয়ে গবেষণা চলামান রাখতে হবে।
এএসএস/এএসএ/জিকেএস