স্বর্গীয় সৌন্দর্য চেরি ফুল

মোহাম্মদ হানিফ, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে
বিদায় নিয়েছে কনকনে শীত। এক পসলা বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতিকে সাজিয়ে তুলেছে তার আপন রূপে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে মৃতপ্রায় পাতাহীন গাছের ঢালগুলো। কোমল বাতাস এবং সুন্দর ফুলের সাথে উষ্ণ আবহাওয়া প্রকৃতির শান্ত-স্নিগ্ধ-অপ্রতীম মুগ্ধতার গন্ধে বলে দিচ্ছে দরজায় কড়া নাড়ছে বসন্ত।
কোরিয়ানরা অপেক্ষায় থাকেন এই বসন্তের জন্য। কারণ কোরিয়াতে হাজারো চেরি ফুলের কুঁড়ির প্রস্ফুটনে আগমন ঘটে এ সময়ে। কোরিয়ার বসন্তের প্রধান আকর্ষণ হলো চেরি ফুল।
সাধারণত গোলাপি, সাদা ও লাল রঙের ফুলের প্রাধান্য বেশি দৃষ্টিগোচর হয় চেরিতে। এক বিচিত্র গড়নের পাপড়ি দেখা যায় ফুলগুলোতে। সেই সঙ্গে গাছে গাছে আনন্দে মেতে ওঠে পাখপাখালি ও হরেক প্রজাতির রঙিন প্রজাপতি।
এ সময়ে কেরিয়ার প্রতিটি প্রান্তে হয়ে ওঠে চেরি ফুলের স্বর্গরাজ্য। হাজার বছর ধরে এই ফুলকে নিয়ে কোরিয়ানরা রচনা করে চলেছে চিত্রকর্ম, সাহিত্যকর্ম, গানসহ অনেক কিছুই। চেরি যেমন বসন্তের আগমনী গান শোনায়, তেমনি চেরি ফুলের মাধুর্য কোরিয়ানদের চিন্তাচেতনা ও সৌন্দর্যবোধের জোগান দেয়।
কোরিয়ানদের চেরি নিয়ে এই উন্মাদনা হাজার বছরের। এ জন্যই এর আগমনের সংবাদ জানাতে আবহাওয়া অধিদফতর বসে যায় নানা ধরনের হিসাব কষতে এবং সে অনুযায়ী তারা বিভিন্ন প্রিফেকচারে ফুল ফোটার আগাম ঘোষণা জারি করে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ায়। মার্চের শেষ দিক থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কোরিয়ার সর্বত্র তাপমাত্রা অনুযায়ী দেখা যায় চেরির সমারোহ।
সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করে প্রতি বছরই স্থানীয় কোরীয়রাসহ বিদেশি পর্যটকরাও বেরিয়ে পড়েন চেরির সৌন্দর্য দেখতে। পুরো দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন শহরজুড়ে চলতে থাকে এই চেরি উৎসব যেখানে লাখো মানুষের সমাগম ঘটতো।
এখানকার মানুষেরা এই উৎসব মিস করতে চাই না কারণ এই ফুল বেশি দিন স্থায়ী থাকে না। মাত্র ৭ থেকে ১০ দিন থাকে যদি বৃষ্টি না হয়। আর বৃষ্টি হলেই ঝরে যায়। পুরো কোরিয়া জুড়েই চেরি গাছগুলো বসানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। সৌন্দর্য বর্ধনটাই ওদের আসল উদ্দেশ্য।
পার্কগুলো তো আছেই, সাথে মূল রাস্তার দুই পাশ ধরে সারি সারি করে লাগানো হয়েছে গাছগুলো। কোরিয়াতে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চেরি গাছ থাকে।
গিউংসান প্রদেশের জিনহে শহরে হয়ে থাকে সবচেয়ে বড় চেরি উৎসব যা এপ্রিলের ১ তারিখে শুরু হয়ে ১০ তারিখ পর্যন্ত চলে। বিশ্বব্যাপী এই উৎসব ‘জিনহে নেভাল পোর্ট ফেস্টিভ্যাল’ নামে পরিচিত। ১৯৫২ সালের ১৩ এপ্রিল, কোরিয়ার ‘জাতীয় নায়ক’ অ্যাডমিরাল-ই ছান-শিনের স্মরণে সর্বপ্রথম খুব ছোট পরিসরে এই উৎসব শুরু হয়।
সময়ের পরিক্রমায় এই উৎসব এখন বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত উৎসব, যেখানে প্রতিবছর দুই মিলিওন পর্যটক ভ্রমণ করে থাকে। এই উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়ে থাকে।
প্রতি বছরের মতো এবারও বসন্ত এসেছে সাথে চেরির আবির্ভাবও ঘটেছে স্বর্গীয় সৌন্দর্য নিয়ে। কিন্তু কে জানত, পৃথিবীর মানুষকে প্রকৃতি বঞ্চিত করবে তার এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে! এ বছরও মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে জনসমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
নিরাপত্তা বাহিনীর বেষ্টনী পার হবে এতটা অবাধ্যও এদেশের জনগণ নয়। বিনয়ী এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে যে তারা বিশ্বসেরা! নেই লাখো দেশি–বিদেশি পর্যটকের ভিড়। প্রতিবারের মতো এবারও চেরি ফুল ঠিকই ফুটেছে কিন্তু চারদিকে সুনসান নীরবতা। বসন্তের ঐশ্বরিক পরশের পরিবর্তে আতঙ্কের বেড়াজালে আবদ্ধ পৃথিবী।
চেরিফুল আমার অন্য রকম ভালোলাগার একটি। আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে পা রেখেছিলাম কোরিয়ার মাটিতে। প্রথমেই কোরিয়ার চেরি ফুলের মুগ্ধতার ছোঁয়া দিয়েছিল আমার মনে। পাশ দিয়ে হাঁটলে আহ্... চেরির কি মিষ্টি সুরভি।
তাইতো অনেক সুগন্ধি এবং প্রসাধনী সংস্থাগুলি স্প্রে এবং লোশনগুলিতে এটি প্রতিলিপি করার চেষ্টা করে। সত্যি এ যেন এক অন্য পৃথিবী! মনে হয় চেরি ফুলের দেশ। যে দিকেই চোখ যায় শুধু চেরি ফুল আর চেরি ফুল। নানা রঙ আর রূপ নিয়ে বসন্তকে রাঙিয়ে দিতে কোরিয়ার সর্বত্র শোভা পাচ্ছে এ ফুল।
কোরিয়ার রাস্তাঘাটে কিংবা পার্কে যখন চেরি ফুলগুলো ফুটে থাকতে দেখলে, তখনই আমার মনে পড়ে দেশের কথা। বড়বড় কৃষ্ণচূড়া কিংবা শিমুল গাছগুলো কি সুন্দর লাল রঙে সাজিয়ে রাখে প্রকৃতি। কিংবা বর্ষার মোহময়ী কদম গাছ। কি মনোরম সেসব দৃশ্য!
আমার ভাবনায় একটাই প্রশ্ন জাগে, কোরিয়ান-জাপানিদের মতো আমরা সেরকম ফুলের সমাঝদার নই। তা নাহলে কৃষ্ণচূড়া, শিমুল কিংবা কদম ফোটা আমাদের জনমনে তেমন প্রভাব ফেলেনা কেন?
চেরি উৎসব এখন কোরিয়া ছাড়াও বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে পালিত হয়। জাপান, চীন, তাইওয়ান, ফিলিপাইন, ম্যাকাও, জর্জিয়া, ফিনল্যান্ড ও আমেরিকা। ফুল-ফল মিলিয়ে সারা পৃথিবীতে ৪৫০ জাতের চেরি পাওয়া যায়। এ গাছ সর্বোচ্চ ৩০ মিটারের মতো উঁচু হতে পারে।
সেই সঙ্গে চোখধাঁধানো ফুলের অসংখ্য রকমফের। মূলত ফুল, ফল ও আলংকারিক শোভাই এই গাছের জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ। এরা পিচ ও এপ্রিকট ফলের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। ফুল ঝরে পড়ার পর নতুন পাতায় সবুজ রূপ ধারণ করে।
চেরি পুষ্প গাছ বাদাম, পীচ, বরই এবং এপ্রিকট গাছ সহ অন্যান্য সাধারণ গাছের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।
যদিও এই গাছগুলি চেরি ফুলের গাছের সাথে একই রকম, তবুও এই গাছগুলির কোনওটিতেই চেরি ফুলের গাছে যে অনন্য সুন্দর গোলাপী ফুল ফোটেনি। রাস্তার দুই ধারে কিংবা বিভিন্ন পার্কে অজস্র চেরি গাছ সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে অপেক্ষা করে পথিক কিংবা ক্লান্ত অবসন্ন মানুষের মনে প্রশান্তি দেয়ার জন্য।
চেরি ফেস্টিভালে দক্ষিণ কোরিয়ার কিছু জায়গা খুবই বিখ্যাত। যেখানে প্রতিবছরই হাজার হাজার পর্যটকরা ভিড় করে থাকেন।
চেরির রাজ্য: জেজু দ্বীপ
দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয় যে, চেরি গাছের সবচাইতে বিখ্যাত প্রজাতিটির উদ্ভব দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু প্রদেশে। জিজু দ্বীপটি গোলাপী বসন্তের প্রথম দিকে মার্চের শেষের দিকে প্রথম পুষ্পিত হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়। পর্যটকরা এখানে সমুদ্র উপকূলীয় দৃশ্য সাথে চেরি ফুলের সৌন্দর্যকে উপভোগ করেন।
কোরিয়ানদের চেরি গাছের নীচে পিকনিক করতেও দেখা যায়। আপনি এই দ্বীপের বিন্দুতে কিং চেরি গাছের কয়েকটি বড় ফুল দেখতে পাবেন। যেমন সুন্দর তেমনি বড় পাপড়িযুক্ত এই জাতটি এপ্রিলের প্রথম দিকে কেবল দু'তিন দিনই পুরো ফুল ফোটে, তাই আপনার আগমনের সাথে ফুল ফোটা এই দুইয়ের সমন্বয় আবশ্যক।
কোরিয়ার ওভারভিউতে চেরি ব্লসমস চেরি ফুলটি সাধারণত জাপানের সাথে সম্পর্কিত, যেখানে এটি সাকুরা নামে পরিচিত। এটি অংশে রয়েছে কারণ চেরি পুষ্পটি জাপানের প্রাকৃতিক ফুল। কোরিয়ায় একে (벗꽃) বলা হয়। জেজুতে প্রতি বছর বিভিন্ন চেরি পুষ্প উৎসবগুলিতে অংশ নিতে বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার পর্যটকরা ভিড় জমান।
চেরির মহাউৎসব: জিনহে
জিনহে গুনহংজে উত্সব (জিনহে) তাদের সমস্ত গৌরবতে চেরি পুষ্প দেখতে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গাটি হলো কোরিয়ার দক্ষিণ উপকূলের নিকটে জিনহেয়ের ছোট সামরিক বন্দর। বছরে একবার, সাধারণত এপ্রিলের গোড়ার দিকে শহরটি এর বৃহত্তম ও দেশের চেরি ফুলের উৎসবগুলির মধ্যে সর্বাধিক বিখ্যাত জিনহে গুনহাজে প্রচুর পর্যটককের সমাগম হয়।
চেরি পুষ্প গাছের দর্শনীয় প্রদর্শনী ছাড়াও, উৎসবটি দর্শকদের অ্যাডমিরাল লি সান-শিনের বিখ্যাত কচ্ছপ জাহাজের একটি প্রতিরূপে ভ্রমণ করার সুযোগ দেয়, একটি কোরিয়ান যুদ্ধজাহাজ যা রয়াল কোরিয়ান নৌবাহিনী প্রথম থেকেই রীতিমতো ব্যবহৃত হয়েছিল।
চেরি ফুলের আগমন উদযাপনের দশ দিনের উৎসব চলাকালীন জিনাহে বন্দরের শহর বুশান থেকে বাসে এক ঘণ্টা পথ। জিনে গুনহাজে ফেস্টিভ্যালটি সাধারণত মিলিটারি ব্যান্ডের কুচকাওয়াজ, সঙ্গীত পরিবেশনা এবং তারার আকর্ষণ, চেরি ফুলের গাছগুলো দর্শকদের স্বাগত জানায়।
চেরির আকর্ষণ: হাওয়াগা
হাওয়াগা চেরি ব্লসম ফেস্টিভাল (হাওয়াগা)। জিরি মাউন্টেনের পাদদেশে অবস্থিত হাওয়াগা চেরি ব্লসম ফেস্টিভাল। এপ্রিল এলে অঞ্চলটি সাদা এবং নরম গোলাপী রঙের একটি কম্বলের মত হয়ে যায়। চেরি উৎসবের “10ri Cherry Blossom Road,”, একটি রোম্যান্টিক জায়গা, এখানে চেরি ফুলের গাছগুলির চার কিলোমিটার দীর্ঘ প্রসারিত।
এটি স্থানীয়দের দ্বারা “Marriage Road” বা ‘ওয়েডিং রোড’ নামেও পরিচিত, কারণ বলা হয়ে থাকে যে যে প্রেমিকরা গাছের নীচে দুজনের হাত ধরে হাঁটেন তারা বিবাহ করবেন এবং পরে একসঙ্গে সুখী জীবন যাপনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
কয়েক বছর আগেও চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে নানা বিষয় নিয়েই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও কূটনৈতিক রেষারেষিও কমতি ছিলো না। তার মাঝে এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে নতুন এক বিতর্ককেরও যোগ হয়েছিলো। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো একটি প্রশ্ন: ‘চেরি ব্লসম’ গাছের আদি উৎপত্তি কোথায়?
তিন দেশের প্রত্যেকেই বলছে, সুন্দর ফুলবিশিষ্ট এই গাছটির উৎপত্তিস্থল তাদের দেশই। বিশেষ করে এই তিন দেশের লোকেদের জন্য চেরি ফুল খুবই জনপ্রিয়। তাবে বিশ্বে বেশকয়েকটি দেশে পাওয়া গেলেও এটি জাপানের জাতীয় ফুল। চেরি ফুলকে জাপানিজরা বলে সাকুরা।
আজ পৃথিবী নিস্তব্ধ অভিমানী প্রকৃতিতে হানা দিয়েছে মরণব্যাধী করোনা। কত রকম রোগ–শোক প্রকৃতি তার বুক পেতে আগলে রাখে এই মানবসভ্যতার জন্য। কিন্তু মনুষ্যত্ব ভূলণ্ঠিত হতে হতে আমরা এমন এক বীভৎস রূপ ধারণ করেছি যে সত্যি প্রকৃতি আজ আমাদের প্রতি বিরূপ। তার কোনো ক্ষমতাই আজ আর আমাদের রক্ষা করতে নারাজ এই মৃত্যুগ্রাসী করোনাভাইরাসের ভয়ংকর থাবা থেকে।
উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, প্রকৃতির কাছে গেলে মন ভালো হয়ে যায়, প্রকৃতি সুন্দর হলে মনও সুন্দর হয়ে যায়। কিন্তু কোথায় গেলে আর কতটা বোঝালে মানুষ বুঝবে, মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে? বেঁচে থাকার জন্য খুব বেশি কিছু লাগে কি?
এমন বিপর্যের মুখোমুখি হয়েও যদি আমরা সেটা বুঝতে না পারি তবে মানুষ হিসেবে আমরা সত্যি অযোগ্য। তবে এখন একটাই প্রত্যাশা আবার পৃথিবীর মাঝে প্রকৃতির বিশুদ্ধ বাতাসে প্রাণ ভরে একটু নিশ্বাস নেয়া।
এমআরএম/জিকেএস