জলোচ্ছ্বাস ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম শহর


প্রকাশিত: ০৬:০১ এএম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
ফাইল ছবি

রাস্তার জন্য কাটা হচ্ছে লক্ষাধিক গাছ। জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় ঝুঁকিতে পড়বে চট্টগ্রাম শহর। চট্টগ্রাম বন্দর পতেঙ্গা থেকে ফৌজদার হাট পর্যন্ত আউটার রিংরোড নির্মাণের জন্য এসব গাছ কাটা হচ্ছে।

এ সমস্ত গাছ বিগত সময়ে চট্টগ্রাম শহর ও শহর রক্ষা বাঁধকে সমুদ্রের থাবা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করেছিল।

বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে সমুদ্রের থাবা থেকে চট্টগ্রাম শহরকে রক্ষাকারী এসব গাছ কাটার কারণে ক্ষোভ বিরাজ করছে সর্বত্র।

প্রশ্ন উঠেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ১৭শ` কোটি টাকার প্রকল্প কার্যকারিতা ও বাস্তবতা নিয়ে। এদিকে, চউক বলছে, সমুদ্রের পাড়ে বেড়িবাঁধ তৈরি করে তার উপর আউটার রিং রোড প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। সড়ক এবং শহররক্ষা বাঁধ দুটি বিষয় মাথায় রেখেই এই সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। যা বিশেষজ্ঞদের মতে বাস্তব সম্মত নয় ।

চউক সূত্র জানায়, অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বৃহত্তম প্রকল্প আউটার রিং রোড প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের উচ্চতা হবে ৩০ ফুট। দুই পাশে ঢাল এবং মাঝে মূল সড়কসহ প্রশস্ত হবে ৩শ` ফুট। চার লেনের মূল সড়কের প্রস্থ হবে ৮৪ ফুট। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭শ` কোটি টাকা।

গাছ কেটে রাস্তা তৈরির মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সমুদ্র বিজ্ঞান গবেষকরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও সমুদ্র বিজ্ঞান গবেষক মোহাম্মদ ওয়াহিদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, সমুদ্রের পাড়ে ইট, বালি ও সিমেন্ট মিশিয়ে তৈরি ব্লক রেখে কিংবা তার উপর সড়ক নির্মাণ করে সমুদ্রের ভাঙন রোধ করা যায় না।
 
কারণ, এসব বাঁধের নিচ থেকে কিছুদিন পরই বালি ও মাটি সরে যাবে। এক্ষেত্রে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট কিংবা ঝাউবনই দীর্ঘস্থায়ী সমাধান। গাছ কেটে বাঁধ নির্মাণ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। বরং এর মাধ্যমে ঝুঁকি বাড়বে। তিনি আরও বলেন, কোনো উপকূলীয় এলাকায় যদি ঝাউ বাগান তৈরি করা না যায় অথবা ম্যানগ্রোভ বন সৃষ্টি না হয়, সেক্ষেত্রে রাবার ড্যাম কার্যকর একটি সমাধান।

জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর-পতেঙ্গা সড়ক থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয় ২০০৩ সালে। বন্দর-পতেঙ্গা থেকে ঢাকাগামী গাড়ি প্রায় ৮০ ফুট প্রশস্ত এ সড়ক দিয়ে শহর না ঘুরেই পৌঁছে যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। কিন্তু এ সড়কটি এখন তেমন একটা ব্যবহার হয় না। শুধুমাত্র বন্দর থেকে বের হওয়া কিছু সংখ্যক লরি ট্রাক চলাচল করে সড়কটি দিয়ে।

এরপরও মাত্র ১২ বছরের ব্যবধানে ওই সড়ক ঘেঁষে নির্মাণ হচ্ছে আউটার রিং রোড প্রকল্প। এ সড়ক প্রকল্পের শুরুও বন্দর-পতেঙ্গা এলাকা থেকে। শেষ হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট এলাকায়।

স্থানীয়দের অভিযোগ, আউটার রিং রোড প্রকল্পের কারণে ভরাট করে ফেলতে হবে শতাধিক মৎস্য প্রকল্প। কাটা পড়বে লক্ষাধিক গাছ। নিঃস্ব হবে লক্ষাধিক জেলে পরিবার।

এরই মধ্যে সরকারি জমি লিজ নিয়ে মৎস্য খামার গড়ে তোলা অনেকেই গেছেন আদালতে। স্থানীয়দের ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলে তালিকা করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। সে অনুযায়ী পরিবারগুলোকে ব্যাংক হিসাব খুলতে বলে সংস্থাটি। কিন্তু প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণের কোনো অর্থ তাদের দেয়া হয়নি।

এদিকে, বুধবার থেকে চউক ক্ষতিপূরণ দেয়া শুরু করলেও মূলত বেড়িবাঁধের জবর দখলকারিরাই পাচ্ছে এসব ক্ষতি পূরণের টাকা।

সরেজমিন দেখা যায়, দক্ষিণ কাট্টলী ও আনন্দবাজার বেড়িবাঁধ এলাকায় বাঁধের উপরের গাছ কাটা চলছে। হালিশহর চৌধুরী পাড়া এলাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজের ব্লক তৈরি করেছে। চৌধুরী পাড়া থেকে পতেঙ্গার খেজুরতলা পর্যন্ত দীর্ঘ এলাকায় চলছে একযোগে নির্মাণ কাজ। সাগর থেকে মাটি তুলেই এ প্রকল্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও চট্টগ্রাম ইস্টডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সেকান্দর খান জাগো নিউজকে বলেন, অতি প্রয়োজনীয় প্রকল্পের বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে একের পর এক ফ্লাইওভারসহ নানা গুরুত্বহীন প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে।
 
অথচ, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার জন্য যে খাল নির্মাণের কথা তার কাজই শুরু করা যায়নি অর্থাভাবে। সাগরের পাড় ঘেঁষে একটি প্রশস্ত সড়ক এরই মধ্যে বন্দর-পতেঙ্গা থেকে শুরু হয়ে ফৌজদারহাট এলাকায় পৌঁছেছে। এই সড়ক ঘেঁষে আরও একটি সড়ক নির্মাণের যৌক্তিকতা থাকে না।

যদি খুব বেশি গাড়ির চাপ তৈরি হয়ে, সেক্ষেত্রে সড়কটির প্রশস্ততা বাড়ানো যেতে পারে। চট্টগ্রামে একের পর এক গুরুত্বহীন প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের নেপথ্যে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা তাও সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভাবা উচিত।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালাম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর এলাকা থেকে যে সড়কটি ফৌজদারহাট পর্যন্ত রয়েছে সেটি বন্দরের জন্য সংরক্ষিত। আউটার রিং রোডের উদ্দেশ্য অনেক মহৎ। ট্যানেলের মাধ্যমে ওই সড়ক ব্যবহার করে ঢাকা-কক্সবাজার যাতায়াত সহজ হবে। একই সঙ্গে বে-টার্মিনাল, গভীর সমুদ্রবন্দরসহ বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য অনেক বেশি সহায়ক হবে।

তিনি বলেন, আউটার রিং রোড প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে দুই পাশে ১শ` ফুট করে জায়গা থাকবে। তাতে যে বনায়ন হবে তা বর্তমানের বনায়ন থেকে কয়েকগুণ বেশি হবে।

আর অবৈধভাবে যে বসতি সরকারি জায়গায় গড়ে উঠেছে, তাদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়ার আইন নেই। তবুও জাইকার অর্থায়নের কারণে তাদের ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে। এ জায়গাগুলো জেলা প্রশাসনের। তাই তাদের আমরা জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দেব।

এদিকে, গত বছর ৩ ডিসেম্বর রিং রোড প্রকল্পের জন্য সাগর থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করে সিডিএ। অনুমোদন ছাড়া বালু উত্তোলনের অভিযোগ তুলে চউকের ১০টি ড্রেজার ও বাল্কহেডসহ ১৪ জনকে আটক করেছেন চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত।

এসময় তিন লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়। এ প্রকল্পের জন্য সিডিএ এর অতি আগ্রহ নিয়ে জনমনে নানা সন্দেহও দানা বাঁধতে শুরু করেছে।

জীবন মুছা/এমজেড/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।