গণপরিবহনে ই-টিকিটিং

কমেনি ভোগান্তি, বেড়েছে বিড়ম্বনা

মফিজুল সাদিক
মফিজুল সাদিক মফিজুল সাদিক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৩:৫৬ পিএম, ২৮ এপ্রিল ২০২৩
ই-টিকিট দিচ্ছেন কাউন্টারম্যান/বিপ্লব দিক্ষীৎ

বিমানবন্দর থেকে রাইদা পরিবহনের একটি বাসে উঠেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী নাজমুল। গন্তব্য বাড্ডা। কন্ডাক্টর ভাড়া রাখলেন ৩০ টাকা। টিকিট কোথায় জানতে চাইলে বলেন দিচ্ছি। বলেই হাউজ বিল্ডিং থেকে বাড্ডার টিকিট ধরিয়ে দিলেন। বিমানবন্দর থেকে উঠে হাউজ বিল্ডিংয়ের ভাড়া দেবো কেন জানতে চাইলে ই-টিকিটিং মেশিনে বিমানবন্দর নেই বলে জানান। পরে চারপাশ থেকে কয়েকজন যাত্রী একসঙ্গে প্রতিবাদ করলে বিমানবন্দর সিলেক্ট করে ২৫ টাকা ভাড়া রাখেন কন্ডাক্টর।

একই বাসের অর্ধেক যাত্রী এ ধরনের হয়রানির মুখোমুখি হন। কেউ না বুঝে টিকিট না নিয়ে যা ভাড়া চাওয়া হয়েছে সেটাই দিয়েছেন। টিকিট না চাইলে কাউকে যেচে টিকিট দিতে দেখা যায়নি কন্ডাক্টরকে। কাউকে মেশিন নষ্ট, মেশিনে ভাড়া বেশি দেখায়, সব গন্তব্য মেশিনে নেই ইত্যাদি ইত্যাদি বলে একেকজনকে একেকরকমভাবে বুঝ দিতে দেখা যায়। এভাবে ই-টিকিংয়ের নামে যাত্রীদের হয়রানি করে পকেট কাটা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভোগান্তি তো কমেইনি, উল্টো টিকিট, ভাংতি নিয়ে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়।

আরও পড়ুন>> ১২ পয়েন্ট কাটা পড়লেই বাতিল ড্রাইভিং লাইসেন্স

বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধ ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করলেও যাত্রীরা এখনো এই সেবা পুরোপুরি পাচ্ছে না। যাত্রীদের ই-টিকিট না দিয়ে আদায় করা হচ্ছে বাড়তি ভাড়া।

jagonews24

আলিফ পরিবহনের কন্ডাক্টর সুমন হেসেন (২৬)। হাতে ই-টিকিটিংয়ের মেশিন নেই। অথচ বাসটিতে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ই-টিকিট কেন দেওয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে কন্ডাক্টর সুমন হেসেন বলেন, ভাই মেশিনে ডিস্টার্ব।

তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন, ই-টিকিটে মহাখালী থেকে তালতলার ভাড়া ১০ টাকা, অথচ আমার কাছ থেকে ১৫ টাকা রাখা হয়েছে। অধিকাংশ সময় টিকিট দেয় না। বাস কন্ডাক্টর বলেন, মেশিন নষ্ট এমবি শেষ।

সড়কে শৃঙ্খলা ও অতিরিক্ত ভাড়া বন্ধে নগরীতে শুরু হয়েছে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা।

আরও পড়ুন>> গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার ৩৬ শতাংশ নারী: সমীক্ষা

অনেক সাধারণ যাত্রীর হাতেও স্টুডেন্ট টিকিট ধরিয়ে দেওয়া হয়। মিরপুর তালতলার বাসিন্দা মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম বলেন, তালতলা থেকে মিরপুর লিংকে উঠি। কিন্তু সাধারণ ভাড়া দিলেও স্টুডেন্ট টিকিট হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়, এটা এক ধরনের প্রতারণা। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের কল্যাণে কিছু শুরু করলে কিছু লোক ওত পেতে বসে থাকে কীভাবে অকল্যাণ করা যায়।’

jagonews24

সরেজমিনে দেখা যায়, অনেকবার চেয়ে বেশি দূরত্বের পথে ই-টিকিট পাওয়া যায়। কিন্তু কম দূরত্বে ১০ টাকা বা ১৫ টাকার ভাড়ার পথে টিকিট দেওয়া হয় না।

আগারগাঁও বাংলাদেশ বেতার থেকে গুলশান লিংক রোডে নিয়মিত বৈশাখী পরিবহনে যাতায়াত করেন আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘১০ থেকে ১৫ টাকার ভাড়া হলে কখনই টিকিট দেওয়া হয় না। কিন্তু ২০ থেকে ৩৫ টাকা দূরত্বের পথ হলে তখন দেওয়া হয়। তারপরও অনেক সময় চেয়ে নিতে হয়। এখনো ই-টিকিটিং সুবিধা পুরোপুরি পাচ্ছি না।’

আরও পড়ুন>> ‘ঢাকার সব বাসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে’

হাসনাত মঈনা নামে মিরপুরের এক যাত্রী বলেন, ই-টিকিটে খুচরা টাকার অংকে ভাড়া দিতে গেলে একটু ঝামেলা হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুচরা টাকা ফেরত দিচ্ছে না টিকিট চেকাররা। তারা খুচরা টাকা না থাকার কথা বলছে। ফলে দুই থেকে পাঁচ টাকা বাড়তি দিতে হয়।

jagonews24

এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ পেয়ে আসছি। সেগুলো দূর করার জন্য ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। এই ধারাবাহিকতায় ই-টিকিটিং চালু হয়েছে।

ই-টিকিটিং চালু হলে ঢাকা শহরের মধ্যে চলাচলকারী বাসগুলোর যে অসম প্রতিযোগিতা থাকতো সেগুলো বন্ধ হবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ই-টিকিটিং চালু হলে অসম প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে। কারণ চালকদের বেতন নির্ধারণ করা দেওয়া থাকবে। ই-টিকিটিংয়ের জন্য বর্তমান থেকে আরও অনেক বেশি টাকা নির্ধারণ করে তাদের দেওয়া হচ্ছে।’

আরও পড়ুন>> ঢাকায় গণপরিবহনে দিনে ১৮২ কোটি টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায়

ই-টিকিটিং চালু হলেও বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এমনকি সড়কে বাস কোম্পানির অসম প্রতিযোগিতা চলমান। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, আমি মিটিংয়ে আছি বলে ফোন কেটে দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান।

jagonews24

যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ই-টিকিটের মাধ্যমে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়ছেন। শুরুতেই ই-টিকিট নিয়ে যাত্রী, বাস মালিক-শ্রমিকের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ই-টিকিট চালুর পর বিভিন্ন রুটে মালিকেরা বাসের সংখ্যা কমিয়ে দেন। দূরত্বের ব্যবধানে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করেন নগরীর যাত্রী সাধারণ।

আরও পড়ুন: ই-টিকিটিং চালুর পর বাস কমিয়ে দিয়েছেন মালিকরা

যেমন— রামপুরা থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত ভাড়া ছিল ২০ টাকা, ই-টিকিটে ভাড়া নিচ্ছে ২৫ টাকা। অথচ ৮ কিলোমিটার এই পথে ২০ টাকা ভাড়া আদায় হওয়ার কথা। খিলক্ষেত থেকে মিরপুর-২ পর্যন্ত আগে ১৫ টাকা ভাড়া আদায় হলেও ই-টিকিটে ২০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। ই-টিকিটে বর্তমানে নৈরাজ্য চলছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, প্রথমে ই-টিকিটিং নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলাম। ভেবেছিলাম যাত্রীদের সমস্যা সমাধান হবে। সরকারের নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য ভাড়া বাড়তিই রাখা হচ্ছে। বাস মালিকদের স্বার্থেই ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এখানে যাত্রীদের কোনো লাভ নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বলছি পাঞ্চিং পদ্ধতিতে ভাড়া আদায় করতে হবে। এরই মধ্যে প্রেস কনফারেন্স করেও অনেক কিছু বলেছি। আমরা কিছু ফাইন্ডিং পেয়েছি। পরিবহনগুলো যাত্রীদের ঠকাচ্ছে।’

এমওএস/এএসএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।