খসড়া উপাত্ত সুরক্ষা আইন: পর্যালোচনায় যা বলছে টিআইবি

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:৫৬ পিএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

‘খসড়া উপাত্ত সুরক্ষা আইন-২০২৩’ একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। এটি পাসে তড়িঘড়ি না করার আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টায় রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ দাবি জানান। এদিন ‘খসড়া উপাত্ত সুরক্ষা আইন’ নিয়ে পর্যালোচনা উপস্থাপন করা হয়। টিআইবির ডেটা প্রটেকশন অফিসার ড. তারিকুল ইসলাম এটি উপস্থাপন করেন।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সাইবার সিকিউরিটি আইনের জন্য যেভাবে তড়িঘড়ি করা হয়েছে, তেমনি খসড়া উপাত্ত সুরক্ষা আইন পাসে যেন তড়িঘড়ি না করা হয়। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আইন। সরকার এরই মধ্যে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যে, অংশীজনের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। সেই সুযোগটা যেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। চূড়ান্ত খসড়া সংসদে উপস্থাপনের আগে সবার সঙ্গে যেন আলোচনা করা হয়।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সংবিধানে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার যে বিধান আছে, সেটি যদি রেফারেন্স হিসেবে থাকে তাহলে আইনটি আরও বেশি মানবাধিকারকেন্দ্রিক হবে।

এদিকে আইনের বিভিন্ন ধারার সমালোচনা করে পর্যালোচনায় সংস্থাটি বলছে, খসড়া আইনের উদ্দেশ্য ক্লজে মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি তুলে ধরার বিধান অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছিল টিআইবি। তবে সুপারিশ আংশিকভাবে গৃহীত হয়েছে।

‘উপাত্ত সুরক্ষা আইন ২০২৩’ এই নামের পরিবর্তে ‘ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষা আইন ২০২৩’ করার পরামর্শ দেয় টিআইবি।

jagonews24

ড. তারিকুল ইসলাম বলেন, এর আগে ব্যক্তিগত উপাত্তের সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছিলাম। আইনটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষার আইন হলেও এতে এ বিষয়ে অর্থবহ সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, টিআইবি বেনামি এবং ছদ্মনামযুক্ত উপাত্তের মধ্যে পার্থক্য করার পরামর্শ দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক চর্চা অনুযায়ী আইনটি পাসের পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য অন্তত দুই বছর গ্রেস পিরিয়ডের সুপারিশ আগের খসড়ায় থাকলেও নতুনটিতে নেই। এছাড়া আইনের খসড়াতে ‘ডেটা সাবজেক্ট’র একটি পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছিল টিআইবি, কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি।

সংস্থাটি জানায়, উপাত্ত সুরক্ষা আইন কেবল প্রাকৃতিক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কিন্তু খসড়া আইনে তার প্রতিফলন নেই। আবার সংজ্ঞা ধারা পুনর্গঠনের জন্য টিআইবির সুপারিশ যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি।

টিআইবির পর্যালোচনায় আরও বলা হয়, আন্তর্জাতিক চর্চা অনুযায়ী ‘প্রোফাইলিং’ পুনরায় সংজ্ঞায়িত করার বিষয়ে সংস্থার পরামর্শ ছিল এবং তার প্রয়োজন এখনো বিদ্যমান এবং আলোচ্য সংজ্ঞাটি অপূর্ণাঙ্গ। এছাড়া একটি স্বাধীন উপাত্ত সুরক্ষা প্রতিষ্ঠা সংস্থা সম্পর্কিত টিআইবির পরামর্শ যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয়নি। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে সংস্থাটি তাদের আগের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে।

পর্যালোচনায় বলা হয়, ওইসিডি গোপনীয়তা নির্দেশিকাগুলোর আলোকে উপাত্ত সুরক্ষার নীতিমালা প্রণয়ন সংক্রান্ত টিআইবির সুপারিশ অনুসৃত হয়নি। সংবেদনশীল ব্যক্তিগত উপাত্ত প্রসেসিংয়ের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা স্থাপনের ক্ষেত্রে টিআইবির পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তার, আইনগত কার্যধারার মতো প্রয়োজন ছাড়া সংবেদনশীল ব্যক্তিগত উপাত্তের প্রসেসিং নিষিদ্ধের সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

টিআইবির পর্যালোচনায় আরও বলা হয়, অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের সম্মতির বয়স সামঞ্জস্য করার জন্য সংস্থাটির সুপারিশ বিবেচনা করা হয়নি। ১৮ এর পরিবর্তে ১৩-১৬ এই বয়স ক্রমের পরামর্শ দিয়েছিল সংস্থাটি। দাবিটি আবারও পুনর্ব্যক্ত করে সংস্থাটি।

উপাত্ত সংশোধন এবং প্রত্যাখ্যানের আগে উপাত্তধারীর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে টিআইবির প্রস্তাব স্বীকার করা হয়নি বলে পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়।

সংস্থাটির পর্যালোচনায় আরও বলা হয়, বিদেশি নাগরিকদের উপাত্ত সংরক্ষণের অধিকারের বিষয়ে টিআইবির সুপারিশ যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হয়নি। বিদেশি নাগরিকদের এ সংক্রান্ত বিধান অপূর্ণাঙ্গ, তাই এক্ষেত্রে বিস্তারিত বিধান আইনে থাকা জরুরি বলে মনে করে সংস্থাটি।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দ্বারা গোপনীয়তা এবং ব্যক্তিগত উপাত্তের সুরক্ষা সীমাবদ্ধ না করার জন্য টিআইবির পরামর্শ বিবেচনা করা হয়নি বলে দাবি করে সংস্থাটি।

পর্যালোচনায় বলা হয়, অতিমাত্রায় বিধি দ্বারা আইন প্রণয়নের প্রবণতা কমানোর টিআইবির সুপারিশগুলো আমলে নেওয়া হয়নি। সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে পর্যায়ক্রমে উপাত্ত নিয়ন্ত্রকদের উপাত্ত সুরক্ষার দায় বিষয়ে পরামর্শ বিবেচনা করা হয়নি।

টিআইবির পর্যালোচনায় আরও জানানো হয়, ক্ষুদ্র ব্যবসার নিয়ন্ত্রকের উপাত্ত সুরক্ষার দায়িত্ব পালন অসম্ভব। তাই তা বড় প্রতিষ্ঠানের প্রতি আরোপ করা এবং ক্রমান্বয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসার দিকে প্রসারিত করা সংক্রান্ত সংস্থাটির সুপারিশ বিবেচনা করা হয়নি। উপাত্ত সুরক্ষার মান রক্ষার সকল পদ্ধতি আইনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করার দাবি থাকলেও এবং উপাত্ত সুরক্ষা নীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত অপ্রয়োজনীয় ধারাগুলো অপসারণের টিআইবির সুপারিশ বিবেচনা করা হয়নি।

টিআইবির পর্যালোচনায় আরও জানানো হয়, উপাত্তের রেকর্ড সংরক্ষণে সবধরনের উপাত্ত নিয়ন্ত্রকের দায়যুক্ত বিধান বাতিল করা সংক্রান্ত সংস্থাটির পরামর্শ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। উপাত্ত বিচ্যুতির নোটিশ প্রদান সংক্রান্ত সুপারিশ আংশিকভাবে গৃহীত হয়েছে।

এছাড়া নিরীক্ষকের যোগ্যতা নির্ধারণের বিষয়ে উপাত্ত সুরক্ষা আইন এবং প্রবিধানে দক্ষতা যুক্ত করার সংক্রান্ত সংস্থাটির প্রস্তাবের প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়নি বলে জানায় টিআইবি।

টিআইবির পর্যালোচনায় আরও জানানো হয়, উপাত্ত সুরক্ষা বিষয়ে সরকারি সংস্থার অতি দায়মুক্তির বিধান বাতিলের পরামর্শ নতুন খসড়ায় প্রতিফলিত হয়নি। এছাড়া নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করে এমন বিধান সরানোর জন্য সংস্থাটির পরামর্শকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

এতে আরও বলা হয়, উপাত্তের স্থানীয়করণ সংক্রান্ত ধারাগুলো বাতিলে আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করা হয়েছে এবং এটি বাংলাদেশে আন্তঃসীমান্ত উপাত্ত স্থানান্তরকে সহজতর করবে।

পর্যালোচনায় আরও বলা হয়, বাধ্যতামূলকভাবে, সবশ্রেণির উপাত্ত নিয়ন্ত্রকের নিবন্ধন বাতিল সংক্রান্ত সুপারিশ, আইনি পদক্ষেপের সম্মুখীন নিয়ন্ত্রকদের জন্য আত্মরক্ষার অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা, উপাত্ত সুরক্ষা বোর্ডের মহাপরিচালক কর্তৃক উপাত্ত নিয়ন্ত্রকের উপাত্ত বিচ্যুতির শাস্তির বিধান (আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে) অপসারণ করা, বর্তমান খসড়ায় আপিল কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে আমাদের পরামর্শ আংশিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু ৯০ দিনের বর্ধিত আপিল নিষ্পত্তির বিধান, এই আইনের উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করতে পারে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে টিআইবির সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়নি।

তবে টিআইবি জানায়, দেওয়ানি প্রতিকার এবং প্রশাসনিক জরিমানা দিয়ে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রয়োগের বিধান বাতিলের সংস্থাটির সুপারিশ গৃহীত হয়েছে। সংস্থাটি আশা করছে নতুন এই আইন সংসদে পাস হওয়ার আগে সময় নিয়ে পর্যালোচনা করে যেন পাঠানো হয়।

নাহিদ হাসান/জেডএইচ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।