হাদির ওপর হামলা কি নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র?
আসছে ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। চিকিৎসাধীন হাদির অবস্থা এখন সংকটাপন্ন। জুলাই আন্দোলনের সরব এই যোদ্ধার ওপর এমন হামলায় প্রশ্ন উঠছে এটি নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র কিনা।
যেভাবে হাদির ওপর হামলা হয়
শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পর রাজধানীর বিজয়নগরে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সিসিটিভির ফুটেজ ও পুলিশ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য বলছে, দুপুর ২টা ২০ মিনিটে গুলির করার শব্দ শোনা যায়। এর কয়েক সেকেন্ড পর মোটরসাইকেলে করে দুই যুবক দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। পুলিশ বলছে, তিনটি মোটরসাইকেলে করে দুর্বৃত্তরা ঘটনাস্থলে আসে। এর মধ্যে একটি মোটরসাইকেল থেকে হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। তিনি এসময় রিকশায় করে যাচ্ছিলেন।
আরও পড়ুন:
হাদিকে গুলি করা সন্দেহভাজনের ছবি প্রকাশ, তথ্য চাইলো পুলিশ
‘হাদির ওপর হামলাকারী আদাবর থানার নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা’

আগেও হামলার হুমকি পান হাদি
গেলো নভেম্বর মাসেও ৩০টি নম্বর থেকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি পান হাদি। ১৪ নভেম্বর ফেসবুকে একটি পোস্টে তিনি জানান, তাকে হত্যা, তার বাড়িতে আগুন দেওয়াসহ তার মা, বোন ও স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকিও দেওয়া হয়েছে। ওসমান হাদি সেসময় লেখেন, ‘গত তিন ঘণ্টায় আমার নম্বরে আওয়ামী লীগের খুনিরা অন্তত ৩০টি বিদেশি নম্বর থেকে কল ও টেক্সড করেছে। যার সামারি হলো-আমাকে সর্বক্ষণ নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। তারা আমার বাড়িতে আগুন দেবে। আমার মা, বোন ও স্ত্রীকে ধর্ষণ করবে এবং আমাকে হত্যা করবে।’ তার এমন অভিযোগের পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুরুত্ব দেয়নি বলে অভিযোগ করছেন রাজনৈতিক নেতারা।
হাদি যেভাবে রাজনীতিতে সরব হয়ে উঠলেন
৩৩ বছর বয়সী ওসমান হাদির বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটিতে। জুলাই আন্দোলনের আগে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার তথ্য নেই। তবে গণঅভুত্থানের পর বেশকিছু আন্দোলন কর্মসূচিতে সরব থাকলেও শেষ পর্যন্ত নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপিতে যোগ দেননি। জুলাইয়ের পক্ষের শক্তি হিসেবে গড়ে তোলেন ইনকিলাব মঞ্চ। সেটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন হাদি। সম্প্রতি ঢাকা-৮ আসনে (মতিঝিল, শাহবাগ, রমনা, পল্টন ও শাহজাহানপুর থানা) স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। এরপর থেকেই রাজনীতির মাঠে সরব তিনি। শুধু তাই নয় টকশোসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার সরব উপস্থিতি লক্ষ্য গেছে। হাদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন।

হামলার দিনও হাদি ফেসবুকে লেখেন, যেহেতু ঢাকা-৮ এ আমার পোস্টার-ফেস্টুন কিছুই নাই, তাই আমার এখন ছেঁড়া-ছিঁড়িরও চাপ নাই। দুদকের সামনে থেইকা জুম্মা মোবারক।
আরও পড়ুন:
হাদিকে গুলির প্রতিবাদে সারাদেশে বিএনপির বিক্ষোভ আজ
হাদির ওপর হামলা প্রমাণ করে নির্বাচন বানচালের চক্রান্ত চলছে
অপচেষ্টা করে নির্বাচন বানচাল করা যাবে না: মেয়র শাহাদাত
নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র?
ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলা দেশে পুনরুদ্ধার হওয়া গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার ওপর সরাসরি আঘাত বলে মন্তব্য করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এই হামলা শুধু একজন প্রার্থীর ওপর নয়, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার হওয়া গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার ওপরও সরাসরি আঘাত বলে মনে করছে তারা। এই হামলা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও নির্বাচনি পরিবেশের ভঙ্গুরতা সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন তোলা হয় এনসিপির তরফে। তারা বলছে, দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন আওয়ামী লীগ জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালিয়েছে, সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছে এবং তাদের অবশিষ্ট সন্ত্রাসী বাহিনী এখনো সক্রিয়ভাবে দেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। সরকার যদি অবিলম্বে আওয়ামী লীগের এই সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা না করে, তবে তারা আবারও গণতান্ত্রিক উত্তরণকে বাধাগ্রস্ত করবে এবং দেশকে সহিংস অরাজকতার দিকে ঠেলে দেবে। নির্বাচনের সব প্রার্থী ও নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি তাদের।

বিএনপি কীভাবে দেখছে এই হামলা
হাদির ওপর হামলার প্রতিবাদে আজ শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল করার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, নির্বাচনের আগে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নস্যাৎ করতে নীলনকশা অনুযায়ী ধারাবাহিক হামলা চালানো হচ্ছে।
তফসিল ঘোষণার পরের দিনেই ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা জাতীয় নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির। শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) বিকেলে ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্টে তিনি এমন মন্তব্য করেন।

নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, ওসমান হাদীর ওপর গুলিবর্ষণকারী সন্ত্রাসীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে অবিলম্বে প্রার্থী ও ভোটারদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
ওসমান বিন হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে ‘গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে চক্রান্ত’ বলে মন্তব্য করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) আলোচনা সভায় এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, আজকে শরিফ ওসমান বিন হাদির এ ঘটনার মতো আরও ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামে বিএনপির এক এমপি প্রার্থীর ওপর হামলা হয়েছে। সবই ষড়যন্ত্রের অংশ। যে কোনো মূল্যে এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। যে কোনো মূল্যে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
কী বলছে গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট?
তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা-৮ আসনের প্রার্থী ওসমান হাদির ওপর সশস্ত্র হামলার তীব্র নিন্দা ও নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট। নির্বাচন বানচাল করার একটা চক্রান্ত দেশে ক্রিয়াশীল বলেও মন্তব্য করেন গণতান্ত্রিক সংস্কার জোটের নেতারা।
যৌথ বিবৃতিতে জোটের মুখপাত্র ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ূম এবং আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, গত ১৬ মাসে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। এমনকি সরকারের মধ্যে সেই প্রচেষ্টাও কোনো দৃশ্যমান পর্যায়ে ছিল না। পরিস্থিতি আতঙ্কজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে যখন আজকে জুলাই যোদ্ধা ও ঢাকা-৮ আসনের প্রার্থী ওসমান হাদির ওপর যেভাবে টার্গেট করে হামলা করা হয়েছে।
হামলা নিয়ে যা বলছে জামায়াতে ইসলামী
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামের আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, কেউ যদি দেশে আবার নতুন করে ফ্যাসিজম বা সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চান, তাহলে খুব দেরি হবে না, জনগণের কাছ থেকে যথাযথ জবাব পেয়ে যাবেন। তিনি বলেন, জনগণ সব ষড়যন্ত্র রুখে দেবে। কাউকে এই ধরনের নোংরামি করার সুযোগ দেওয়া হবে না।

অন্যদিকে, হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ-মিছিল করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন। জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন তারা। এটি নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র কিনা খতিয়ে দেখার দাবি তাদেরও।
দীর্ঘদিন পর দেশে এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে জুলাই আন্দোলনের পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন স্তরের মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকেই গেছে। সামনে নির্বাচন, তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এসএনআর/এমএমএআর/এএসএম