সাগরের ঢেউয়ে ভেসে আসা এক ভালোবাসা

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ১২:৫৫ এএম, ১৯ জুলাই ২০২১
ছবি : সংগৃহীত

কোটিপতির একমাত্র সন্তান পরিকল্পনা করেছে সুদূর উত্তর আমেরিকার দেশ মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটি থেকে সোজা বোটে করে ইউরোপ ভ্রমণ করবে। সমুদ্রের পাড়ে গড়ে উঠা গ্রামের পরিবেশে জীবনকে উপলব্ধি করবে মনের আনন্দে।

যে কথা সেই কাজ, কয়েকজন বন্ধু মিলে রওনা দিয়েছে। যেতে যেতে পথে পূর্ণিমা রাতে হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় সাগরের মধ্যে এক পাহাড়ের সাথে বোটের প্রচণ্ড ধাক্কা লাগে অবং পুরো বোট পানিতে ডুবে যায়।

বিজ্ঞাপন

খুব অল্প সময়ের মধ্যে এ দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ে। নানাভাবে তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু কারও সন্ধান না পাবার কারণে ধারণা করা হয় সাগরের সার্কের পেটে ঢুকেছে সবাই।

মেক্সিকো সিটির অভিজাত পরিবারের একমাত্র সন্তান খ্রীষ্টিয়ানো গ্রিসের সমূদ্র সৈকতে গ্রাস হয়েছে। বাবার একমাত্র সন্তান খ্রীষ্টিয়ানো। বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না এ ভয়াবহ দুর্ঘটনা। তারপরও তল্লাশির জন্য ইউরোপের সাগরে লোক লাগিয়েছে যদি কখনও ছেলের সন্ধান মেলে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

জেনিফার স্টকহোমের মেয়ে। বহু বছর প্রেমের কারণে দেশ ছেড়ে বসবাস করছে গ্রিসের পাহাড়ি এক সবুজ, সৈকতে। পারাগা, গ্রিসের একটি গ্রামের নাম। গ্রামের চারপাশজুড়ে সাগর। সাগরের ভিতরে পাহাড় এবং তা সবুজে ভরা।

বসবাসের জন্য এক চমৎকার জায়গা। ছোট বড় বোট বা নৌকা করে বেদে উপজাতির মতো সমুদ্র সৈকতের এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ভ্রমণ করা এসব রোম্যান্টিক জায়গাগুলো আহ কী মজা!

তারপর যদি সঙ্গিনী সাথে থাকে তাহলে তো কোনো কথাই নাই, শুধু আনন্দ আর ফুর্তি। জেনিফার দিনগুলো কোনো এক সময় এভাবেই চলতে থাকে। বিয়ে করে স্কটল্যান্ডের এক ছেলে নাম পিটার এবং তিন সন্তানের মা হয় সে। হঠাৎ রোড অ্যাক্সিডেন্টে পিটার মৃত্যুবরণ করে। জেনিফার জীবনে নির্জনতার অন্ধকার নেমে আসে, কী করবে?

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

স্টকহোমে ফিরবে নাকি গ্রিসেই থাকবে এমনটি ভাবনায় কাটছে তার দিন। বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে সমুদ্র সৈকতে। আজ জায়গাটি বেশ নিরিবিলি, কোথাও কেউ নেই, শুধু জেনিফার এবং তার তিন সন্তান। বেশ দূরে কে যেন বালুর উপর শুয়ে আছে। সাগরের কোলে তো সবাই বলতে গেলে কাপড় ছাড়া শুয়ে থাকে, এ দেখি সুট কোর্ট পরে শুয়ে আছে!

ব্যাপার কী! কৌতুহলের ছলে সামনের দিকে এগিয়ে দেখে ছেলেটি স্পেনিশ ভাষায় কী যেন বলছে। জেনিফার বুঝতে পেরেছে কোনোকিছু ঘটেছে। শরীরের কোথাও কোনো ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন নেই। নড়াচড়ার সমস্যা যখন নেই তখন তাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল।

ছেলেটি জেনিফারদের দেখে মনে করেছে এরাই তার পরিবার, তবে কাউকে সে চিনতে পারছে না। নাম কী, কোত্থেকে এসেছে বা কী হয়েছে কিছুই মনে করতে পারছে না। তাড়াতাড়ি করে জেনিফার ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।

বিজ্ঞাপন

ছেলেটির কোনো পরিচয়পত্র না থাকায় জেনিফার তার গার্জিয়ানের দায়িত্ব নিয়ে কিছুদিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নজরে ছেলেটিকে রেখেছে। সপ্তাহ খানেক পর ডাক্তার জানিয়েছে যে ছেলেটির স্মরণশক্তি লোপ পেয়েছে, সময়ের সাথে সবকিছু ফিরে পেতে পারে তবে তাকে কোনোরকম চাপের মধ্যে রাখা যাবে না। এ কথা শোনার পর জেনিফার সিদ্ধান্ত নিলো তাকে বাড়িতে নেবার।

জেনিফার সন্তানরা ছোলেটিকে পছন্দ করে প্রথম দেখাতে। বাবা হারানোর শোক পরিবার থেকে দূর না হতেই মিরাকেলের মতো পরিবারে নতুন একজন বাবার বয়সী পুরুষের আবির্ভাব যা সবাইকে বেশ আপ্লুত করে তুলেছে।

ছেলেটির নাম দিয়েছে সবাই ক্রিস্ট। ক্রিস্ট অতীতের সব ভুলে গেছে, তার কাছে জেনিফারের পরিবারই তার পরিবার। কয়েকদিন যেতেই আশপাশের প্রতিবেশিরা মিলে আলোচনা করতে থাকে কীভাবে কী করা যায়! ক্রিস্ট সবার চোখে একজন নতুন পরিচিত মুখ হলেও তাকে সবাই পছন্দ করতে শুরু করেছে।

বিজ্ঞাপন

ক্রিস্ট তার অতীত ভুলে গেলেও স্পেনিশ এবং ইংরেজি ভোলেনি। এদিকে জেনিফার তাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে যে তারা তাকে সাগর পাড়ে পেয়েছে। সে তাদের কেউ না। জেনিফার সন্তানরা তার সন্তান না ইত্যাদি। ক্রিস্ট কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে সে তাদের কেউ না, তাছাড়া ছোট মেয়েটি ক্রিস্টকে ড্যাডি বলে ডাকে যা ক্রিস্টকে আরো বিশ্বস্ত করে তুলেছে যে সে তাদেরই একজন।

ক্রিস্টের নতুন জীবন গ্রিসে জেনিফারের সঙ্গে চলছে মন্দ নয়। জেনিফার কোনোভাবেই বিশ্বাস করাতে পারছে না যে ক্রিস্ট তার স্বামী নয়, এমতবস্থায় পাড়া প্রতিবেশি প্রস্তাব দেয় তাহলে নতুন করে বিয়ে করে তারা যেন বিষয়টি লিগালাইজ করে ফেলে। এমন একটি আলোচনার সময় হঠাৎ একটি বোট এসে হাজির হয় পারাগার সৈকতে।

এ যে সে বোট নয়, সুদূর মেক্সিকো সিটি থেকে বড় এক বিলাসবহুল জাহাজে করে খ্রীষ্টিয়ানোর বাবা, মা এসেছেন। এই সমুদ্র সৈকতে বাবা-মার এক মাত্র সন্তানকে হাঙ্গর গ্রাস করে ঠিক এক বছর আগে। সন্তান হারাবার দুঃখ তাদের মতো করে আর কেউ কি বুজবে? খ্রীষ্টিয়ানোর বাবা-মা প্লান করেছে কিছুদিন থাকবেন পারাগা গ্রামে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, ক্রিস্ট তার নতুন পরিবার নিয়ে মনের আনন্দে জীবন যাপন করছে পারাগার সমুদ্র সৈকতে। আজ পুরো পরিবার সাগরে এসেছে, আনন্দ ফূর্তির সঙ্গে সাগরের পানিতে মনের আনন্দে সাঁতার কাটা থেকে শুরু করে নানা ধরনের বিনোদনের মধ্য দিয়ে কাটছে তাদের সময়।

খ্রীষ্টিয়ানোর মায়ের চোখে দৃশ্যগুলো ধরা পড়েছে। ক্রিস্টের চেহারায় তার নিজের ছেলে খ্রীষ্টিয়ানোর খুব মিল খুঁজে পাচ্ছে, তা সত্ত্বেও বিশ্বাস করতে পারছে না এই ছেলেই তার সন্তান।

বিশ্বাস করবেই বা কী করে? এক বছরে ছেলের তিনটি সন্তান সাথে বউ, কার সাধ্যো কল্পনা করা যে ক্রিস্টই তাদের সন্তান? তা ছাড়া তারা গত এক বছর আগেই জেনেছে যে তাদের সন্তানকে হাঙ্গর গ্রাস করেছে।

বিজ্ঞাপন

খ্রীষ্টিয়ানোর বাবা-মার যাবার সময় হয়েছে, কোনো এক মুহূর্তে ক্রিস্টের নজরে পড়েছে তার বাবা-মা। হুট করে ক্রিস্ট তার বাবা-মার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে এবং তার নিজের পরিবার জেনিফার এবং সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দেয়।

একই সাথে নিজে নিজেই বলতে শুরু করে সে, এ কী করে সম্ভব?আমি তো বিয়েই করিনি, তারপর তিন সন্তান? জেনিফাকে দোষী সাব্যস্ত করে বললো, তুমি সুযোগের অপব্যবহার করেছো? আমার বিপদে আমাকে কিডন্যাপ করেছো, আমার সম্পদের লোভে? ছি ছি, কী করে পারলে তুমি আমাকে ঠকাতে?

জেনিফার কয়েকবার চেষ্টা করল বিষয়টি তুলে ধরতে, কোনো এক সময় বললো, ক্রিস্ট প্লিজ, আমাকে বলতে দাও? ক্রিস্ট কোনো কথাই শুনলো না বরং হঠাৎ করে বললো, ক্রিস্ট? তুমি আমার নামও বদলে ফেলেছে অর্থের লোভে? আমি তোমাকে ঘৃণা করি বলে সব ফেলে বাবা-মার সঙ্গে চলে গেলো।

এদিকে, বাচ্চাগুলো কী কান্নাই না করছে, আশ্চর্য! ক্রিস্ট মুহূর্তে সব ভুলে গেলো! এক বছরের ভালোবাসা, বিপদে তার পাশে থেকে মানসিক সাহায্য থেকে এত কিছুর পরও ক্রিস্ট সব ফেলে চলে গেলো!

জেনিফার সুইডিশ, কাউকে ঠকিয়ে জীবন গড়বে এতো তার চরিত্রে থাকার কথা নয়। কিন্তু মেক্সিকো, সেতো বাংলাদেশের মতো দুর্নীতিযুক্ত দেশ, যেখানে ধনী গরীবের ব্যবধান বিশাল। খ্রীষ্টিয়ানো এবং তার পরিবার কখনও কি জেনিফার মতো করে ভাববে? না।

এখানেই সভ্যতা, মানবতা এবং নৈতিকতার ব্যবধান। পুরো জিনিসটা ভুল বোঝাবুঝির মধ্য দিয়ে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। খ্রীষ্টিয়ানো সেই দিনই জাহাজে করে বাবা-মার সঙ্গে রওনা দিল মেক্সিকোর উদ্দেশ্যে। জেনিফারকে ডাক্তার যদিও বলেছিল হঠাৎ ক্রিস্ট তার পুরোনো স্মৃতি ফিরে পাবে কিন্তু সেটা এভাবে, কখনও জেনিফার ভাবতে পারেনি।

যাই হোক জেনিফার বিষয়টি সহজভাবে নিতে চেষ্টা করলেও বাচ্চাগুলো পুরো ঘটনাটি মেনে নিতে পারছে না, পারবেই বা কী করে? এতো অল্প সময়ে তারা দু’জন বাবা হারালো, এ এক করুণ সময় তাদের জীবনে।

ছোট মেয়েটি সারাক্ষণ শুধু কান্নাকাটি করছে, তাকে কোনোভাবেই সান্তনা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে জাহাজ চলছে তার গতিতে, কোথায়, কখন ক্রিস্ট কীভাবে আছে সেটা যেমন জেনিফার জানে না, ঠিক ক্রিস্টও জানে না কী অবস্থার মধ্য দিয়ে পার করছে জেনিফার এবং তার সন্তানেরা!

খ্রীষ্টিয়ানো হঠাৎ ঘুমের ঘরে দুঃস্বপ্নে চিল্লাচিল্লি করছে, তার ঘুমের ঘোরে অস্বাভাবিক আচরণে তার বাব-মারও ঘুম ভেঙ্গে গেছে। খ্রীষ্টিয়ানো তার বাবা মাকে বলছে জাহাজ ঘুরাতে। বাবা-মা কিছুই বুঝতে পারছে না। ব্যাপার কী, ছেলে কি পাগল হয়ে গেলো?

খ্রীষ্টিয়ানো এক এক করে সব কথা তার বাবা-মাকে বললো। প্রথমে বাবা বিষয়টি গুরুত্ব দিতে নারাজ হলেও পরে ছেলের সবকিছু শুনে জাহাজের মোড় ঘুরাতে নির্দেশ দিলো। রাত শেষে সকাল হতেই খ্রীষ্টিয়ানো ফিরে এলো সেই ভালবাসার সমুদ্র সৈকতে।

সে এক নতুন দেশে দিনগুলি ছিল যে মুখর কতো ভালোবাসার মধ্যে। সাত সকালে কে দরজা নক করছে? দরজা খুলতেই দেখে ক্রিস্ট, ক্রিস্ট ফিরে এসেছে জেনিফার হৃদয়ে, ক্রিস্ট সাগরের ঢেউয়ে ভেসে আসা জেনিফার জীবনের এক নতুন ভালোবাসা।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com

এমআরএম/এএএইচ

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com