মেয়র-চেয়ারম্যানের ওটিপি ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের জন্মসনদ

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:৪৯ পিএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও টেলিগ্রাম অ্যাপসে ‘এনআইডি হেল্প ডেস্ক গ্রুপ’, ‘এনআইডি অনলাইন সার্ভিস বিডি লিমিটেড’ নামের বিভিন্ন গ্রুপে অনলাইনে জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি, জন্মনিবন্ধন সংশোধন ও এনআইডি সার্ভার কপি দেওয়ার পোস্ট দেওয়া হয়। সেসব পোস্ট দেখে গ্রুপের অ্যাডমিনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন রোহিঙ্গা নাগরিকরা। যোগাযোগের পর রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করে দেন ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটররা। যাদের কাছে ইউপি চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রদের জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়ার জন্য সার্ভারের আইডি-পাসওয়ার্ড থাকতো। এই সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটররা রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়েছেন।

এমন অভিযোগের প্রমাণও মিলেছে। তাদেরই একজন মো. আবদুল্লাহ। মায়ের নাম তফুরা বেগম, বাবার নাম আবদুল কাদের। জন্মস্থান কক্সবাজার, আর স্থায়ী ঠিকানায় দিনাজপুরের বিরল পৌরসভ। জন্ম তারিখ দেখানো হয় ১৯৯০ সালের ১ জানুয়ারি। জন্মনিবন্ধন সনদটি ইস্যুর তারিখ ছিল গত ১২ ফেব্রুয়ারি। এই নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে একজন রোহিঙ্গা নাগরিকের ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ দেন বিরল পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুর রশিদ। কিন্তু এই নামে ওই এলাকায় কোনো বাসিন্দার হদিস মেলেনি। এভাবে কম্পিউটার অপারেটর আব্দুর রশিদ একাই দেড় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নাগরিকের ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করেছেন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে।

আরও পড়ুন
রোহিঙ্গাদের ভূয়া জন্মনিবন্ধন তৈরি চক্রের ৩ সদস্য গ্রেফতার
নিজস্ব সার্ভারে জন্মনিবন্ধন চালু দক্ষিণ সিটির, জানে না মন্ত্রণালয় 

৫ থেকে ৩০ হাজার টাকয় মেলে রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন সনদ

টাকার বিনিময়ে জাল-জালিয়াতির করে ভুয়া জন্মনিবন্ধন সম্পন্নের পর সনদ সরবরাহ করেছে দেশের একাধিক ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার বেশকিছু কম্পিউটার অপারেটররা। জাগো নিউজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন তথ্য। দেশের একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান ও পৌরসভা মেয়রের আইডি-পাসওয়ার্ড নিয়ে অসাধু কম্পিউটার অপারেটররা গত ছয় মাসে কয়েক শ’ রোহিঙ্গা নাগরিকসহ অন্তত পাঁচ হাজার ভুয়া জন্মনিবন্ধন তৈরির পর তা সরবরাহ করেছেন। একজন রোহিঙ্গা নাগরিককে জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে খরচ করতে হচ্ছে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এসব টাকা আবার ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ে।

জন্মনিবন্ধনের পর পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশে পারি জমাচ্ছেন রোহিঙ্গারা

অনুসন্ধানে আরও উঠে এসেছে, মিয়ানমারের নাগরিক হয়েও রোহিঙ্গারা বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে। আর পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য প্রথম ধাপ হিসেবে রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন সনদ দিচ্ছে দালালচক্র। এ কাজে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন অফিসের অসাধু কম্পিউটার অপারেটররা সহয়তা করছেন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে। এসব দালাল ও অসাধু চক্রের সহায়তায় সহজেই জন্মনিবন্ধন সনদ পেয়ে যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। পরে জন্মনিবন্ধন দিয়ে রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক সেজে পারি জমাচ্ছেন বিদেশে। এ দেশের পাসপোর্ট নিয়ে অন্য কোনো দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অথবা অপরাধে যুক্ত হলে সেই দায়ভার বাংলাদেশের ওপর পড়ছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশি একজন নাগরিকের জন্মনিবন্ধনের জন্য যাদের জন্ম ২০০১ সালের ১ জানুয়ারির পর তাদের ক্ষেত্রে পিতা-মাতার অনলাইন জন্মনিবন্ধন সনদসহ জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক। এর আগে যাদের জন্ম অর্থাৎ ২০০১ সালের আগে যাদের জন্ম তাদের ক্ষেত্রে পিতা-মাতার জন্মনিবন্ধন সনদের প্রয়োজন হয় না। এই সুযোগটিই নিচ্ছেন রোহিঙ্গা নাগরিকেরা। তাদের ২০০১ সালের আগে জন্ম তারিখ দেখিয়ে ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ দিচ্ছে দালালচক্র।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গারা কেবল বাংলাদেশের জন্মনিবন্ধন সনদ নয়, পাসপোর্টও সংগ্রহ করছেন। খবরটি খুবই উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয় এবং ৩৪টি অস্থায়ী ক্যাম্পে তাদের বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়। শুরুতে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরনার্থীর সংখ্যা ছিল নয় লাখ। এখন বংশবৃদ্ধির পর তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ লাখে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতাও অব্যাহত আছে। কিন্তু মিয়ানমার এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি। রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত বছরের ১৬ জানুয়ারি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহর ভাই শাহ আলিকে গ্রেফতার করে। তার কাছ থেকে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) উদ্ধার করা হয়। এরপরই অবৈধভাবে এনআইডি প্রদানের বিষয়টি সামনে আসে। গণমাধ্যমে লেখালেখি শুরু হয়, কর্তৃপক্ষও নড়েচড়ে বসে। ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে জানা যায়, শাহ আলি এনআইডি কার্ডটি সংগ্রহ করেছেন ২০১৮ সালে। তখন তিনি চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার অধীন একটি স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করেন। তদন্তে উঠে আসে, এ নামে ওই এলাকায় কেউ থাকেন না। কার্ডটি পুরোপুরি ভুয়া, কিন্তু প্রদান করেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

আরও পড়ুন
টাকা দিলে আগে মেলে জন্মনিবন্ধন সনদ
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনে ভুল সংশোধনে নতুন নির্দেশনা

নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য টিকা দেওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, বিদেশ যাত্রায়, চাকরির নিয়োগে, বিশেষ করে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনসহ পাসপোর্ট নিবন্ধনসহ ১৯টি ক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়ে জন্মসনদের। কেউ মারা গেলে মৃত্যু নিবন্ধনের জন্যও লাগে জন্মসনদ। নইলে উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা যায় না। সবমিলিয়ে জন্মনিবন্ধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল নথি।

বাংলাদেশের জন্মনিবন্ধনের তথ্য যেসব সার্ভারে থাকে সেটি হ্যাক করে বিভিন্ন মাত্রায় জাল-জালিয়াতির খবর হয়েছে গণমাধ্যমে। তবে এই জালিয়াতি গত ছয় মাস ধরে নতুন মাত্রায় হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। কারণ মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকদের অনেকে বাংলাদেশিদের সহযোগিতায় পাচ্ছেন ভুয়া জন্মসনদ। মাত্র ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় রোহিঙ্গা নাগরিকরা জন্মসনদ নিয়ে বাংলাদেশি পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরি করছেন।

পৌরসভা-ইউপির কম্পিউটার অপারেটররা যেভাবে রোহিঙ্গাদের জন্মসনদ দিচ্ছেন

পৌরসভার মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন সচিবের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহারে সংশ্লিষ্ট অফিসের কম্পিউটার অপারেটর, ফ্রিল্যান্সার ও অন্যান্য সহযোগীদের সহায়তায় এই জালিয়াতি হচ্ছে বলে তথ্য মিলেছে। ভুয়া জন্মসনদ ব্যবহারে বাংলাদেশে জমি ক্রয়, চাকরি ও বিদেশ গমনের তথ্যও জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুর জেলার বিরল পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুর রশিদ। একই জেলার বিরলের ১০ নম্বর রাণীপুকুর ইউনিয়নের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্র। নিয়মানুযায়ী সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ও পৌরসভার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জন্মনিবন্ধন সনদের কার্যক্রম চলমান ছিল। যেটির কাজ করে আসছিলেন এই দুই অপারেটর।

মাস ছয়েক আগে একটি চক্রের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে সংঘবদ্ধ সাইবার অপরাধী চক্রের মাধ্যমে তারা হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম ও ফেসবুক গ্রুপ যুক্ত হন। আরও আগে এসব গ্রুপ জন্মসনদ, এনআইডি ও পাসপোর্টসহ বিভিন্ন জাল-জালিয়াতির বিষয়ে চক্রের মধ্যে কথোপকথন ও যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। চক্রের প্রলোভনে পড়ে চাহিদা অনুযায়ী কম্পিউটার অপারেটর আব্দুর রশিদ ও সোহেল চন্দ্র টাকার বিনিময়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া জন্মনিবন্ধন সম্পন্নের পর সনদ সরবরাহ করে আসছিলেন।

জন্মসনদ প্রস্তুতের পর টাকা নেওয়া হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং চ্যানেলে

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার ক্রাইমের কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু এই ইউপি ও পৌরসভায় নয়, চাহিদা ও গুরুত্ব অনুযায়ী টাকার বিনিময়ে দেশের আরও বেশ কয়েকটি জেলার ইউপি ও পৌরসভা থেকে কম্পিউটার অপারেটরদের মাধ্যমে জন্মনিবন্ধনের পর সনদ পেয়েছেন রোহিঙ্গা নাগরিকরা। এজন্য লেনদেন হয়েছে বিকাশ, রকেট ও নগদসহ অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং চ্যানেল।

তারা বলছেন, এসব জালিয়াতিতে ইউপি চেয়ারম্যান, সচিব, পৌরসভা মেয়র ও নির্বাহী কর্মকর্তারা দায় এড়াতে পারেন না। কারণ জন্মনিবন্ধনের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল নথির বিষয়টি দেখভাল, অনলাইনে নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় পিনকোড ও পাসওয়ার্ড থাকে তাদের কাছে। তাদের অজ্ঞাতসারে এ ধরনের ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়।

‘মেয়র ব্যস্ত মানুষ, স্বাক্ষর নকল হতে পারে’

বিরল পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুর রশিদ একাই দেড় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নাগরিকের ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করেছেন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে। এ বিষয়ে জানতে দিনাজপুর বিরল পৌরসভার কাউন্সিলর চন্দ্র কান্ত রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘মেয়র অনেক ব্যস্ত মানুষ। হয়তো তার স্বাক্ষর নকল করে রোহিঙ্গাদের জন্মসনদ দিয়েছেন।’

কড়া মনিটরিংয়ের আওতায় কম্পিউটার অপারেটররা

জানতে চাইলে বিরল উপজেলা নির্বাহী অফিসার বহ্নি শিখা আশা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরির অভিযোগে আমার উপজেলা থেকে দুজন গ্রেফতারের পর বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কড়া মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে এমন কাজে কেউ জড়িত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

আরও পড়ুন
সার্ভার হ্যাক করে জন্মনিবন্ধন করতেন তারা 
চসিকের সার্ভার হ্যাক করে ৫৪৭ জন্মসনদ ইস্যু, আটক চার 

১০ নম্বর রাণীপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্র রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আল্লামা আজাদ ইকবাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিবিকে বলেছি আপনারা আইনের লোক, আইন অনুযায়ী কাজ করেন। এরপর ডিবি আমার পরিষদের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্রকে গ্রেফতার করে।’

জন্মনিবন্ধন সনদ প্রস্তুতের সময় আপনার মোবাইলে যাওয়া ওটিপি কোড আপনি ছাড়া জানার কথা নয়। আপনি জেনেই তাহলে রোহিঙ্গাদের ভুয়া জন্মনিবন্ধন দিয়েছেন। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগে থেকে যদি জানা যেত রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন তাহলে আগে থেকেই নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ করতাম। আর বেশি প্রশ্ন করিয়েন না আমাকে। এখানে আমার কিছু করার নেই।’

যা বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এডিসি (অর্গানাইজড অ্যান্ড ওয়েব বেইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম) মো. সাইফুর রহমান আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনলাইনে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড (সাইবার ক্রাইম) নজরদারি করার সময় দেখা যায়, NID HELP DESK GROUP এবং NID online service (এনআইডি অনলাইন সেবা) নামক ফেসবুক গ্রুপে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা কললিস্ট, এসএমএস লিস্ট, নম্বর টু এনআইডি, এনআইডি টু নম্বর, লাস্ট কল লোকেশন, রেডিও লোকেশন, কোন সিম নম্বর থেকে তার রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত তথ্যাদি, নগদ/বিকাশ, এনআইডি সার্ভার কপি, এনআইডি (সাইন কপি), সার্টিফিকেট (সাইন কপি), বিভিন্ন নাগরিক তথ্যাদি, জন্মনিবন্ধন (সাইন কপি), জন্মনিবন্ধন সংশোধনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বে-আইনিভাবে প্রবেশ করে কম্পিউটার নেটওয়ার্কের তথ্য সংগ্রহ করে, তার অনুলিপি টাকার বিনিময়ে সরবরাহ করার পোস্ট করছে। এছাড়া এসংক্রান্ত হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম গ্রুপের সন্ধান মিলেছে।

সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্যের ভিত্তিতে মামলার পর তদন্ত শুরু করে ডিএমপি’র সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ। এরপর তথ্য-প্রমাণের তিত্তিতে গেলো সপ্তাহে বাগেরহাট, নারায়ণগঞ্জ এবং দিনাজপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ভুয়া জন্মনিবন্ধন এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্মনিবন্ধনকারী চক্রের ৫ জন সদস্য গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতাররা হলেন- দিনাজপুরের বিরল পৌরসভার কম্পিউটার অপারেটর আব্দুর রশিদ, একই জেলার বিরলের ১০ নম্বর রাণীপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের কম্পিউটার অপারেটর সোহেল চন্দ্র, তাদের সহযোগী মোস্তাফিজুর রহমান। আর রশিদ ও সোহেল চন্দ্রকে ভুয়া জন্মসনদ পেতে আগ্রহীদের সরবরাহকারী শহিদুল ইসলাম মুন্না ও রাসেল খান। এ দুজন বাগেরহাট এবং নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা।

প্রতারক চক্রে যেভাবে জড়ালেন তারা

দিনাজপুরের বিরলের শহিদুল ইসলাম মুন্না ও বাগেরহটের রাসেল খান পড়াশোনার পাশাপাশি এই জালিয়াতি চক্রে জড়িত। আর নারায়ণগঞ্জের রাসেল খান স্থানীয় একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন। অনলাইনে যোগাযোগ থেকে মোস্তাফিজুর রহমানের মাধ্যমে গ্রেফতার আব্দুর রশিদ ও সোহেল চন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় হয় বাকি দুজনের। হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম গ্রুপে তাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি, বিশেষত রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরিতে ব্যাপক লাভ দেখে তারা এ কাজে জড়িয়ে পড়েন। যেহেতু রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি নাগরিক নন এবং স্থানীয় নাগরিক হিসেবে পরিচয়ের অভাবে বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তিতে তাদের অ্যাক্সেস নেই, সেহেতু বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ভুয়া নিবন্ধন তাদের জন্য সুবিধাজনক হওয়ায় বহু রোহিঙ্গা সরকারি দপ্তরের কম্পিউটার অপারেটরদের মাধ্যমে ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করেছেন। এ কাজে তারা সবাই আনুপাতিকহারে লাভবান হতেন। শুধু বিরল নয়, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাসহ দেশের অন্যান্য পৌরসভা ও ইউনিয়নে তাদের লোকজন রয়েছেন, যারা ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে হাজার হাজার মানুষের ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করেছেন।

দাগি-কুখ্যাত আসামিরা পরিচয় গোপন করে জন্মসনদ করছেন

ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভুয়া জন্মনিবন্ধন ব্যবহার করে অনেক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অবৈধভাবে দেশের নাগরিক হয়ে যাচ্ছে, অনেক অপরাধী অপরাধ করে নিজ এলাকার বাইরে আরেকটি জন্মনিবন্ধন করে তাদের পরিচয় গোপন করছেন। নতুন করে অপরাধ শুরু করছেন তারা। অনেক ভুয়া পাসপোর্ট তৈরিতে এই জন্মনিবন্ধন সনদ ব্যবহার করছেন যেন ব্যাংক লোন ও অনলাইন অপরাধে পুলিশকে ফাঁকি দিতে পারেন। এসব সনদ দিয়ে অনেক দাগি ও কুখ্যাত খুনি, ডাকাত এবং রাষ্ট্ররিরোধী অপরাধীরা নিজেদের পরিচয় গোপন করে ফেলতে সক্ষম হন অথবা নতুন করে নতুন পরিচয়ে আবার অপরাধ শুরু করছেন। বিষয়টি উদ্বেগের।’

রোহিঙ্গাদের জন্মসনদে বর্তমান ঠিকানা দেওয়া হচ্ছে কক্সবাজার

এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ, ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র এমনকি পাসপোর্টও বানাচ্ছেন। এতে সহযোগিতা করছেন দেশের বিভিন্ন এলাকার মেয়র, নির্বাহী কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-সচিবের কম্পিউটার অপারেটর। এতে করে রোহিঙ্গারা খুব সহজেই জন্মদনিবন্ধন সনদ পেয়ে যাচ্ছেন। জন্ম নিবন্ধন করার সময় স্থায়ী ঠিকানা দেয় যে এলাকা থেকে নিবন্ধন করা হচ্ছে আর বর্তমান ঠিকানা দেয় কক্সবাজার। বর্তমান ঠিকানা কক্সবাজার দিয়ে দেশের একাধিক মেয়র ও ইউনিয়ন পরিষদের কম্পিউটার অপারেটররা শত শত জন্মনিবন্ধন করে দিচ্ছেন রোহিঙ্গাদের। জন্মনিবন্ধনের পরে সহজেই রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট বানাচ্ছেন। পাসপোর্ট বানিয়ে কেউ বিদেশে চলে যাচ্ছেন, আবার জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিকের ঠিকানা দিয়ে দেশের মধ্যে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন।’

আরও পড়ুন
ভুয়া ঠিকানায় পাসপোর্ট করতে গিয়ে রোহিঙ্গাসহ গ্রেফতার ৭
হবিগঞ্জে ভুয়া পরিচয়ে পাসপোর্ট করতে এসে রোহিঙ্গা তরুণী আটক

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ দিন দিন ব্যাপকভাবে ডিজিটালাইজড হচ্ছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রতিনিয়ত তথ্য-উপাত্ত এবং অর্থ লেনদেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচপত্র প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক হচ্ছে। তাই ব্যক্তিগত তথ্য, উপাত্ত এবং অর্থের লেনদেনে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা এবং সুরুক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সাধারণ মানুষের ডিজিটাল লিটারেসি এবং সাইবার সিকিউরিটি অ্যাওয়ারনেস গুরুত্বপূর্ণ।’

হারুন অর রশীদ আরও বলেন, ‘সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো ব্যবহারকারী সবাইকে তাদের আইডি-পাসওয়ার্ড অধস্তনদের কাছে দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। শক্তিশালী আইটি সলিউশন টিম এবং Equipment ব্যবহার করতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র/জন্মনিবন্ধন সার্ভারসহ গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোতে দুর্বলতা থাকলে দ্রুত সমাধানে ব্যবস্থ নেওয়া জরুরি। যথাযথ কর্তৃপক্ষ ছাড়া ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষের মনিটরিং জোরদার করা এবং এমন কোনো চক্রের সন্ধান পেলে দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবগত করতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা কেবল বাংলাদেশের এনআইডি কার্ড নয়, পাসপোর্টও সংগ্রহ করছেন। খবরটি খুবই উদ্বেগজনক। এসব কাজে সরকারি দপ্তরের সব কম্পিউটার অপারেটরকে নজরদারির মধ্যে আনা দরকার। অন্যথায় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জন্মনিবন্ধন সনদ, এনআইডি ও পাসপোর্ট পেলে বিষয়টি দেশের ভাবমূর্তির জন্য ভালো হবে না।’

তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক নন, তারা মিয়ানমারের নাগরিক, এ দেশে শরনার্থী, বিদেশি তারা। তারা যদি এ দেশের পাসপোর্ট নিয়ে অন্য কোনো দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অথবা অপরাধে যুক্ত হন, তাহলে এর দায়ভার বাংলাদেশের ওপর পড়বে। সেক্ষেত্রে দেশের ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুণ্ন হবে ব্যাপকভাবে।

টিটি/ইএ/এমএইচআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।