চট্টগ্রাম-১০

দুই প্রবীণের সঙ্গে এক নবীনের লড়াই

ইকবাল হোসেন
ইকবাল হোসেন ইকবাল হোসেন , নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ০৮:২২ এএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, শামশুজ্জামান হেলালী ও সাগুফতা বুশরা মিশমা

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দামামা বেজেছে। তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে হুইসেল দিয়ে চলা শুরু করেছে নির্বাচনি ট্রেন। জমে উঠছে নির্বাচনি প্রচারণা। ওসমান হাদির ওপর হামলায় কিছুটা শঙ্কা তৈরি হলেও বসে নেই সম্ভাব্য প্রার্থীরা। চট্টগ্রাম-১০ আসনে দুই প্রবীণ প্রার্থীর সঙ্গে নির্বাচনি মাঠে আলোচনায় আছেন এক নবীন প্রার্থী।

এ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন হেভিওয়েট প্রার্থী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। নগরীর ডবলমুরিং-পাহাড়তলী-হালিশহর-খুলশী-চান্দগাঁও আংশিক মিলে চট্টগ্রাম-১০ নির্বাচনি এলাকা। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও এবার চট্টগ্রাম-১০ থেকে তাকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি।

আসনটিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর শামশুজ্জামান হেলালীকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তাদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলার প্রধান সমন্বয়কারী সাগুফতা বুশরা মিশমাকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ধানের শীষ, শামশুজ্জামান হেলালী দাঁড়িপাল্লা, সাগুফতা বুশরা মিশমা লড়বেন শাপলা কলি প্রতীকে।

সরেজমিনে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিএনপির প্রার্থী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী হেভিওয়েট প্রার্থী। জাতীয় রাজনীতিতেও আমীর খসরুর ভালো প্রভাব রয়েছে। নির্বাচনে জয়ী হলে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। ভোটারদের মধ্যে বিএনপির জনপ্রিয়তার পাশাপাশি ব্যক্তিগত প্রভাবের বাড়তি সুবিধা নিয়েই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামছেন তিনি।

উনি চট্টগ্রাম-১১ আসনের মানুষ। উনি এ আসনে নির্বাচন করলেও স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে তার যথেষ্ট দূরত্ব রয়েছে। সাধারণ জনগণের সঙ্গে তার (খসরু) এ দূরত্বটাই আমরা কাজে লাগাতে চেষ্টা করবো। কারণ, আমি এ আসনের তৃণমূল থেকেই উঠে আসা মানুষ।-অধ্যক্ষ শামশুজ্জামান হেলালী

তবে ভোটারদের একটি অংশের ভাষ্য- চব্বিশের জুলাই আন্দোলনের পর থেকে সারাদেশে মাঠের চিত্র পাল্টে দিয়েছে জামায়াত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সরব প্রচারণা রয়েছে দলটির। দেশের শীর্ষ চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর ভোটারদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব তৈরি করেছে দলটি। বিশেষ করে, তরুণ ভোটারদের মধ্যে এ প্রভাব রয়েছে এমন দাবিও উঠে এসেছে। এমন বিবেচনায় আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী হেভিওয়েট প্রার্থী হলেও তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন জামায়াতের প্রার্থী হেলালী। আর নবীনদের দল এনসিপির প্রার্থী বুশরা কাজে লাগাতে চান তরুণদের। দুই প্রবীণ প্রার্থীর কাছ থেকে শিখেই এক কাতারে লড়তে চান তিনি।

আরও পড়ুন
ভোটের মাঠে শঙ্কা বাড়াচ্ছে ‘টার্গেট কিলিং’
হাদির ওপর হামলা কি নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র?
বিএনপি-জামায়াত তিক্ততা: নির্বাচনি কৌশল নাকি নৈতিক দ্বন্দ্ব

সাধারণ ভোটারদের মতে, আগে চট্টগ্রাম মহানগরের আসনগুলোতে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লড়াই হতো। ২০১৪ সাল থেকে অনেকটা একতরফা নির্বাচনের কারণে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের পর থেকে আরেকটি সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে ভোটাররা। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে না পারলেও তাদের একটি নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক রয়েছে। সাধারণ ভোটারদের মন জয়ের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ওই ভোটব্যাংকে যারা বেশি কাছে টানতে পারবেন, যাবতীয় পূর্বাভাস আর হিসাব-নিকাশ মাড়িয়ে তারাই ভোটের মাঠে জয়ী হবেন।

‘স্থানীয় মানুষ’ ইমেজ কাজে লাগাবেন জামায়াত প্রার্থী

এ বিষয়ে কথা হলে জামায়াতের প্রার্থী অধ্যক্ষ শামশুজ্জামান হেলালী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবারের নির্বাচনটি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হবে। তাই তৃণমূল ভোটাররা জামায়াতের পক্ষে রয়েছে। পাশাপাশি ডাকসু, জাকসু, রাকসু, চাকসুতে এবার তরুণরা ন্যায় ইনসাফের পক্ষে রায় দিয়েছেন। যার প্রভাব সারাদেশের তরুণ ভোটারদের মধ্যে রয়েছে।’

নির্বাচনে কাউকে মোকাবিলার কোনো বিষয় নেই। আমাদের শক্তি জনগণ। ভোটের মাঠে আমরা জনগণের কাছে যাবো। জনগণ থেকে ভোট চাইবো। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে জনগণই আমাদের ভোট দেবে- এটাতে আমরা শতভাগ আশাবাদী।-আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী

আমীর খসরুর মতো হেভিওয়েট প্রার্থীকে কীভাবে মোকাবিলা করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী একজন বিশিষ্ট পার্লামেন্টেরিয়ান এবং বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। কিন্তু প্রার্থী হিসেবে তিনি এ আসনের স্থানীয় ভোটার নন। উনি চট্টগ্রাম-১১ আসনের মানুষ। উনি এ আসনে নির্বাচন করলেও স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে তার যথেষ্ট দূরত্ব রয়েছে। সাধারণ জনগণের সঙ্গে তার (খসরু) এ দূরত্বটাই আমরা কাজে লাগাতে চেষ্টা করবো। কারণ, আমি এ আসনের তৃণমূল থেকেই উঠে আসা মানুষ।’

তিনি বলেন, ‘আমি সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলর ছিলাম। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে আমি নাগরিকদের সেবা দিতে সচেষ্ট ছিলাম। বিএনপির প্রার্থী একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। এবার তরুণরা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে উন্মুখ। আমাদের মা-বোনেরাও এবার নতুন রাজনৈতিক পরিবর্তন চাইছে। যার প্রভাব থাকবে জাতীয় নির্বাচনে।’

আমাদের শক্তি জনগণ: আমীর খসরু

নির্বাচনের বিষয়ে চট্টগ্রাম-১০ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটি সুন্দর নির্বাচনের পরিবেশ রয়েছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে।’

নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মোকাবিলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে কাউকে মোকাবিলার কোনো বিষয় নেই। আমাদের শক্তি জনগণ। ভোটের মাঠে আমরা জনগণের কাছে যাবো। জনগণ থেকে ভোট চাইবো। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে জনগণই আমাদের ভোট দেবে- এটাতে আমরা শতভাগ আশাবাদী।’

তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের কাজে লাগাবেন এনসিপি প্রার্থী

এনসিপির প্রার্থী সাগুফতা বুশরা মিশমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলেও এখনো সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরের দিন ওসমান হাদির ওপর হামলা হয়েছে। এটা কোনো নরমাল হামলা নয়। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা করেই হামলাটা করা হয়েছে। এর মূল কারণ ৫ আগস্ট পরবর্তীসময়ে দেশের থানাগুলো থেকে লুট হওয়া অস্ত্র সরকার উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন এসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার না করা পর্যন্ত ভোটার ও প্রার্থী কারও মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা কাটছে না।’

তিনি বলেন, ‘ভোটের আগেই এসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি পুলিশ কিছুটা কার্যক্রম চালালেও থানাগুলো পুরোপুরি ফাংশন করছে না। কোনো জরুরি সেবা পুলিশ সাধারণ জনগণ পাচ্ছে না। আর নির্বাচনের দিন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিরাপত্তা। সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশকে যতটুকু ভূমিকা রাখা প্রয়োজন, সে হিসেবে পুলিশকে তৈরি করা হয়নি। এতে একজন ব্যক্তি হিসেবে আমি ভোটের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কিত।’

বিএনপি ও জামায়াতের দুই প্রার্থী আমার চেয়ে অভিজ্ঞ। তবে হেভিওয়েট যেটা বলা হচ্ছে, সেটা টাকা-অভিজ্ঞতার দিক থেকে হতে পারে। কিন্তু ’২৪ পরবর্তীসময়ে দেশে একটি পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। যে পরিবর্তন হবে ভোটারদের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে।- এনসিপির প্রার্থী সাগুফতা বুশরা মিশমা

বিএনপি ও জামায়াতের দুই অভিজ্ঞ হেভিওয়েট প্রার্থীকে ভোটের মাঠে মোকাবিলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিএনপি ও জামায়াতের দুই প্রার্থী আমার চেয়ে অভিজ্ঞ। তবে হেভিওয়েট যেটা বলা হচ্ছে, সেটা টাকা-অভিজ্ঞতার দিক থেকে হতে পারে। কিন্তু ’২৪ পরবর্তীসময়ে দেশে একটি পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। যে পরিবর্তন হবে ভোটারদের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে। আমি দুই সিনিয়র রাজনীতিবিদের কাছ থেকে তাদের অভিজ্ঞতার বিষয়গুলো শিখবো। কিন্তু ভোটের মাঠে আমিও তাদের মতোই প্রার্থী। তরুণ প্রজন্মের ভোটাররা পরিবর্তন চায়, তরুণদের ক্ষমতায়ন চায়। আমি সেটা কাজে লাগাবো ইনশাআল্লাহ।’

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বন্দর-পতেঙ্গা-হালিশহর নিয়ে ছিল চট্টগ্রাম-১০ আসন। ওই নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির প্রার্থী খালেদা জিয়া ধানের শীষ প্রতীকে ৬৯ হাজার ৪২২ ভোট পেয়ে জয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের ইসহাক মিঞা নৌকা প্রতীকে পেয়েছিলেন ৪৪ হাজার ১৫৪ ভোট। ওই নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী মো. আবু তাহের পান ১৩ হাজার ৪৬৬ ভোট।

১৯৯৬ সালের সপ্তম ও ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হন বিএনপির প্রার্থী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বন্দর-পতেঙ্গা এলাকা নিয়ে চট্টগ্রাম-১০ নির্বাচনি এলাকা গঠন করা হয়। ওই বছরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে হারিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এম এ লতিফ প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

২০১৪ সালের নির্বাচনে বন্দর-পতেঙ্গা এলাকাকে চট্টগ্রাম-১১ এবং ডবলমুরিং-পাহাড়তলী-হালিশহর-খুলশী-চান্দগাঁও আংশিক চট্টগ্রাম-১০ আসন করা হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. আফছারুল আমিন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জয়ী হন ডা. আফছারুল আমিন।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে মোট ভোটার চার লাখ ৯৬ হাজার ৪৩১ জন।

এমডিআইএইচ/এএসএ/এফএমএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।