ইসিতে ১৫ প্রিজাইডিং অফিসারের চিঠি

সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণভাবে ভোট চলছিল, বন্ধ করেন রিটার্নিং অফিসাররা

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:১৩ পিএম, ১২ অক্টোবর ২০২২
ভোট বন্ধের পর নির্বাচনী সরঞ্জাম কেন্দ্র থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়/ছবি: জাগো নিউজ

অনিয়ম, কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠায় গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ-নির্বাচনে ভোটগ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (সিইসি)। বুধবার (১২ অক্টোবর) দুপুরে ঢাকার নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ের সামনে ব্রিফিংয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ ঘোষণা দেন। ওইসময় সিইসি জানান, সিসিটিভি ফুটেজে তিনি এবং অন্য নির্বাচন কমিশনাররা নিজ চোখে ভোটকেন্দ্রে আইন লঙ্ঘন হতে দেখেছেন। ৫০টিরও বেশি কেন্দ্র ইসির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় তারা ভোট বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

তবে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ চলছিল বলে জানিয়েছেন প্রিজাইডিং অফিসাররা। তাদের কেন্দ্রে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ চলছিল বলে জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন অন্তত ১৫ জন প্রিজাইডিং অফিসার। তবে সহকারী রিটার্নিং অফিসারের নির্দেশে তারা ভোটগ্রহণ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) স্বহস্তে লেখা চিঠিও পাঠিয়েছেন প্রিজাইডিং অফিসাররা।

সমরপড়া দাখিল মাদরাসা কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন মশিউর রহমান। তিনি নির্বাচন কমিশন বরাবর দেওয়া এক চিঠিতে লিখেছেন, তার কেন্দ্রে ভোট সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ সহকারী রিটার্নিং অফিসার কামরুল ইসলামের নির্দেশে তিনি ভোটগ্রহণ বন্ধ করেন।

ইসিতে দেওয়া প্রিজাইডিং অফিসারদের চিঠি/ছবি: সংগৃহীত

সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল লতিফও একই তথ্য ইসিকে জানিয়েছেন। তিনি লেখেন, ‘আমার কেন্দ্রের ৮টি বুথেই সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ করা হচ্ছিল। দুপুর আড়াইটার মধ্যে ভোট পড়েছে ৮৯৫টি। কিন্তু ৩টার সময় কমিশনের নির্দেশে নির্বাচনকেন্দ্র ত্যাগ করলাম।’

উদয়ন মহিলা কলেজের প্রভাষক প্রিজাইডিং অফিসার মাহমুদুল হাসান। তিনি বেড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে দায়িত্বে ছিলেন। মাহমুদুল হাসান ইসি বরাবর স্বহস্তে লেখা চিঠিতে বলেন, ‘কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই ভোটগ্রহণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কিন্তু রিটার্নিং কর্মকর্তা কামরুল ইসলামের নির্দেশে ভোটকেন্দ্র পরিত্যাগ করলাম।’

আরও পড়ুন: নির্বাচন কমিশনের ‘অদূরদর্শিতায়’ ভোট বন্ধ

নলদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্বে এ কে এম জুলফিকার হায়দার। তিনি চিঠিতে লিখেছেন, ‘নির্বাচনী কর্মকর্তা সহকারী রিটার্নিং অফিসার কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় আমি এ কে এম জুলফিকার হায়দার প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে ১১৩নং নলদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করলাম। ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা হয়নি। ভোটগ্রহণ করা হয়েছে ৪৮০টি। আমরা বিকেল ৩টায় ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করলাম।’

jagonews24নির্বাচন ভবনে ব্রিফ করে ভোট বন্ধের ঘোষণা দেন সিইসি/ছবি: জাগো নিউজ

মোংলারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. কামরুজ্জামান চিঠিতে লেখেন, ‘নির্বাচনী কর্মকর্তা সহকারী রিটার্নিং অফিসার কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় আমি মো. কামরুজ্জামান প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে ১২৮নং মোংলারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করলাম। ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা হয়নি। ভোটগ্রহণ করা হয়েছে ৬৮৯টি। আমরা বিকেল ৩টায় ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করলাম।’

আরও পড়ুন>> গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ-নির্বাচন বন্ধ: সিইসি

মুন্সির হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রিজাইডিং অফিসার শাহ আলম লিখেছেন, ‘সহকারী রিটার্নিং অফিসার কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় আমি মো. শাহ আলম প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে ৭৬নং মুন্সির হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটগ্রহণ বন্ধ করলাম। ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা হয়নি। ভোটগ্রহণ করা হয়েছে আনুমানিক ৬৫০টি। আমরা ৩টায় ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করলাম।’

jagonews24

এদিকে, পুরো নির্বাচনী এলাকায় ইসির এমন ভোট বন্ধের সিদ্ধান্তকে অদূরদর্শিতা বলেছেন অনেকে। এটাকে ইসির ব্যর্থতাও বলেও উল্লেখ করছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা। ভোটকেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যদেরও ঠিকমতো পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। এছাড়া যেসব কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে, সেখানে কেন্দ্রভিত্তিক ভোট স্থগিত করা যেতো। তা না করে তদন্ত ছাড়াই সিসিটিভির ফুটেজ দেখে ভোটগ্রহণ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

আরও পড়ুন>> কাদের কারণে ভোট বন্ধ, তা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি: সিইসি

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে ইসির সক্ষমতার অভাব রয়েছে। তাদের কথা প্রশাসনের কেউ শুনছেন না। আগে থেকেই প্রস্তুতি নিলে এভাবে পুরো ভোট বন্ধ করতে হতো না। ইসির উচিত ছিল পরিস্থিতি দেখে আগেই ব্যবস্থা নেওয়া। এখন অনেকের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে গেলো।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভোট বন্ধের ক্ষমতা ইসিকে দেওয়া আছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও তা ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। কারণ একটি আসনের ভোট বন্ধ হলে জনমনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনার ও প্রার্থীদের আর্থিক ক্ষতি হয়। এজন্য যেসব কেন্দ্রে সমস্যা হয়, সেসব কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করা হয়।

jagonews24

নির্বাচন কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম-সচিব মিহির সারওয়ার মোর্শেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার জানা মতে এভাবে পুরো আসনের ভোট বন্ধের ঘটনা কখনো ঘটেনি। তবে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জনগণের প্রতিরোধের মুখে নারায়ণগঞ্জের একটি আসনের এক উপজেলায় ভোটগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পুরো এলাকায় নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়াটা প্রথম বলে মনে হচ্ছে।’

আরও পড়ুন>> এটা সম্পূর্ণ পরিকল্পিত, সরকারকে বিব্রত করতেই এ ঘটনা: রিপন

গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন চারজন প্রার্থী। তারা হলেন- জাতীয় পার্টির এ এইচ এম গোলাম শহীদ রঞ্জু, বিকল্পধারার জাহাঙ্গীর আলম, স্বতন্ত্রপ্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ ও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। নৌকার প্রার্থী রিপন ছাড়া সবাই অনিয়ম, জালিয়াতি ও কারচুপির অভিযোগ তুলে ভোটবর্জন করেছেন।

শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকা আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপন সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন, তার ছবি সম্বলিত টি-শার্ট নকল করে বহিরাগতদের কেন্দ্রে এনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে প্রতিপক্ষের লোকজন। এতে তার এবং দলের ভাবমূর্তি নষ্টসহ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

এটা সম্পূর্ণ পরিকল্পিত, সরকারকে বিব্রত করতেই এ ঘটনা: রিপন

নৌকার প্রার্থী রিপন বলেন, যেসব কেন্দ্র স্থগিত করা হয়নি সেগুলোর ফলাফল ঘোষণা করা হোক। এছাড়া স্থগিত কেন্দ্রগুলোর পুনরায় নির্বাচন দাবি করছি। এটা সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। সরকারকে বিব্রত করার জন্য একটি মহল এ ঘটনা ঘটিয়েছে। অভিযোগ পেয়েছি, আমার ছবি দিয়ে গেঞ্জি তৈরি করে একটি পক্ষ ভোটকেন্দ্রে এসেছে। তারা বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলা থেকে অনেক সন্ত্রাসী সাঘাটা-ফুলছড়িতে এসেছে।

আরও পড়ুন: গাইবান্ধায় নৌকা ছাড়া সব প্রার্থীর ভোট বর্জন

তিনি আরও বলেন, ‘দুপুর আড়াইটার দিকে গোবিন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে শত শত ভোটার লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেয়। হঠাৎ ঘোষণা এলো নির্বাচন স্থগিত। এর একঘণ্টা পরও অনেক কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ চলে। অধিকাংশ প্রিজাইডিং অফিসাররা কিছুই জানেন না।’

গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ-নির্বাচনে ৪৩ কেন্দ্রের ভোট স্থগিত

অন্যদিকে ইসির এমন সিদ্ধান্ত বোধগম্য নয় বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। ভোট বন্ধের পর এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘গাইবান্ধায় নির্বাচনে কোনো কেন্দ্রেই নৈরাজ্য হয়নি। ঢাকায় নির্বাচন ভবনে বসে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে এতগুলো কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিতের সিদ্ধান্ত ইসি কীভাবে নিলো, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়।’

তবে আইন অনুযায়ী গাইবান্ধায় ভোট বন্ধ করার দাবি করেছেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল।গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছেন, ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কমিশনের কাছে যদি প্রতীয়মান হয় ভোটগ্রহণ সঠিকভাবে হচ্ছে না, ফেয়ারলি হচ্ছে না। তাহলে নির্বাচন কমিশন সব ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দিতে পারে। আমরা এ আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পুরো নির্বাচনী এলাকার (গাইবান্ধা-৫ আসন) ভোট কার্যক্রম আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। নির্বাচন কর্মকর্তাদের তা জানিয়েও দেওয়া হয়েছে।’

এইচএস/ইএ/বিএ/এএএইচ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।